প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আরিফ জেবতিক | ১৩ জুলাই, ২০১৫
ভিডিওটা ভেসে আসা খবরের উপরে লেখা, ‘আমি মরি যাইরাম, আমারে কেউ বাঁচাও রে বা’।
আমি সিলেটের ছেলে, এ কথার শুধু অর্থ জানি এমন নয়, এই শব্দগুলোর অন্তর্নিহিত ভাবগুলোও আমি জানি।
কোনো একজন খুব অবাক বিষ্ময় নিয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে, আশা নিয়ে তাকাচ্ছে, সে মৃত্যুর আগে সবাইকে জানাতে চায়, সে একটু পরেই মরে যাবে, চাইলেই যে কেউ তাঁকে বাঁচাতে পারে।
আহারে অবোধ শিশু, ক্লান্ত গলায় শেষবারের মতো আকূতি করে বলছে, ’আমারে কেউ বাঁচাও রে বা’।
কেউ একজন, মাত্র কেউ একজন আগালেই তাঁর মৃত্যুটা রদ হয়, মাত্র কেউ একজন থামো বললেই তার অনন্ত যাত্রাটা থেমে যায়। আরো কিছুদিন, আরো অনেকগুলো দিন, অনেকগুলো মাস-বছর সে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে সে টিকে থাকতে পারত, একটা চায়ের দোকান করত কিংবা ফেরি করে তরকারি বেচত অথবা হয়তো মালয়েশিয়া গিয়ে শ্রম বেচত অথবা অন্যকিছু হতো।
আজ সারাটাদিন বড্ড অগোছালো গেছে। অফিসে কাজ করতে চাই-কানে ভাসে ‘আমারে কেউ বাঁচাও রে বা।’
সন্ধ্যায় ইফতার করতে গেছি এক জায়গায়, খাবার গলা দিয়ে নামে না, কানে ভাসে ”আমারে কেউ বাঁচাও রে বা। খেলা দেখব বলে মিরপুরের দিকে যাই, খেলা দেখতে পারি না, কানে ভাসে ”আমারে কেউ বাঁচাও রে বা। ভুলে থাকব বলে রসিকতা করতে চাই, একটা দুটো স্ট্যাটাস দিতে চাই, কিন্তু কানে ভাসে, ‘আমারে কেউ বাঁচাও রে বা।’
একুশ তাপাদারকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম, ভাবলাম অনেকক্ষণ বসে আড্ডা মারব, কিন্তু দুইমিনিট দাঁড়িয়ে থেকেই চলে আসি, কেউ একজন পিছন থেকে খালি বলে, ‘আমারে কেউ বাঁচাও রে বা।’
অনেকদিন আগে রাহেলার মামলাটা নিয়ে আমরা এই ব্লগ থেকে কাজ করেছিলাম। রাহেলা নামের মেয়েটিকে ধর্ষণ করে জাহাঙ্গীর নগর ভার্সিটির পাশে গলা কেটে রেখে গিয়েছিল কিছু হায়েনা, রাহেলা মরেনি, ওভাবেই টিকে ছিল দুইদিন, শরীরে পিপড়া ধরেছিল, সেখান থেকে রাহেলা ঝোপের পাশে কাউকে দেখে সেই কাটা গলায় ফ্যাসফ্যাস করে বলেছিল, ‘ভাই, আমারে কেউ বাঁচান।’
হাসপাতালে যুদ্ধ করতে করতেও রাহেলা বাঁচেনি শেষপর্যন্ত, যদিও হত্যাকারীদের নাম বলে গিয়েছিল, তবু আইনের ফাঁক গলে খুনিরা শেষ পর্যন্ত সবাই ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল।
সেই থেকে সাহসে চিড় ধরেছে, আত্মবিশ্বাস ফিকে হয়ে গেছে, বিচারের দাবি করার সাহস পাই না, শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার শপথ নিতে দ্বিধা হয় রাহেলার পর থেকেই।
শুধু ভাবি, খুব গহীন গভীরে এই পুরো জাতি এক অদ্ভুত মনোবৈকল্যে ভুগছি। সকলের মাঝে গভীর অসুখ, এক অদ্ভুত হিংসাপ্রিয় জাতি আমরা।
এখানে কারো প্রতি কারো মমতা নেই। রাস্তায় একটু ধাক্কা লাগলেই আমরা খেঁকিয়ে উঠি পরষ্পরের প্রতি। নিয়মিত ইন্টারনেটে ঢুকে পরষ্পরের প্রতি বিষোদগার উগড়ে দিই।
এইখানে আহত একুশ তাপাদার যখন হাচড়ে-পাচড়ে রাস্তায় উঠে একজনকে মিনতি করে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে, সেই লোক ‘কাজ আছে’ বলে অনায়াসে চলে যায় মোটরসাইকেল হাকিয়ে।
এখানে আমরা মানুষ পোড়াই, মানুষ গুম করে মেরে ফেলি-তারপর সেই মৃত্যুগুলো নিয়ে বীভৎস উল্লাস বোধি নিজেদের গহীনে।
আমি আজ রাতে ঘুমাতে পারব না, আজ রাতে বারবার শুনব ‘আমারে কেউ বাঁচাও রে বা।’ কিন্তু কাল রাতে ঠিকই ঘুমাব, পরশুদিনও। আবার উল্লাসে মাতব, এমনকি হাতের কাছে পেলে আমিও হয়তো পিটিয়ে মেরে ফেলব আরেকটা শিশুকে।
শুধু ছোট্ট রাজন নয়, গোটা জাতি মিনতি করে বলছে, ‘আমি মরি যাইরাম, আমারে কেউ বাঁচাও রে বা’-আমরা জাতির সন্তান, নিজেরা জঙ্গলের পশুর মতো নিজেদের ভেতরে কুৎসিত প্রতিহিংসা আর মমত্বহীন বোধ নিয়ে দুইপেয়ে পশুর পাল, শুধু ফেসবুকের স্ট্যাটাসে নিজেকে মহৎ প্রমাণের দিনমান চেষ্টা করে যাব।
আমরা কেউ কান পেতে শুনব না, আমরা প্রত্যেকেই মরে গেছি, আমরা প্রত্যেকে পশু হয়ে গেছি, আমাদের মনের অনেক গহীনে মনুষত্ব কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘আমি মরি যাইরাম, আমারে কেউ বাঁচাও রে বা’।
সেই বোধ যদি না জাগে, তাহলে আমরা নিজেরাই রাজন হয়ে যাব একদিন; এই শোক, এই ক্রোধ, এই অশ্রু কোনো গন্তব্যে পৌঁছাবে না, শুধু ফেসুবুকের স্ট্যাটাস বুদবুদ হয়ে শূন্যেই মিলিয়ে যাবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য