প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ১৮ এপ্রিল, ২০১৯
দক্ষিণ এশীয় সমাজ ব্যবস্থায় হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় অনুভূতির দ্বন্দ্বে প্রতিদিনই এ অঞ্চলের মানুষের মনে ছোট ছোট ধর্মযুদ্ধ চলে। মসজিদে-মন্দিরে মানুষ উপচে পড়ে; অথচ সমাজে সততা ও ন্যায় বিচারবোধের অভাব বারবারই বিস্মিত করে। মসজিদে নামাজের সময় উচ্চারিত সততার বার্তা, মন্দিরে পূজার সময় উচ্চারিত সততার বার্তা কেবল ঠোঁটে উচ্চারিত; প্রতিদিনের যাপিত জীবনে অনুশীলিত বা চর্চিত নয়। সমাজে হত্যা-ধর্ষণ-দুর্নীতি-লুণ্ঠন-ধর্মের নামে হত্যা সর্বব্যাপী। ধনী-দরিদ্রের অস্বাভাবিক ব্যবধানে পুরো দক্ষিণ এশিয়া মানবতা-বর্জিত নৈতিকতাহীন এক জনপদ।
এতোসব অন্যায়-অবিচারের প্রতিবিধান না করে; ধর্মের নামে ঘৃণা-বিদ্বেষ চর্চা, ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করে ভোটে জেতার মানবঘাতী প্রতিযোগিতা দেখে প্রশ্ন জাগে, ধর্মের সততা ও ন্যায়বিচারের আদর্শ অনুসরণ না করে ধর্মের এ কোন ব্যবহার!
ইউরোপে খ্রিস্টিয় ধর্মচর্চা পর্যবেক্ষণ করে; সমাজে সততা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সতত শুভ প্রচেষ্টা দেখে প্রশ্ন জাগে, মুসলমান ও হিন্দুরা তাদের ধর্ম-চর্চার ক্ষেত্রে কেন কেবল ধর্মের বাণীকে ঠোঁটে রেখে দিলো; ধর্মীয় সততা ও ন্যায়বিচারের আদর্শ কেন হিন্দু-মুসলমানেরা প্রতিদিনের জীবনে প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হলো!
ইউরোপে খ্রিস্ট ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা, যিশু খ্রিস্টের জীবন নিয়ে লেখালেখি, খ্রিস্ট ধর্ম ও যিশু খ্রিস্টের সমালোচনা করা, কার্টুন-ক্যারিকেচারকে স্বাভাবিকভাবে নেয়া হয়। ইউরোপের সমাজ মনে করে, কে সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করে বা করে না; তা ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব বিষয়। 'আপনি কী ধর্মে বিশ্বাস করেন?' এই প্রশ্নটি করা যে অনৈতিক; তা সেখানে প্রতিষ্ঠিত। সাম্প্রতিক সময়ে খ্রিস্টিয় ক্যাথলিক গির্জার দ্বিতীয় প্রধান পোপ খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, মানুষের বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের অধিকার রয়েছে। খ্রিস্টিয় ধর্মীয় নেতার এরকম উদার মনোভঙ্গির কারণে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী।
ধর্মকে যদি সৃষ্টিকর্তার সততা ও ন্যায়বিচারের আদর্শের প্রতি ভালোবাসা ও এই ভালোবাসার টানে সততা ও ন্যায়বিচারের আদর্শ প্রতিদিন অনুশীলন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করি; তাহলে সৃষ্টিকর্তা ও ব্যক্তির মাঝের এই একান্ত ভালোবাসার সম্পর্কে তৃতীয় কারো কর্তৃত্ব চোখে পড়ে না। খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীরা এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারায়; তাদের জীবনে ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে ঘৃণা-বিদ্বেষ-সহিংসতার ব্যাপারগুলো সমসাময়িক সমাজে চোখে পড়ে না। বরং দেখা যায়, সমাজে শান্তি- সততা-ন্যায়বিচার উপস্থিত।
ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তা ও ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব সম্পর্ক নিয়ে তার অনুভূতি ও চেতনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য অসংখ্য ধর্ম-মোড়ল চোখে পড়ে। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সৃষ্টিকর্তার প্রতি কোন ব্যক্তির আস্থার অভাব চোখে পড়লে; তাকে হত্যা করার নৃশংস প্রক্রিয়া চলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। ধর্মীয় অনুভূতি নির্ধারণ করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় কে থাকবে না থাকবে। অথচ সমাজে সততা ও ন্যায়বিচারের অনুশীলন সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত।
সুইডিশ চলচ্চিত্রকার ইংমার বার্গম্যান খৃস্ট ধর্ম ও স্রষ্টার শক্তি নিয়ে বিশ্বাস অবিশ্বাসের অনুসন্ধানে যে ত্রয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন; তার শেষ আখ্যান 'উইন্টার লাইট' ধর্ম-ভাবনার শৈল্পিক স্বাধীনতার এক অনবদ্য প্রচেষ্টা।
