প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আলমগীর শাহরিয়ার | ১৬ মে, ২০১৯
ভারতে লোকসভা নির্বাচন চলছে। নির্বাচনী এই ডামাডোলে কলকাতায় বিজেপির উগ্রবাদীরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙ্গেছে খোদ বিদ্যাসাগর কলেজে ঢুকে। কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিদ্যাসাগর নিজেই। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা শুধু উপমহাদেশের উগ্রবাদী রাজনীতিরই বহিঃপ্রকাশ নয়, অসীম মূর্খতা ও দিনতারও প্রকাশ। এর আগেও নকশালপন্থীরা একই কাজ করত। এক সময় শিক্ষিত বাঙালির ঘরে ঘরে তীর্থস্থানের ছবির মতো টানানো থাকতো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছবি। বাঙালির জাগরণে, বিকাশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরে ভূমিকা অতুলনীয়। বিশেষ করে নারীদের দুর্গতির যুগে তিনি নেমেছিলেন উদ্ধারকর্তার ভূমিকায়। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে বিধবা বিবাহ চালু করেছিলেন, রোধ করেছিলেন বহু বিবাহ। নারীর জন্য সে আমলে ৩৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। জাত ধর্ম, বর্ণ প্রথা ও সংস্কারমুক্ত এক বিশ্ববিক্ষা ধারণ করে ঈশ্বরচন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির সর্বকালের অন্যতম বড় সমাজ সংস্কারক।
বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন খুব প্রণিধানযোগ্য, “বিশ্বকর্মা যেখানে চার কোটি বাঙালি নির্মাণ করিতেছিলেন সেখানে হঠাৎ দু একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন, তাহা বলা কঠিন।” কোটি বাঙালির মুগ্ধ জননীকে যিনি প্রশ্ন করেছিলেন রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে বাঙালির দু’একজন দুর্লভ মানুষের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অন্যতম।
যার কর্মস্পৃহা ছিল অতুলনীয়। নিজ কাজের প্রতি সম্মানবোধ ছিল সবসময় অটুট। এমনকি নিজের সাধারণ কোন কাজকেও তিনি অবহেলার চোখে দেখতেন না। একবার জনৈক ডাক্তার বাবু রেলওয়ে স্টেশনে নামলেন। নেমে ‘কুলি’ ‘কুলি’ বলে চিৎকার করতে লাগলেন। একজন এগিয়ে এলেন ডাক্তার বাবুকে সাহায্য করতে। লেখক বর্ণনা করছেন যিনি এগিয়ে এলেন তার পরনে ধুতি, গায়ে মোটা চাদর। পায়ে সামান্য চটি। কুলি এসেছে ভেবে ডাক্তার তাঁর হাতে ব্যাগ তুলে দিলেন। লোকটাও ব্যাগটা নিয়ে স্টেশনের বাইরে দাঁড়ানো ডাক্তার বাবুর পাল্কিতে পৌঁছে দিল।
ডাক্তার তাকে দুটি পয়সা দিতে হাত বাড়ালেন। লোকটা বলল, না না, পয়সা দিতে হবে না, আপনি এতো ছোট ব্যাগ নিয়ে এত বড় বিপদে পড়েছিলেন দেখে আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছি।’ - পয়সা দিতে হবে না, তুমি কেমন কুলি হে?
আমি ঠিক কুলি নই। - তাহলে কে? আমি ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা। লোকে অবশ্য বিদ্যাসাগর বলেও ডাকে। জেনে শরমে মরমে মরে যান আরকি ডাক্তার। পায়ে পড়ে বলেন, এরপর থেকে আমি নিজের কাজ নিজেই করব। এভাবেই একজন আলাদা গড়নের, বৈশিষ্ট্যের বাঙালি চিন্তার অচলায়তন ভেঙ্গে পথ দেখান আরেক শিক্ষিত কিন্তু চিন্তায় সংকুচিত ও অবিকশিত বাঙালিকে।
ঊনবিংশ শতকে জন্ম নেওয়া ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাঙালির গৌরব। তিনি তাঁর স্বজাতির পশ্চাৎপদতা নিয়ে ভাবতেন। ভাবতেন উত্তরণের পথ নিয়েও। তাই বাঙালির প্রথম শিক্ষক প্রশিক্ষণশালাও খুলেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এর নেপথ্যের গল্পটি খুবই মজার এবং এখনও এই গল্পটির প্রাসঙ্গিকতা ফুরোয়নি। স্কুল পরিদর্শক হিসেবে বিদ্যাসাগর গেছেন গ্রামের এক স্কুলে। ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে দেখলেন, ছেলেরা বাংলা আর অঙ্ক ভালোই শিখেছে। এবার তিনি উঁচু ক্লাসের ছেলেদের জিজ্ঞেস করলেন, পৃথিবীর গতি কয় রকম? দিন-রাত্রি কেন হয়?
