আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

ডাকসু নির্বাচন: ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার নাকি আরও কয়েক ধাপ নিচে নেমে যাওয়া

মুনীর উদ্দীন শামীম  

ডাকসু নির্বাচন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্নিপরীক্ষার দিন। নিজকে প্রমাণ করার দিন। আপন মহিমায় ঘুরে দাঁড়াবার দিন। পরীক্ষাটা প্রথমত মাননীয় ভিসির। তারপর প্রো-ভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও প্রশাসনের। এবং অবশ্যই সরকারের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। ছাত্র সংগঠনগুলির। তারপর নিশ্চিতভাবেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের। এ পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয় তার বিলীন হতে থাকা গৌরব ও ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের পথে একধাপ এগুবে, না হয় আরও নিম্নগামী হবে, কয়েক ধাপ।

এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা পরীক্ষাটা কীভাবে দেবেন। কোন পথে যাবেন। ঐতিহ্য ও গৌরবের পুনরুদ্ধারের পথে এগুবেন নাকি পঙ্কিল জলের উপর থাকা মাথাটা নিয়ে ডুব দেবেন। বলে রাখা দরকার যে, ডাকসু নির্বাচন হয়ে গেলেই, নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হলেই, ডাকসুও হল সংসদসমূহ গঠিত হলেই তারা পাশ করবেন, পরীক্ষায় উৎরে যাবেন- এমন নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে না। এ নিশ্চয়তা দিতে না পারার কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ ঐতিহ্য। গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামে এর গৌরবময় রেকর্ড। অতএব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্য কারও সাথে নয়; তার নিজের ঠিক করা ঐতিহ্যের মানদণ্ডের সাথেই তুলনীয় হয়ে পাশ করতে হবে।

ফলে নির্বাচনটা কীভাবে হলো, কোন প্রক্রিয়ায় হলো- তার সংখ্যাগত ও গুণগত মান বিবেচিত হবে, বিচার-বিশ্লেষণ চলবে, খুব সূক্ষ্মতার সাথে। সে সংখ্যাগত ও গুণগত মানের বিচারে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের সূচক থেকে কোনো বিচ্যুতি ঘটে, তাহলে তা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামের দীর্ঘ গৌরবোজ্জ্বল মুখে কালিমা লেপন করবে। সে কালিমা শুধু এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখে লাগবেনা। লাগবে গোটা জাতির মুখে। কারণ এ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশকেই প্রতিনিধিত্ব করে। আর আমরা যারা এর প্রাক্তন শিক্ষার্থী, তারা এখনও এ বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুভব করি চোখ দিয়ে নয়; হৃদয় দিয়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো সাফল্যে আমরা উজ্জীবিত হই। আমরা এর সাফল্য উদযাপন করি। উপস্থিত হতে না পারলে অন্তত মনে মনে। আবার এর যেকোনো ধরনের বিপ্রতীপ যাত্রায় আমরা বেদনাক্রান্ত হই। ব্যথিতও হই। মন খারাপ করি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি পচে যাবার উপক্রম হলে, তার প্রভাব আমাদেরও গায়ে লাগে, আমাদেরও হৃদয়ে আঘাত করে। আমাদেরও মন কাঁদে।

