আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

রবীন্দ্রনাথ ও আমাদের উন্নয়ন-অন্ধকার

আলমগীর শাহরিয়ার  

উপমহাদেশের প্রথম সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনটি ছাত্রাবাসের একটি ছিল জগন্নাথ হল। অন্য দুটি সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হল ও ঢাকা হল (পরবর্তীতে নামকরণ হয় শহীদুল্লাহ হল)। ধীরে ধীরে এ সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে আবাসিক হল সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯টিতে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া প্রায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর নিজ আবাসিক হলের বাইরে যে হলে সবচেয়ে বেশি বিচরণ করে থাকেন সেটা জগন্নাথ হল। নামে একটা সুনির্দিষ্ট ধর্মপরিচয়ের শোনালেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক হলের নাম জগন্নাথ হল। যদিও বিশেষ সম্প্রদায়সমূহের জন্য সংরক্ষিত হিসেবে হলটির যাত্রা শুরু হয়।

পূর্ববঙ্গে শিক্ষা উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখা ঢাকার বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল চৌধুরীর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে এই হলের নামকরণ করা হয়েছিল। অন্য হলগুলো সাম্প্রদায়িক বিষয়টা ঠিক তা নয়। কিন্তু উৎসবে, উদযাপনে, আপ্যায়নে - ক্যাম্পাসে জগন্নাথ হলের মতো এমন সর্বজনীন সহাবস্থান অন্য কোথাও চোখে পড়ে না।

হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পাহাড়ি, সমতল- সকল শিক্ষার্থীর দেখা মেলে সেখানে। অদূরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির আর উপাসনালয়ের পাশে ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের বিশাল মূর্তি আছে নির্বিবাদে সবুজ স্নেহভরা বৃক্ষচ্ছায়ায়। আছে ভারতীয় অতীন্দ্রি়য়বাদী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দের বিশাল ভাস্কর্য। অলিখিতভাবে অবস্থান করা মুসলমান ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীর সংখ্যাও এ হলে নেহাত কম নয়।

জগন্নাথ হলের খেলার মাঠের ঠিক দক্ষিণে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শোকস্মৃতি বয়ে বেড়ানো অক্টোবর ভবনের উল্টো পাশে সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের নামে একটি ভবন ছিল। সবাই ‘ইস্ট বিল্ডিং’ বলে ডাকত। সেই ভবনটা জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠায় বেশ আগে ভেঙে ফেলা হয়। কোন স্থাপনার সঙ্গে মানুষের আবেগ, অনুভূতি, স্মৃতি জড়িয়ে থাকে।

ওই ভবনে আমরা উত্তর দিকের হলগুলো থেকে ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ারে খুব যেতাম। অনেক বন্ধু-বান্ধব তখন ওই ভবনের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন। কখনও কখনও বিকেল বেলা ওই ভবনের ছাদে উঠে উত্তরে ঢাকা শহরে দুর্লভ বিস্তীর্ণ সবুজের দিকে তাকাতাম। উদাস হাওয়ায় কেউ কখনও প্রাণ খুলে গাইত রাধারমণ, হাসন, লালন, দুর্বিন।

ভবনটি ব্যবহার অনুপযোগী ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাওয়ায় অনেকদিন পরিত্যক্ত ছিল। তারপর ভেঙে ফেলা হয়। খালি মাঠ হিসেবে অনেকদিন পড়ে ছিল। সেদিন ঘুরতে গিয়ে দেখলাম সেখানে নতুন একটি ভবন উঠছে। নির্মাণাধীন এলাকা টিন দিয়ে ঘেরা। কাজ চলছে। নাম রবীন্দ্র ভবন।

খুব যৌক্তিকভাবেই রবীন্দ্রনাথের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বতন্ত্র একটি হল করা যেত (করা যেত জাতীয় কবি নজরুলের নামেও)। তা না করে হলের ভেতরে একটি ভবন করা হচ্ছে বাংলা ভাষার সবচেয়ে উজ্জ্বল গৌরব, সূর্যালোকের মত যার দীপ্তি - সেই রবীন্দ্রনাথের নামে। তাও জগন্নাথ হলের ভেতর রবীন্দ্রনাথের ধর্ম পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে।

