প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ইমতিয়াজ মাহমুদ | ০৭ অক্টোবর, ২০১৯
ভিন্নমতের কারণে মানুষকে খুন করা অন্যায়। খুন করা সে তো এমনিই অন্যায়- এমনকি কেউ যদি ঘোরতর অপরাধও করে থাকে, তাকে আপনি পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারেন না, বা গুলি করে মেরে ফেলতে পারেন না। এই ন্যূনতম ন্যায়বোধটা আমাদের এখানে শিক্ষিত মিডল ক্লাসের মধ্যে নাই। অন্তত সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে যে নাই সেকথা তো আমি নিজের চোখেই দেখেছি। আপনারাও দেখেছেন। অভিজিৎ রায়কে যখন হত্যা করে হয়েছে তখন কি আপনি আশেপাশের লোকজনের মুখে সেই হত্যাকাণ্ডকে জাস্টিফাই করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যুক্তি তর্ক শোনেননি? আমি শুনেছি। 'থাবা'র (রাজীব হায়দার) মৃত্যুর পরও এইরকম ঘটনা ঘটেছে। বারবার এরকম হয়েছে- ধর্মবিশ্বাসীরা নাস্তিকদের হত্যা করাকে সমর্থন করেছে। এক মোল্লা তার সমর্থকদের বলেছে যে নাস্তিকদেরকে হত্যা করা নাকি ওয়াজিব হয়ে গেছে।
আমরা বারবার চীৎকার করেছি যে এইভাবে ভিন্নমত দমন করা কোন সভ্য সমাজের পরিচায়ক নয়। মানুষকে কথা বলতে দিতে হয়- যে যত মন্দ কথাই হোক না কেন। আমার মতামত যদি শোনেন, আমি তো সবসময়ই বলে আসছি যে বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা একটা নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা, এর কোন সীমাবদ্ধতা বা সীমারেখা থাকতে পারে না। বিপরীতে আপনারা চেঁচিয়েছেন- জি না, মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা আছে বটে, তবে সেটা নাকি শর্তযুক্ত। আপনার ভুল- ভ্রান্ত। কিন্তু একটা পর্যায় পর্যন্ত তো আমাদের ঐক্য হবার কথা, যে ভিন্নমতের কারণে কাউকে নিপীড়ন করা ঠিক না। কিন্তু এই কথাটাও আপনারা স্পষ্ট করে বলেন না। আপনার মুখে নানানরকম কথা বলেন বটে, কিন্তু আপনাদের অন্তরে সাপ। আপনাদের কথা হচ্ছে যে আমার পক্ষে যারা কথা বলবে ওদের বাক স্বাধীনতা আছে, বাকিদেরকে মারধর করা বা অন্য কোনোভাবে হেনস্তা করা জায়েজ আছে।
২
এই যে আজকে বুয়েটে একটা ছেলেকে হত্যা করার খবর এসেছে, মনে তো হচ্ছে যে ছেলেটাকে হত্যা করা হয়েছে ওর মতামতের জন্যে। হত্যার উদ্দেশ্য ছিল কিনা জানিনা, কিন্তু খবরে যেটা এসেছে, ওকে মারধর করা হয়েছে শিবির সন্দেহে। মানে কী? মানে হচ্ছে যে এই ছেলেটাকে তার রাজনৈতিক মতামতের কারণে মারধর করা হয়েছে- সেই মারধরেই তার মৃত্যু হয়েছে।
এখন আমাকে বলেন, আপনারা যদি তখনই শক্ত অবস্থান নিতেন, যে না, কোন অবস্থাতেই ভিন্নমতের কারণে মানুষকে হামলা করা সহ্য করা হবে না, তাইলে সম্ভবত আজকের এই ঘটনা আপনাদেরকে দেখতে হতো না। সেদিন যদি আপনারা স্পষ্ট করে বলতেন যে একজন মানুষ যত খারাপ কথাই বলুক না কেন, সেই কথাটা তাকে বলতে দিতে হবে। কণ্ঠ রুদ্ধ করা যাবে না। তাইলে হয়তো আজকে এই ঘটনাটা দেখতে হতো না। সেদিন যদি সরকার বলতো, জি না, আপনার অনুভূতিতে যত তীব্র আঘাতই লাগুক না কেন, আপনার পছন্দ না হলে আপনি শুনবেন না, কিন্তু মুখের কথার জন্যে কাউকে সাজা দেওয়া যাবে না- তাইলে আজকে এই ঘটনা দেখতে হতো না।