এটাও স্বীকার করতে হবে যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটা ফেলের ঘটনা অবশ্য ইতোমধ্যে ঘটে গেছে। অথবা বলা যায় পূর্বসূরিদের ইচ্ছেকৃত ফেলের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছেন। কারণ সাবেক সেনাশাসক এরশাদের সময়ও এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ভোট দিয়েছেন। কিন্তু স্বৈরাচারের পতনের পর গণতান্ত্রিক সরকারের ভিসিরা, তাদের প্রশাসন নিজ মেরুদণ্ড খাড়া করে নিজ দায়িত্বের অংশ হিসেবে কেউ নির্বাচন দেননি, দিতে চাননি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে এখন যেসব ভিসি মহোদয়গণ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হয়ে টকশো’তে টেবিল চাপড়ান, সাদা, গোলাপি অথবা নীলরঙের কথাবার্তা বলেন, তাদের প্রত্যেকেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এ গণতান্ত্রিক অধিকারকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। নির্বাচন না দিয়ে দলীয় স্বার্থের কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ থেকেছেন। ঝুঁকি নিতে চাননি। নিজের অথবা নিজেদের ক্ষমতার মমতায়। সেই ধারাবাহিকতাই বজায় ছিল। যে কারণে এ নির্বাচনের জন্য শিক্ষার্থীদের দাবি তুলতে হয়েছে। কথা বলতে হয়েছে দীর্ঘসময়। রাস্তায় নামতে হয়েছে। অনশন করতে হয়েছে। তাতেও কর্তৃপক্ষের হৃদয় গলেনি। টনক নড়েনি। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। আদালতকে বিশেষ নির্দেশ না দিতে হয়েছে। সময় বেঁধে দিতে হয়েছে। বেঁধে দেয়া সময় নিয়ে ওটা না পোড়েন তৈরির প্রয়াস আমরা লক্ষ্য করেছি। তারপরও শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ আটাশ বছর পর নির্বাচন হচ্ছে দেখে আমি, আমরা ভীষণ খুশী। তবে একই সাথে আতংকিতও। আমরা আতংকিত এই ভেবে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে তার ম্রিয়মাণ ঐতিহ্যকে আবার ঠিক আগের মতোই জ্বালিয়ে তুলতে পারবে নাকি নানা বিচ্যুতির মধ্য দিয়ে কয়েক ধাপ নিচে নামার উদাহরণ তৈরি করবে!

তবে এ শঙ্কার মধ্যেও আমরা আশাবাদী হতে চাই। আমরা স্বপ্ন দেখতে চাই। খুব বড়মাপের স্বপ্ন। আমরা ভাবতে চাই, ডাকসু নির্বাচন প্রত্যাশিত মানের চেয়েও উন্নতমানের একটি নির্বাচন হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি দলীয় নতজানুতার বড় বড় অভিযোগ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই সে অভিযোগ ভুল প্রমাণ করে দেবে। সবার জন্য একটি ভয়ভীতিশূন্য পরিবেশ নিশ্চিত হবে। সকল শিক্ষার্থী একটি ভয়ভীতিশূন্য আনন্দমুখর পরিবেশে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে।

পরিশেষে বলতে চাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মেধা প্রশ্নাতীত। তবে সে মেধার ব্যবহার প্রশ্নাতীত নয়। সেটাকে প্রশ্নাতীত করার একটা সুযোগ এ নির্বাচন। আশাকরি ঢাবির শিক্ষার্থীরা তাঁদের মেধার সচেতন ব্যবহার করবেন। যারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন, তারা পুরনো ঐতিহ্যের আলোকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে দাঁড়াবেন, মুক্তবুদ্ধির পক্ষে দাঁড়াবেন। বুদ্ধির মুক্তির পক্ষে দাঁড়াবেন। শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের উন্নয়ন যাদের রাজনীতিক এজেন্ডা- তাদের পক্ষে দাঁড়াবেন। একযোগে বাতিল করবেন কয়েক দশক ধরে চলমান মেদবহুল-পেশিবহুল ও পয়সা উসুলের রাজনীতিকে, রাজনৈতিক সন্ত্রাসকে ও সন্ত্রাসের রাজনীতিকে, পুরুষতন্ত্র ও যৌন সন্ত্রাসের রাজনীতিকে, গেস্টরুম সংস্কৃতিকে, ছাত্ররাজনীতির নামে টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির সংস্কৃতিকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা থাকলো।

ডাকসু গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিচর্চার উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবেই নবতর অধ্যায়ে পথ চলতে শুরু করুক।

মুনীর উদ্দীন শামীম, গবেষক ও উন্নয়ন কর্মী; সুশাসন বিষয়ক একটি কারিগরি প্রকল্পে কর্মরত।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