আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

রাজনীতি থেকে সৈয়দ আশরাফের সততা ও শিষ্টতার বিদায়

মাসকাওয়াথ আহসান  

বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুলের ছেলে সৈয়দ আশরাফ। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকায় মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারে বঙ্গবন্ধুর শূণ্যতা পূরণ করেছিলেন সৈয়দ নজরুল। এক-এগারো সেনা সমর্থিত সরকার আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করলে সৈয়দ আশরাফ উনার শূণ্যতা পূরণ করেছিলেন। রাজনীতিতে দুই প্রজন্মে এমন অকৃত্রিম বন্ধু পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়।



সৈয়দ আশরাফ সম্যক শিক্ষিত ও প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা। প্রধানমন্ত্রী যে ওয়েস্টমিনস্টার সরকার পদ্ধতির কথা বলেন, সেটিকে সৈয়দ আশরাফ অনাবাসে বসবাসকালে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ফলে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মন্ত্রীর কর্ম-পরিসীমা ও নৈতিকতা সম্পর্কে সবচেয়ে জ্ঞাত ব্যক্তিটি তিনিই।



এই যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে মন্ত্রীর বাড়ীর বারান্দায় নানা ধান্দা নিয়ে কিছু মোটা-সোটা ডাকাত প্রকৃতির লোক বসে থাকা, তাদের নানান ধান্দার দরখাস্তে সুপারিশ প্রদানের যে কুসংস্কৃতি; তাতে সৈয়দ আশরাফের অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করা অনুচিত।



বাংলাদেশে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নিরংকুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে কেবল নিজের দল ও জামাত-সঞ্জাত মেয়রদের একটু বেশী সুযোগ সুবিধা দিয়ে প্রতিপক্ষের মেয়রদের বঞ্চিত করতে খুব পছন্দ করে। আবার স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা খর্ব করতে গতানুগতিক ভাবনার যেসব সাংসদরা খুব আগ্রহী; তাদের সঙ্গে তাল দিয়ে যাওয়াই স্থানীয় সরকার মন্ত্রীদের কাজ। এই ভিলেজ পলিটিক্সে সৈয়দ আশরাফ ছিলেন না।



আধুনিক গণতন্ত্রে মন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়া মানে দলের নয়, জনগণের নেতা হওয়া এবং সব দলের স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের সমান প্রাধিকার নিশ্চিত করাই মন্ত্রীর কাজ; এই সহজ সভ্য সংস্কৃতি সৈয়দ আশরাফের জানা।



পরিমিতিবোধের সঙ্গে ও শিষ্টতা বজায় রেখে দায়িত্ব পালন সৈয়দ আশরাফের পারিবারিক ঐতিহ্য। এই পরিবারটি রাজনীতি থেকে কিছু নিতে আসেননি, আজকের অপরাজনৈতিক শিশু গড ফাদারদের মত গ্যাং পুষে চাঁদাবাজি করা বা লোকজনকে ভয়ভীতি প্রদর্শন সৈয়দ আশরাফের কাছে অপরিচিত এক কালো-সংস্কৃতি। ফলে রাজনীতিকে যারা ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে; তাদের কাছে সৈয়দ আশরাফ পথের বাধা। সুতরাং পথের বাধা সরিয়ে নিন; গ্যাং-গুলোকে মোটাতাজা হতে দিন। সৈয়দ আশরাফ এখন দপ্তরবিহীন মন্ত্রী।



মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু যেদিন বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পা রাখলেন, সেদিন বিমান বন্দরে তিন-চারজন ততকালীন গ্যাং লিডার (মুশতাকসহ) বঙ্গবন্ধুর কানের কাছে ফিসফিস করে বলেন, তাজউদ্দীন বেশী কড়া লোক; কর্মীরা আশাহত, পথের বাধা সরিয়ে নিন। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাহত একটি দেশে নানা ষড়যন্ত্রের মাঝে খুবই বিপন্ন বোধ করছিলেন।



বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে কিছু ঋণ জরুরী ছিলো। তাজউদ্দীন একরোখা মানুষ; উনি আত্মনির্ভর উন্নয়ন কৌশলে আগ্রহী ছিলেন। এই দ্বৈতদ্বন্দ্বের মাঝে মুশতাক অতিশয় আনুগত্যমলিন ভক্তিনেত্রে বঙ্গবন্ধুকে প্রতিদিন নিয়ম করে ‘কানপড়া’ দিয়ে যেতেন। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে কানপড়া এক সফল মন্ত্রের নাম। ফলে সরে যেতে হয় তাজউদ্দীনকে; এই যে আজ যেমন সৈয়দ আশরাফ সরে গেলেন। ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নেয়া যে আমাদের ধাঁতে নেই।



সৈয়দ আশরাফের দিন শুরু হয় অনেক ভোরে। প্রথমেই উনি অনলাইন পত্রিকাগুলোতে চোখ বুলিয়ে নেন। উনার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত রিপোর্টের ক্লিপিংস ফাইলের জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। দেখে নেন মিডিয়ায় দল সম্পর্কিত আর কী গুজব আছে, পশ্চিমা মানবাধিকার ও নৈতিকতার দোকানীদের খেলাধূলার গতি প্রকৃতিও দেখে নেন। কারণ মিডিয়া আর পশ্চিমা শক্তির এক্কা দোক্কা খেলাটি সম্পর্কে উনি যথেষ্ট জানেন। সে কারণেই টকশোতে বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন, অপসাংবাদিকতা এবং নোবেল পুরস্কার বাগিয়ে পশ্চিমা মদদে ক্ষমতায় বসে যাবার সাপলুডু খেলা সম্পর্কে তিনিই বারবার জাতিকে সাবধান করেছেন।



