আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

আপনি তাহলে কী করবেন?

ইমতিয়াজ মাহমুদ  

সাফা কবির নামে একজন অভিনেত্রী বলেছেন যে তিনি নাকি পরকালে বিশ্বাস করেন না। বেশ কথা। তাঁর ইচ্ছা তিনি পরকালে বিশ্বাস করেন কি করেন না বা কেন করেন বা কেন করেন না। তাতে আপনারই বা কি আর আমারই বা কি? এইজন্যে তাঁকে যারা গালিগালাজ করছেন এরা কারা? অশ্লীল সব গালিগালাজ আর সে যে কীসব হুমকি! আমি এসব কথা টাইপ করে আপনাদের সামনে উল্লেখ তো করতেই পারবো না, এমনকি একান্ত বন্ধুদের সাথে বসেও উচ্চারণ করতে পারবো না।

ভেবেছিলাম এটা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করবো না। কেননা এখন যদি একদল লোক সাফার পক্ষে দাঁড়িয়ে যায় তাইলে ও গালাগালিওয়ালাদের গালি ও হুমকির মাত্রাও বেড়ে যাবে। কী দরকার! বেচারা সেলিব্রিটি মানুষ, অভিনেত্রী, ওর পক্ষে লোকজনকে খেপিয়ে দেওয়াটা কোন কাজের কথা হবে না। তিনি হয়তো পুলিশের সাহায্য নিয়ে গালাগালিওয়ালাদের নেতাদের দুই একজনকে ধরে প্রাইভেট লেভেলেই ব্যাপারটা সামলে ফেলবেন, অথবা প্রথম আলো যা করেছিল, কোন ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে তওবা করে বিবাদ শেষ করে দেবেন।

কিন্তু বিষয়টা নিয়ে বলা দরকার। শুধু এই অভিনেত্রীর কথা নয়, সাধারণভাবে আমাদের এখানে যে অসহিষ্ণুতা বেড়েছে, সংখ্যাগুরু লোকজন কথায় কথায় মর্মাহত হয়ে লোকজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন, কেবলমাত্র মতামত প্রকাশের জন্যে লোকজনকে এইভাবে হেনস্তা করতে থাকেন, এটা নিয়ে কথা বলা দরকার। কেননা যে দেশ কথায় কথায় মানুষের কণ্ঠরুদ্ধ করে সেটি তো কোন সভ্য দেশ হতে পারে না। সভ্যতা ও সভ্যতার বিকাশের পূর্বশর্তই হচ্ছে যে একদল মানুষ প্রচলিত জ্ঞান, প্রচলিত বিশ্বাস ও প্রচলিত প্রথা প্রতিষ্ঠান নিয়ে প্রশ্ন করবে, ওদের যার যার মতামত প্রকাশ করবে। রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে এইসব মানুষের কণ্ঠ যাতে কেউ রুদ্ধ করতে না পারে সেটা দেখা।

আমাদের এখানে তো কণ্ঠ রুদ্ধ হচ্ছেই। লেখকরা দেশ থেকে পালিয়ে বাঁচছেন। যারা পালাতে পারেননি তারা হয় চুপ করে থাকছেন অথবা উগ্রবাদীদের হাতে প্রাণ দিচ্ছেন। এটা কেবল যে ধার্মিক লোকদের হাতে নিধার্মিক লোকদের হেনস্তা হওয়ার ব্যাপার সে তো কেবল নয়। আওয়ামী লীগের লোকজনও এইরকম আচরণ করেন, ওদের সরকার ওদের নেতা বা ওদের নীতির সমালোচনা করলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ ঘটনাগুলো তো আপানরা দেখছেনই বছরের পর বছর ধরে। উদাহরণ দেওয়ার কিছু নাই।

নীতিটা কী? সরকারের করণীয় কী? আমাদের সরকার কী করছে? এরকম অসহিষ্ণুতা কেন হচ্ছে আমাদের এখানে? আমরা কী করবো?

নীতিটা হচ্ছে যে একজন নাগরিক তার যা ইচ্ছা তাই বলতে পারবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে অপরের ক্ষতি করছে। এটাই চিন্তা ও কথা বলার স্বাধীনতা। এটাই মোটামুটি সকল সভ্য দেশেই অনুসরণ করা হয়। সাফা কবিরের ঘটনাটাই উদাহরণ হিসাবে নিতে পারেন। তিনি যদি মনে করেন যে পরকাল বলে কিছু নাই সেটা তাঁর চিন্তার স্বাধীনতা আর সেটা যদি তিনি লিখে বা বলে প্রকাশ করতে চান বা অন্যকে জানাতে চান সেটা হচ্ছে ওর বাকস্বাধীনতা। আপনারও স্বাধীনতা আছে সেই কথাটিকে সমালোচনা করার, নিন্দা করার বা সেটা নিয়ে হাস্যরস করার। সে আপনার স্বাধীনতা।

কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আপনি যখনই তাঁকে গালি দিচ্ছেন বা হুমকি দিচ্ছেন তখনই আপনি আপনার স্বাধীনতার সীমানা পার হয়ে যাচ্ছেন। আপনি যা ইচ্ছা তাই বলতে পারেন কিন্তু অন্যের ক্ষতি করে নয়। যখনই আপনি তার মানহানি করছেন বা শারীরিক ক্ষতির হুমকি দিচ্ছেন, সেটা তো অন্যের ক্ষতি হয়ে গেল। এনালজি হচ্ছে যে আপনি ইচ্ছামতো মুষ্টি ঘুরাতে পারেন, কিন্তু আপনার সেই স্বাধীনতা সেখানেই শেষ হয়ে যাবে যেখানে আমার নাকের শুরু। আপনি যেখানে ঘুষি সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারে, আপনার ফ্রিডম অব মুভমেন্ট চর্চা করেন, কিন্তু যেখানে আমার দরোজা শুরু সেখানেই আপনার ফ্রিডম অব মুভমেন্ট শেষ।

