আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

আজব গুজবের ঘোড়ায় সওয়ার বাংলাদেশ

জুয়েল রাজ  

আজব এক সময় যাচ্ছে আমাদের। গুজবে আর ভাইরালে সয়লাব চারপাশ। এবং অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, সেই গুজব গুলো আমরা বিশ্বাস করছি। এবং প্রচার করছি অনবরত।

সিলেটের একটি প্রাইমারী স্কুলের ঘটনা, হঠাৎ করেই, পদ্মাসেতুর কল্লা কাটার গুজব যখন চারদিকে রমরমা অবস্থা! স্কুলে শিক্ষার্থীদের মা'দের সংখ্যা বেড়ে যায়। এবং সেটাই স্বাভাবিক। সন্তানদের জীবনের প্রশ্ন যেখানে, সেখানে এই দায়িত্বশীল হওয়াই স্বাভাবিক।

চারদিকে শুধু গুজব এইখান থেকে দুইজন ঐখান থেকে ৪ জনকে ছেলেধরা নিয়ে গেছে। ঐ স্কুলে ছেলেধরা ধরা পড়েছে। সেই সময় এক স্কুলে এলাকার প্রধান শিক্ষকদের একটা মিটিং হয়। ঠিক সেইদিনই স্কুলের এক শিক্ষিকার ভাইয়ের ছোট একটা ছেলে মারা যায়। সেই সংবাদে শিক্ষিকা কান্না করছিলেন। স্কুল থেকে কান্না করেই ফিরছিলেন। তো এই ঘটনার হলো, শেখ হাসিনা এক লাখ কল্লা চেয়েছে। প্রত্যেক স্কুল থেকে ১০ টা করে শিশুর কল্লা দিতে হবে। যার জন্য এলাকার সব প্রধান শিক্ষকরা মিটিং এ বসেছিলেন। ঐ শিক্ষিকা প্রস্তাবে রাজী না হওয়াতে প্রধান শিক্ষক তার চাকরী খেয়ে ফেলেছেন। এই দুঃখে শিক্ষিকা কেঁদে কেঁদে স্কুল থেকে বের হয়ে গেছেন। পরের দিন অনেক অভিভাবক ঘটনার সত্যতা জানতে স্কুলে আসে। এক অভিভাবক নারী এসে জানালেন, পাশের স্কুলে এক ছাত্রীকে পাওয়া যাচ্ছে না। এক মহিলা আবার সাথে সাক্ষী ও দিলেন ঘটনার। সত্যতা জানতে, ছাত্রীর স্কুলের প্রধান শিক্ষককে ফোন করে জানা গেল ঘটনাটি নিছক গুজব। মাঝখান থেকে কিছু মানসিক প্রতিবন্ধী মানুষ গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। মানুষ গুজবটা বিশ্বাস করে, গণমাধ্যম, স্থানীয় সরকার, পুলিশ প্রশাসন থেকে মাইকিং করেও মানুষকে সত্য বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না। এখন শুরু হয়েছে ডেঙ্গু নিয়ে আরেক গুজব। হারপিক আর ব্লিচ ভিজিয়ে রাখলে ডেঙ্গু মশা থাকেনা। দুইটা উপাদানই খুব ভয়ংকর ক্ষতিকর। বিশেষ করে শিশুদের জন্য তো আরও ভয়ানক। মানুষ সেটি বিশ্বাস করছে। গুজব বিশ্বাস করার কারণ কি আসলে? মানুষ আসলে প্রচলিত নিয়ম ব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাস এবং অনাস্থা থেকেই হয়তো গুজবে আস্থা রাখছে। গুজবে এক ধরণের নতুনত্ব খুঁজে পায় হয়ত। তাই বিশ্বাস করতে চায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অনলাইন পত্রিকাগুলো হচ্ছে গুজবের মূল ফ্যাক্টরি।

এই গুজবের একটা অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আছে। খুব সাদা চোখে হয়তো সেটা গুজব বলেই মনে হয়। কিন্তু একটু গভীর ভাবে হিসাব নিকাশ করলে সেই তাৎপর্য মিলাতে পারবেন। গুজবের শুরু হয়েছিল ৫ মে হেফাজতের হাজার হাজার মানুষের লাশ দিয়ে। এর পর যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখা দিয়েছে। একে একে রামু, নাসির নগর, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ছাত্রের মৃত্যু, আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ছাত্রীদের ধর্ষণ এবং সেই গুজব দেশের বহু প্রথিতযশা লোকজন ও প্রচার করেছেন এবং সাক্ষী দিয়েছেন, শহীদুল আলম এবং এক চিত্রনায়িকাকে সে সময় পুলিশ আটকও করেছিল। যা বলছিলাম, এসবের লক্ষ্যবস্তু কিন্তু এক জায়গায় নির্ধারিত। বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে শেখ হাসিনা যখনই দেশের বাইরে থাকেন তখনই একটা ঘটনা জন্ম নেয় বাংলাদেশে। কারণ শেখ হাসিনা নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, বাংলাদেশের পুরো ব্যবস্থাটা তাঁকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে।এবং প্রতিটি দুর্যোগময় বা কোন ঘটনায় তাঁর সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ও বিচক্ষণতায় উতরে গেছে বাংলাদেশ। তাই গুজবকারীরা বেছে নেয় তাঁর বিদেশ সফরকালীন সময়। আর এবার তো স্বয়ং শেখ হাসিনাই গুজবের শিকার! তিনি যখন লন্ডনে চোখের চিকিৎসা নিচ্ছেন গুজব ছড়িয়েছে শেখ হাসিনা ক্যান্সারে আক্রান্ত খুব বেশীদিন বাঁচবেন না! বিএনপির এক লন্ডনের নেতাকে জিজ্ঞাসা করলাম, প্রধানমন্ত্রীর লন্ডন সফর বিএনপি এবার বিক্ষোভ করলো না ঘটনা কি? ভদ্রলোক জানালেন মানবিক কারণে, হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ করছেন না। বললাম প্রধানমন্ত্রী তো হোটেলে আছেন, তিনি মানতে রাজী না। তিনি বিশ্বাস করেন প্রধানমন্ত্রী সিরিয়াস অসুস্থ। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন! এবং অবাক করার বিষয় হলো আওয়ামী লীগের অনেকেই দেখলাম সেই গুজবে আস্থা রাখছেন!