এই চলচ্চিত্রে খোদ ধর্ম-যাজক সৃষ্টিকর্তার শক্তি নিয়ে সংশয়ের মাঝে বসবাস করেন। এ কারণে তিনি একজন হতাশ মৎস্যজীবীকে কাউন্সেলিং করতে ব্যর্থ হন। ধর্ম যাজকের মনে হয়, তিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধে যে নৃশংসতা আর প্রাণহানি দেখেছেন;তাতে স্রষ্টার সত্যিই মানুষকে বাঁচানোর শক্তি আছে; তা তিনি ঠিক বিশ্বাস করতে পারেন না।
মৎস্যজীবী ধর্ম-যাজকের কাছে সান্ত্বনা নিতে এসেছিলেন; কিন্তু ধর্ম যাজক তাকে আশা দেখাতে পারেন না। মৎস্যজীবী ধর্ম-যাজকের সঙ্গে দেখা করে ফেরার পথে আত্মহত্যা করেন। ধর্ম যাজক সদ্যপ্রয়াত মৎস্যজীবীর স্ত্রীকে মৃতের আত্মার শান্তির জন্য বাইবেল পাঠের প্রস্তাব দিলে; এ ব্যাপারে সে আগ্রহ দেখায় না। সে বরং ভাবতে থাকে সন্তানদের নিয়ে সামনের কঠিন দিনগুলো কীভাবে পার করবে সে কথা।
ধর্মযাজকের প্রেমিকা একজন স্কুল শিক্ষক। তিনি চার্চের ধর্মীয় কৃত্যে অংশ নিতে আসেন। কিন্তু সে অংশগ্রহণের মাঝে স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার চেয়ে ধর্মযাজকের প্রতি ভালোবাসা বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
ধর্মযাজকের কাছে লেখা চিঠিতে তার প্রেমিকা উল্লেখ করে, তার হাতে যখন ফাংগাল ইনফেকশন জনিত ঘা হয়েছিলো; তখন স্রষ্টার ও তার প্রচারক ধর্মযাজকের ভালোবাসা সে পায়নি। বরং তার পরিবারের মানুষদের ভালবাসার শক্তিতে তার হাতের ক্ষত সেরেছে ।
ধর্মযাজক তার প্রেমিকাকে ভালোবাসতে ব্যর্থ হন; অথচ প্রেমিকা তাকে অকুণ্ঠভাবে ভালোবাসেন। খুব মন্থর এই কমেডি চলচ্চিত্রে গির্জার নিষ্প্রাণ ধর্ম-কৃত্যকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে; যেখানে স্রষ্টার ভালোবাসার কথা ধর্মযাজক বলেন; যা কেবল তার ঠোঁটে থেকে যায়। নিজের প্রেমিকাকে যিনি ভালোবাসতে পারেন না তার মুখে ভালোবাসার কথা মানাবে কেন।
কেউ কেউ ধর্ম-যাজকের প্রেমিকাকে এ নিষ্ফল ভালোবাসার পথ থেকে সরে আসার পরামর্শ রাখে।
উইন্টার লাইট চলচ্চিত্রে এই যে একজন সংশয়াপন্ন ধর্মযাজককে দেখানো হয়; তিনি স্রষ্টা ও প্রেমিকাকে ভালোবাসতে ব্যর্থ হলেও আরেকটি চার্চের ধর্ম-কৃত্য পরিচালনা করতে যান। শেষ পর্যন্ত তিনি ঈশ্বরের ভালোবাসা ও ন্যায়বিচারের বার্তা প্রচারের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
এই চলচ্চিত্রে ঈশ্বরের শক্তি ও ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের বিষয়টিকে সাদা-কালো বা হ্যাঁ-না আঙ্গিকে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়নি। এর মাঝের সংশয়ের চিন্তাভ্রমণকে দেখানো হয়েছে।
প্রশ্নহীনতা মানেই স্থবিরতা-প্রশ্ন শেষ হয়ে যাওয়া মানেই মৃত্যু। ধর্ম যাজকের আলোচনাকে স্রষ্টার শক্তির প্রতি অনাস্থা মানে সাদা-কালোর মাঝে কালো আর হ্যাঁ-না'র মাঝে না ধরে নিয়ে মৎস্যজীবী আত্মহত্যা করে।
অথচ ধর্ম-যাজক প্রশ্নের ভ্রমণে বেঁচে থাকেন। তার প্রেমিকা তার ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হয়েও ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষায় আবার আরেকটি চার্চের ধর্মকৃত্যে অংশ নেন।
ধর্ম-দর্শন নিয়ে এমন প্রশ্নের স্বাধীনতা খৃস্ট ধর্মকে আজো পৃথিবীর সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের অনুসৃত ধর্ম হিসেবে টিকিয়ে রেখেছে। এ যেন এমন একটি বিদ্যালয় যেখানে মুক্তভাবে চিন্তা ও প্রশ্ন করার অধিকার ও সুযোগ ছাত্রদের রয়েছে। সহমত ও ভিন্নমত হবার ইচ্ছার স্বাধীনতা রয়েছে।
অথচ ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের দক্ষিণ এশীয় ম্যানেজাররা ধর্ম-দর্শনকে করে রেখেছে এক প্রশ্নহীন কড়া বিদ্যালয়; যেখানে উত্তর দিতে হবে সাদা-কালো বা হ্যাঁ-না'র ভিত্তিতে। উত্তর সাদা বা হ্যাঁ বলে সহমত হলে বেঁচে থাকো; কালো বা না বলে ভিন্নমত হলেই কল্লা নামিয়ে দেয়া বা পিটিয়ে হত্যা। ধর্ম যদি স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা হয়; তাহলে তা এমন নিষ্ঠুরভাবে অনুশীলিত হতে পারে না।
সততা, উদারতা, ভালোবাসা, ন্যায়বিচার; এগুলো ধর্মের গোড়ার কথা। ধর্মকে মুক্তভাবে চর্চার আর নিরন্তর প্রশ্নের ভ্রমণের গতিতেই বিকশিত হয় জীবন। প্রশ্নই হচ্ছে জগতের প্রাণপ্রবাহ। আর প্রশ্নহীনতা মানেই মৃত্যু। এই সহজ বিষয়টি একটু একটু করে বুঝতে শেখার মাঝেই রয়েছে ধর্ম ও নৈতিকতার বিকাশ ও চর্চার সম্ভাবনাগুলো।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য