যেহেতু হলটি বিশেষ সম্প্রদায়সমূহের জন্য নির্মিত ছিল। রবীন্দ্রনাথ কী শুধু বিশেষ কোন সম্প্রদায়ের? নাকি তাঁর বিপুল সৃষ্টিসম্ভার গোটা মানবজাতির সম্পদ? রবীন্দ্রনাথকে কী এখনও আমরা সাম্প্রদায়িক ভেদ-বুদ্ধির বাইরে বিবেচনা করতে পারি না ! এ বড় লজ্জার। সে লজ্জা কী আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পাচ্ছে? নাকি সে বোধও উবে গেছে?

পাকিস্তান আমলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীরাই তো রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার পাক পায়তারা রুখে দিয়েছিলেন। তারাই তো এক সময় ভাষার প্রশ্নে গড়ে উঠা অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার অগ্নিস্ফুলিঙ্গে স্বাধিকার আন্দোলনের রাজপথ মিছিলে মুখর করে তুলেছিলেন। স্মরণ করা যেতে পারে, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ তার স্বৈরজমানায় মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের নামে একটি আবাসিক হল বানান।

ঠিক তার অদূরে একটু পাশ ঘেঁষে আড়ালে আবডালে চক্ষুলজ্জায় জাতির জনকের নামেও - শেখ মুজিবুর রহমান হল (লক্ষ্য করার বিষয়, হলের নামের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শব্দটি যুক্ত নেই, জাতির জনক নেই) নামে- একটি হল নির্মাণ করেন (এবং ডাকা হত মুজিব হল বলে)। ধর্ম নিরপেক্ষ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় সেসময়েও অবহেলার নতুন মোড়কে নামকরণের রাজনীতিতে রবীন্দ্রনাথের দশাও কি আজ তাই!

সরকারের ধারাবাহিকতায় দেশে বেশ কিছু দৃশ্যমান ও পরিসংখ্যানগত উন্নয়ন অগ্রগতি নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। সন্দেহ আছে গুণগত, টেকসই উন্নয়ন ও পরিবর্তন নিয়ে। জাতির সামগ্রিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির মান নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের মতো অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী ও বিশ্ববরেণ্য লেখককে গৌণ করে যদি হয় আমাদের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের উন্নয়ন, তাহলে এই নয়া ডেভেলপমেন্ট প্যারাডক্সকে —এক ধরনের উন্নয়ন অন্ধকার বলেই বিভ্রম জাগে।

যেদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে সাহিত্যের ছাত্রী, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সমঝদার, পিতা বঙ্গবন্ধুর মত গভীর রবীন্দ্র অনুরাগী, সর্বোপরি যে দেশের মুক্তি সংগ্রামের নেপথ্যে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা অপরিসীম-সেদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে একটি হলের ভেতর রবীন্দ্র ভবনের নামে—এমন রবীন্দ্র অবহেলা পীড়াদায়ক বৈকি। গীতাঞ্জলীর শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে বড় জোর ভবনটির নাম ‘গীতাঞ্জলী ভবন’ হতে পারে।

এমন প্রস্তাব জগন্নাথ হল সংশ্লিষ্ট বাংলা বিভাগের একজন শিক্ষকও করেছেন। কোনভাবেই রবীন্দ্রনাথের নামে নয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়ই বলি, ‘এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু।’ একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের নামে একটি পূর্ণাঙ্গ নতুন হল নির্মাণের দাবি জানাই। সেটা হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে রবীন্দ্রনাথের মত মহান শিল্পস্রষ্টার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা।

আলমগীর শাহরিয়ার, কবি ও প্রাবন্ধিক। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