দুর্নীতিবাজদের রাজত্ব চারপাশে, ডেঙ্গু কি মেয়রগণ চাষাবাদ করেন? ডেঙ্গুর চাষাবাদ আমরাই করছি।দায় দিচ্ছি মেয়রদের। হুম, মেয়রদের দায় এড়ানোর সুযোগ হয়তো নাই। মানুষ ভোট দিয়ে তাদের নির্বাচিত করেছে। কিন্তু নাগরিক হিসাবে কি দায়িত্ব পালন করছি আমরা। নাকি শুধু ভোট দেয়াই দায়িত্ব? দুর্নীতির বিরুদ্ধে খুব একটা সোচ্চার না। গুজব ছড়িয়ে ও সোচ্চার করা সম্ভব হবে বলে মনে হয়না। মাদ্রাসাগুলো হয়ে উঠেছে ধর্ষণের চারণ ভূমি। সেটি নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা নেই। চারপাশে নৈরাজ্য।

আমাদের ধর্মপ্রাণ ভাইয়েরা মিছিল করে ভারতীয় দূতাবাস ঘেরাও করেন ভারতে মুসলমানদের নির্যাতনের প্রতিবাদে! একবার জিজ্ঞাসা করতে খুব ইচ্ছা করে, ভারতীয় দূতাবাস থেকে চায়না এবং সৌদি হাইকমিশনের দূরত্ব কতদূর? চায়নার উইঘুরের নির্যাতনের কথা কি কেউ জানেন না? ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসনে হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে। সেই খবর কি আমাদের মিছিলকারী ভাইদের কাছে নেই? চীনের বেইজিং শহরে সব ধরণের খাবারের দোকানে আরবি লেখা এবং হালাল লেখা সাইনবোর্ড নিষিদ্ধ করেছে সরকার। কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছে তাদের চায়না জাতীয়তাবাদ এবং সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক হওয়াতে তারা এই কাজ করেছে। লোকজনকে আরও বেশী চায়না সংস্কৃতির প্রতি জোর দেয়ার আহবান জানিয়েছে। সেই মুছে দেয়া আরবি হরফে আল্লাহ আকবর থেকে শুরু করে বহু আয়াত সূরা ও আছে। খুব ভাল করেই আমরা জানি এর প্রতিবাদ সম্ভব নয় এবং হবে ও না।

যতো মানুষ সেদিন ভারতীয় দূতাবাসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে সমবেত হয়েছিলেন। সেই মানুষগুলো যদি ঢাকা শহর ডেঙ্গুমুক্ত করার অভিযানে নামতেন। ঢাকা শহর একদিনের অভিযানে মশামুক্ত হয়ে যেত বলেই আমার ধারণা। ভানের জলে ডুবছে দেশ ভাসছে মানুষ। সেই দিকে কারাও খেয়াল নেই।

নোবেল নামের সারেগামাপা অনুষ্ঠানের শিল্পী আজ থেকে কম হলে ও তিনমাস আগে এক ফেইস বুক লাইভে বলেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা, জাতীয় সংগীতের চাইতে প্রিন্স মাহমুদের বাংলাদেশ গানটা অনেক অর্থবহ মনে হয় তার কাছে। তার ব্যক্তিগত মত ছিল। তিনমাস পর হঠাৎ করে তার সেই ভিডিও নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। কিন্তু অবাক করার বিষয় নোবেলের চেয়ে বেশী আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ! ভারতীয়, হিন্দুর রচিত গান এইটা, এই গান বাংলাদেশের জন্য লেখা না, বঙ্গভঙ্গ নিয়ে লেখা। রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করেছিলেন। যাকে আমরা বলি "ঘুরে ফিরে বটের তল" কোন ধরণের কোন দলিল প্রমাণ ছাড়া রবীন্দ্র বিদ্বেষ এবং হিন্দু বিদ্বেষের একটা প্রক্রিয়া। এবং এই কাজটি কারা করে সেটা বুঝতে রকেট বিজ্ঞানী হওয়া দরকার পড়েনা। রবীন্দ্র বিদ্বেষ পাকিস্তান আমল থেকেই ছিল। এবং

রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশী না যেমন নজরুলও বাংলাদেশী না। নবী, রাসুল, ধর্ম প্রচারক অবতারগণ ও বাংলাদেশের মানুষ ছিলেন না। তাহলে সেই ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কি??

সপ্তাহখানেক আগে ভারত যখন তাদের চন্দ্র অভিযান সম্পন্ন করলো। ইন্টারনেটের বদৌলতে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমরা চেয়ে চেয়ে সেই দৃশ্য দেখলাম। বাংলাদেশে তখন ছেলেধরা সন্দেহে আমরা পিটিয়ে মানুষ মারছি। রসিয়ে রসিয়ে মিন্নি নয়ন বন্ডের ভুয়া ভিডিও দেখছি। সেই ভিডিও বিশ্বাস করছি এবং ভাইরাল করছি। গুজব ছাড়া যেন চলছেই না আমাদের।

জুয়েল রাজ, সম্পাদক, ব্রিকলেন; যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি, দৈনিক কালেরকন্ঠ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