এটা হচ্ছে না। কেন? একদল লোক কথায় কথায় ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ছে। তাহলে সরকারের করণীয় কী এসব ক্ষেত্রে? আমাদের সরকার কি তার করণীয় কাজটা করছে? সরকারের প্রথম কাজটা তো হচ্ছে পীড়িতকে রক্ষা করা। সাফা কবিরকে যারা হুমকি দিচ্ছে ওদেরকে নিবৃত করা, প্রয়োজনে প্রচলিত আইনে শাস্তির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। এটা তো সরকার করছেই না। দেখা যাচ্ছে যে সরকার পীড়িতকে রক্ষা তো করেই না, উল্টা সরকারই মানুষকে তাদের মতামতের জন্যে পীড়ন করে।

সরকারের আরেকটা কাজ আছে। সেটা দীর্ঘমেয়াদী এবং বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেটা কী? সেটা হচ্ছে বাচ্চাদের স্কুল কলেজে সহিষ্ণুতা শেখানো, মানুষের প্রতি মানুষের সম্মান ও ভালোবাসা শেখানো। এটা যদি সরকার না করে তাহলে অসহিষ্ণুতা দেশ থেকে যাবে না, আমরা একটা সভ্য সমাজ গঠন করতে পারবো না এবং পর্যায়ক্রমে আমরা একটা পশ্চাৎপদ অনগ্রসর জঙ্গি সমাজে পরিণত হবো। এটাতেও সরকার পুরা উল্টা কাজ করছে। শিশু কিশোরদেরকে অসহিষ্ণুতা শেখাচ্ছেন। কীভাবে? আমাদের স্কুলের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার বইগুলো খুলে দেখেন। এসব বইতে বাচ্চাদেরকে শেখানো হয় যে কেবল মাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে একজন মুসলমান সকল অমুসলমানের চেয়ে উত্তম।

এটা তো ঠিক কথা না। কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে আমি আপনার চেয়ে উত্তম হয়ে যাব? বা কেবলমাত্র গায়ের রঙের কারণে একজন আরেকজনের চেয়ে উত্তম হয়ে যাবে? মুসলমানের বাচ্চা হলেই হিন্দুর বা খৃস্টানের বাচ্চার চেয়ে মানুষ হিসাবে ভাল? কেবল ধর্মবিশ্বাসের কারণে আপনি মাদার তেরেসাকে একজন মুসলিম গুণ্ডার চেয়ে উত্তম বলবেন? সেটা তো হয় না। আর যার যার ধর্ম তার তার কাছে প্রিয়, যার যেটা ইচ্ছা অনুসরণ করুক। যাদের ইচ্ছা হয় না ওরা করবে না। একমাত্র এ কারণেই তো আর মানুষ ভাল মন্দ হয় না।

সরকারের তো এটা শেখানো দরকার ছিল ইশকুলে-কলেজে। যে না ভাই, একজন লোক হিন্দু মানেই সে মন্দ হয়ে গেল না। একজন মানুষ তোমার ধর্ম নাও মানতে পারে, তার মানেই এই না যে সে চুরি-ডাকাতি-ধর্ষণ-হাইজ্যাক-রাহাজানি করে। আমাদের সরকার ইশকুলে ঠিক উল্টাটা শেখাচ্ছে- ইসলামে যারা বিশ্বাস করেনা ওরা চোর-ডাকাত-হাইজ্যাকার।

এসব বুনিয়াদি শিক্ষা যদি বাচ্চাদেরকে শেখানো হয়, তাহলে কিন্তু এসব সহিংসতা কমে যায়। অসহিষ্ণুতা কমে যায়। মানুষের প্রতি মানুষের সম্মান শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। এগুলো শেখাবেন না, উল্টা ঘৃণা ও মুসলিম সুপ্রিমেসি শিখিয়ে থাকবেন, তাহলে তো এ অবস্থা হবেই দেশে।

দেখেন, আমি কিন্তু হুজুরদের ওয়াজও বন্ধ করার পক্ষে না। কেউ যদি অন্যদেরকে হুমকি দেয়, মেরে ফেলবো, কেটে ফেলবো বলে বা গালাগালি করতে থাকে সেটা আলাদা কথা। যেমন নাস্তিক হত্যা করা ওয়াজিব হয়ে গেছে এটা তো ফৌজদারি অপরাধ। মানে হচ্ছে অন্যের অধিকার যতক্ষণ খর্ব না করে যে কোন হুজুরের অধিকার আছে যা ইচ্ছা তাই বলা। সরকার তাতে হস্তক্ষেপ করবে কেন? সরকার ওয়াজকারিকে রক্ষা করবে আবার একই সাথে ঐ ওয়াজকারিকে যারা সমালোচনা করবে তাঁদেরকেও রক্ষা করবে। না হলে এটা কীসের গণতন্ত্র আর কীসের সভ্য সমাজ?

সমস্যাটা ওখানেই। সরকার নিজেই বাক ও চিন্তার স্বাধীনতার পক্ষে না। সরকার নিজেই স্কুলে ঘৃণার চাষ করছে। তাহলে আপনি কী করবেন?

ইমতিয়াজ মাহমুদ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