ছেলেরা জবাব দিল, ‘পৃথিবীর কোন গতি নেই। পৃথিবী স্থির। সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। তাই দিন আর রাত হয়।’ সব ছেলে একই জবাব দিচ্ছে। বিদ্যাসাগর তখন পণ্ডিত মশাইয়ের দিকে তাকালেন। আপনি কী বলেন পণ্ডিত মশাই ? পৃথিবী ঘুরছে নাকি স্থির হয়ে আছে ?
পণ্ডিত মশায় জবাব দিলেন, পৃথিবী তো স্থিরই দেখছি। ও আবার ঘুরছে কবে থেকে? না, বিদ্যাসাগর বললেন, দুরকম গতি আছে পৃথিবীর, আহ্নিক গতি আর বার্ষিক গতি, নিজের মেরুপথে পৃথিবী ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘোরে, তাই দিন আর রাত হয়, এটা আহ্নিক গতি, আর সূর্যের চারপাশে পৃথিবী বছরে একবার ঘুরে আসে, তাই পৃথিবীতে ঋতুবদল হয়। পণ্ডিত মশায় শুনে বললেন, তা ঘুরুক না পৃথিবী। আমি তো তাকে বাঁধা দিতে যাচ্ছি না। পৃথিবীর ঘোরাঘুরি নিয়ে কে মাথা ঘামায়। পণ্ডিত মশায় নিজেই যদি ভুল জানেন, ভুক ব্যাখ্যা দেন তাহলে তিনি ছাত্রদের শেখাবেন কী? বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে সংস্কৃত কলেজেই খোলা হলো শিক্ষকদের প্রশিক্ষণশালা। প্রশিক্ষণ ছাড়া জ্ঞানের যথাযথ প্রয়োগ ত্রুটিপূর্ণ থেকে যায় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অনেক আগে।
অপ্রিয় হলেও সত্য, ব্রিটিশ শাসনের প্রথমার্ধে ভারতবর্ষে অধিকাংশ যখন ব্যস্ত ছিলেন সুযোগ-সুবিধা আদায়ে শ্বেতাঙ্গ সেবায় বা পাচাটায় তখন একজন বাঙালির প্রখর ব্যক্তিত্ববোধ ও তেজের পরিচয়ও পাওয়া যায়। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। হিন্দু কলেজের তখন বেশ নামডাক। ওই সময় কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন কার সাহেব। একদিন কোনো এক প্রয়োজনে বিদ্যাসাগর গেছেন কার সাহেবের চেম্বারে, তার সঙ্গে দেখা করতে। কার সাহেব বিদ্যাসাগরকে বসতে বললেন না। তিনি চেয়ারে বসে ছিলেন টেবিলের ওপরে জুতোসহ দুই পা তুলে দিয়ে। তেমনি বসে রইলেন। বিদ্যাসাগর কাজ শেষ করে ফিরে এলেন। কিন্তু তার মনে ঠিকই বাজল এই ভীষণ অপমানটা।
বিদ্যাসাগর তখন পড়ান সংস্কৃত কলেজে। কার সাহেব কী একটা কাজে এলেন বিদ্যাসাগরের কক্ষে তার সঙ্গে দেখা করতে। চমৎকার সুযোগ। বিদ্যাসাগর চটি জুতোসমেত দুই পা তুলে দিলেন টেবিলের ওপরে। কার সাহেব কি জন্যে এসেছেন জানতে চেয়ে তার জবাব দিলেন। এতে কার সাহেব খুবই অপমানিত বোধ করলেন। ফিরে গিয়ে বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন সরকারের শিক্ষা পরিষদের সেক্রেটারি ময়েট সাহেবের কাছে। ময়েট সাহেব বিদ্যাসাগরের কাছে কৈফিয়ত তলব করলেন। বিদ্যাসাগর জবাব দিলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, আমরা অসভ্য, সাহেবেরা সভ্য, সাহেবদের কাছেই আমাদের সভ্যতা শেখা উচিত। কার সাহেবের কক্ষেও আমি গিয়েছিলাম, তিনি আমাকে যেভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, আমি ভেবেছিলাম সেইটাই অভ্যর্থনা জানানোর রীতি, কাজেই তিনি যখন আমার কক্ষে এলেন, ঠিক একই রকমভাবে আমি তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছি। এ জন্য যদি আমার কোন অপরাধ হয় সেজন্য কার সাহেবই দায়ী।’ বিদ্যাসাগরের কথায় ময়েট সাহেব সন্তুষ্ট হলেন। এবং বিষয়টা মীমাংসা করে নেবার জন্য কার সাহেবকে বললেন।