এরপর উনি বাসায় বসেই মন্ত্রণালয়ের ফাইল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়গুলো অনেকটা হাসপাতালের মত; সেখানে আসে সুপারিশের রোগীরা; আর অসহায় মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছক্কা-পাঞ্জা খেলে কেরানী চিকিতসকেরা। কিছুক্ষণ পরপর একজন সুপারিশকারী্র আগমন, বা কেরানীর তৈল-সঞ্চালন, অথবা কোন উতস্যুক সাংবাদিকের প্রশ্ন, আপনার অনুভূতি কী? চিড়ির বন্দরে ছয়জন টি আর কাবিখার সাহায্য পায়নি, মেরে দিয়েছে সরকারী গ্যাং; অথচ আপনাকে এতো ফ্রেশ দেখাচ্ছে কেন?



এই চিড়িয়াখানা বা হাসপাতাল; যাকে আমরা সচিবালয় বলি; সেখানে সৈয়দ আশরাফ কম সময় দিয়ে বরং হোম অফিসে মনোযোগ দিয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু অত্র অঞ্চলে এভাবে কাজ হয়না। কাজ মানেই টিভি ক্যামেরা নিয়ে তোমাদের পাশে এসে বিপদের বাঁশী হতে হয়, সাংবাদিককে সন্দেশ খাইয়ে খেজুরে আলাপ গড়তে হয়; এরপর আবেগে কলাম লিখে ফেলে সন্দেশ প্রিয়, আশরাফ ভাইয়া কাজ-পাগল মানুষ; উনাকে দিয়েই হবে, উনিই পারবেন।



সুপারিশ করে দলীয় অকর্মাদের চাকরী পাইয়ে দেয়া আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আরেকটি কদাচার। সৈয়দ আশরাফ স্বজনপ্রীতির লোক নন; যোগ্যতাই তাঁর কাছে চাকরী প্রাপ্তির একমাত্র মাপকাঠি। ফলে আশাহত গ্যাং-এরা আশরাফ ভাই বেশী ঘুমান, কাজে মন নাই ইত্যাদি নালিশ দেয় কুসুমকলি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকার কাছে।



একটা মিথ্যা কথা কয়েকশোবার বললেই সত্যি হয়ে যায় গ্রামাঞ্চলে। সুতরাং উনি এখন দপ্তর বিহীন মন্ত্রী। অথচ এই সৈয়দ আশরাফ মন্ত্রীত্বে এসে উনার ব্যক্তিগত সম্পদ কমেছে। বেতনের বাইরে একটি পয়সা, একটি সুবিধা নেয়া উনার জীনে নেই, পারিবারিক শিক্ষায় নেই। অথচ মন্ত্রী হলে স্বাভাবিকভাবেই কিছু হাই প্রোফাইল অতিথি আপ্যায়ন করতে হয়। একে বলা হয় নেটওয়ার্কিং। এটা অন্যেরা নিজেদের জন্য করে; সৈয়দ আশরাফ করেছেন দেশের জন্য। ফলে বেতনের অর্থে কুলায়নি; ব্যক্তিগত সঞ্চয়ে হাত পড়েছে। তবে দক্ষিণ এশিয়া তন্ন তন্ন করে খুঁজে আজকের এই অন্ধকার যুগে সৈয়দ আশরাফের মত সৎ মন্ত্রী পাওয়া যাবে না; এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।



কারণ ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক-তম সব স্থানীয় সরকার মন্ত্রীরা গড়েছে টাকার পাহাড়। যে কারণে ভারতে কংগ্রেস ও পাকিস্তানে পিপলস পার্টি ক্ষমতাচ্যুত। বর্তমানে উভয় রাষ্ট্রের মৌলবাদী সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রীরাও সম্পদের এভারেস্ট ও কে-টু গড়তে ব্যস্ত। সৈয়দ আশরাফ অন্ধকার অরণ্যে সততার দ্যুতি হয়ে রয়ে গেলেন আমাদের মানসপটে।



সব হেরে যাওয়াই হেরে যাওয়া নয়। কখনো কখনো হেরে যাওয়াই জিতে যাওয়া। আর সৈয়দ আশরাফতো জীবনকে কোন রেসই মনে করেননি।তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায়-টকশোতে-শোবিজে আইকন খুঁজে কী লাভ?



সততা আর শিষ্টতার অনিবার্য আইকন সৈয়দ আশরাফ। হোক এখন কাজ করছি কাজ করছি কাজ দেখানোর ছাগল নাইয়া থিয়েটার। নিভৃতে অন্তর্মুখিতার নৈঃশব্দে কাজ আজকের পলিটিক্যাল গ্যাং-বাজারে অচল। সার্বিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক নিমজ্জনের সময়ে এই বেশ ভালো। পচা ডিম বিক্রী বা পচা ডিম দিয়ে উন্নয়নের পাউরুটি তৈরীর এই সার্কাসে জোকারেরাই নাকে লাল বল লাগিয়ে নৃত্য করুক।



আলোর মানুষ সৈয়দ আশরাফ থাকুন তাঁর শূচিতার জগতে; শতায়ূ হোন; আমার চোখে আপনি একজন ‘দার্শনিক রাজা’।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