বুয়েটে ঘটে যাওয়া এই হত্যাকাণ্ডটির বিচার চাই। কিন্তু সেই সাথে এই কথাটাও বলে রাখি, কেবল মাত্র এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করেই আপনি এইরকম খুনাখুনির মিছিল থামাতে পারবেন না। আপনি যদি আসলেই চান যে এইরকম খুনাখুনি না ঘটুক, আসলেই যদি চান যে দেশের ছেলেমেয়েরা গণতান্ত্রিক আচরণ শিখুক, নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য নিয়ে পরস্পরকে সভ্য পন্থায় আক্রমণ করতে শিখুক- যুদ্ধটা হোক বাক যুদ্ধ- তাইলে আপনাকে স্পষ্ট করে সকলের উদ্দেশ্যে এই কথাটা বলতে হবে যে এই দেশে প্রতিটা মানুষ যা ইচ্ছা তাই বলতে পারবে। কারো কথা যদি শুনতে তিক্ত হয়, কারো কথা যদি আপনার ধর্ম বিশ্বাস বা রাজনৈতিক ধারনা বা আপনার প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে চূড়ান্ত রকমভাবে হেয় করে- তবুও সেই কথাটা বলার অধিকারও সকলের আছে।
৩
আপনারা, মানে কিনা দেশের সরকার প্রধান বা নানারকম বাহিনীর প্রধান এবং নানারকম রাজনৈতিক দল বা ইন্টেলেকচুয়াল গ্রুপের প্রধান, যাদেরকে অনেক মানুষ মানে, আপনারা যদি স্পষ্ট করে বাকস্বাধীনতার এই কথাটা সকলকে বলেন তাইলে রাজনৈতিক কর্মী-গুণ্ডা, পুলিশ বা সরকারি কর্মকর্তা সকলের কাছে কি বার্তাটা যায়? বার্তাটা যায় যে কথার জন্যে কাউকে হ্যারাস করা যাবে না, কাউকে মারা যাবে না, কাউকে জেলে পাঠানো যাবে না।
ঐ যে বললাম না, যে এই কথাটা আগে বললে আজকে এই ঘটনা ঘটতো না। কথাটা এমনিই বাত কি বাত না। মনে করেন অভিজিৎ বা তাঁর পরের হত্যাকাণ্ডগুলির সময় যদি আমাদের প্রধানমন্ত্রী আর পুলিশ প্রধান আর র্যাব প্রধান এরা বলতেন যে বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ রাষ্ট্র করবে না এবং অন্য কেউ করবে সেটাও সহ্য করা হবে না। তাইলে ছাত্রলীগের ছেলের কি শিখতো? যে না, কথা পছন্দ না হলেই মারধর করা যাবে না, করলে খবর আছে। কিন্তু আপনারা কী বললেন? আপনারা বললেন যে, বাকস্বাধীনতা আছে মানে এই না যে আপনি যা খুশি তাই বলবেন। ফলাফল কী হল? আপনারা সবাইকে শেখালেন যে বাকস্বাধীনতা এইটা একটা কথার কথা, আমাদের পছন্দ নয় এমন কোন কথা বললে খবর আছে।
ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। রাষ্ট্রের ক্যারেক্টারটাই করে ফলেছেন অসহিষ্ণু, আপানরা মুখেও বলছেন এই কথা, তাইলে আপনাদের দলের ক্যাডাররা কী করবে? এইরকমই করবে। আর অন্যরা? ওয়েল, মুসলিম ফান্ডামেন্টালিস্টরা তো এমনিতেই বাকস্বাধীনতা গণতন্ত্র এইসব মানে না। আপনাদের কথায় ও কাজে ওরাও উৎসাহিত হবে।
৪
এই যে ছেলেটা মারা গেল, সম্ভবত ওর সাথে আমার কখনোই মতের মিল হতো না। সম্ভবত আমি ওর মতামতকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতাম, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতাম, হেসে উড়িয়ে দিতাম। ওকে হত্যা করে আপনারা তাকে চেতনার শহীদ বানিয়ে দিলেন। আপনারাই হিসাব করেন, এইসব করে দেশকে কতোটুকু এগিয়ে নিচ্ছেন আর কতোটুকু অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য