ঈশ্বরচন্দ্রের অন্যতম কীর্তি বিধবা বিবাহ চালু। বিধবা বিবাহ নিয়ে তিনি শুধু আন্দোলন করে থেমে থাকেন নি, নিজের সন্তান নারায়ণকে দিয়ে বিধবা কন্যাকে বিয়ে করিয়ে দৃষ্টান্তও স্থাপন করান।
স্বজনপ্রীতিতে অদ্বিতীয় বাঙালির জন্য এ গল্পটিও বেশ শিক্ষণীয়। একবার নিজের পুরস্কার হিসেবে পাওয়া ৪০০ টাকা নিজে ভোগ না করে চার বছরের জন্য প্রতি বছর ৫০টাকা করে মেধাবীদের জন্য একটি পুরস্কার চালু করেন। প্রতিযোগিতায় নিজের ভাই দ্বীনবন্ধু উত্তীর্ণ হলেও তাকে পুরস্কার দিলেন না। দিলেন শ্রীশচন্দ্র নামের যে দ্বিতীয় হয়েছিল–তাকে। কেননা অন্যরা ভাবতে পারে বিচারককে হিসেবে তিনি ভাইয়ের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে থাকতে পারেন। এই ছিলেন বিদ্যাসাগর।
১৮০০ সালের পূর্বে বাংলা গদ্য বলতে কিছু ছিল না। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে কেন্দ্র করে যে বাংলা গদ্যের বিকাশ ঘটল তাঁর অন্যতম কারিগর বিদ্যাসাগর। বর্ণ পরিচয়সহ ৫০টির অধিক মৌলিক, অনুবাদ, পাঠ্যবই, ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, বিদ্যাসাগরের প্রধান কীর্তি হলো বাংলাভাষা। বাংলা ভাষার তিনি যথার্থ শিল্পী ছিলেন। যতিচিহ্নের ব্যবহার করে তিনিই ভাষাকে প্রথম সুশৃঙ্খল একটি রূপ দেন।
মাইকেল মধুসূদনের মত বাঙালির প্রথম বিদ্রোহী শিল্পীসত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যও একজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মহানুভবতা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ফরাসী দেশে চরম অর্থকষ্টে ভোগা মাইকেল তাঁর দুর্দিনে একজন ঈশ্বরচন্দ্রকে সম্বোধন করেছিলেন এভাবে, যার জ্ঞান আর প্রতিভা প্রাচীন ঋষির মত, উদ্যম একজন ইংরেজের মত, আর হৃদয়টা একজন বাঙালি মায়ের।
আগামী বছরই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী উৎসব পালন হবে। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে ৬০ মাইল দূরে বর্তমান মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে দাদুর ভাষায় জন্ম নিয়েছিল যে ‘এঁড়ে বাছুর’ সেই একদিন শ্রেষ্ঠ বাঙালির আসন লাভ করবে। জন্মের দুশো বছর কেটে গেলেও তাঁর অগ্রসর চিন্তা ভাবনা, উদ্যমশীল কর্ম অনুপ্রেরণা বাঙালির বিকাশে এখনও সমান প্রাসঙ্গিক এবং বাতিঘরসম। বিদ্যাসাগর বাঙালির মহত্তম প্রতিভা।
(লেখায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ঘটনাসমূহ আনিসুল হকের লেখা ‘ছোটদের বিদ্যাসাগর’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া)
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য