প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ০৭ নভেম্বর, ২০১৯
মুক্তিযুদ্ধের অসম সাহসী যোদ্ধা মঈনউদ্দিন খান বাদল চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। দেশের সূর্যসন্তানেরা এক এক করে আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এ হচ্ছে প্রজন্মের পালাবদলের সময়। এমন একটা বয়সে মুক্তিযোদ্ধারা চলে গেছেন; যখন প্রকৃতির নিয়মেই তাদের চলে যাবার পালা। সম্মুখ সমরের আরেক মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার মৃতদেহকে যখন দেশের মানুষ গভীর শ্রদ্ধায় বিদায় জানাচ্ছেন; তখন আরেক মুক্তিযোদ্ধা বাদলের মৃতদেহ আমাদের স্বজন হারানোর বেদনায় ভারাক্রান্ত করেছে।
পৃথিবীর যে কোন দেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম বা বিপ্লবের পরে একটি প্রতিবিপ্লব ঘটে। বাংলাদেশ যেহেতু পৃথিবী গ্রহের একটি রাষ্ট্র; ফলে এখানেও মুক্তিযুদ্ধের পরে একটি প্রতিবিপ্লব হয়েছে। যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধারা স্বাভাবিকভাবেই 'দেশ' নিয়ে অস্বাভাবিক অস্থির হয়ে পড়ে; জাতির জনকের ওপর সব প্রত্যাশার বোঝা চাপিয়ে দিয়ে; কেন স্বাধীন দেশ এখনো স্বর্গ হলো না! এরকম ইউটোপিয়া নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অস্থির করে তোলে সেসময়ের তরুণ অস্থির পাখিরা।
আর দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের রাজনৈতিক আদর্শ বলে তো কিছু নেই। টাকা উপার্জনের জন্য ক্ষমতা কাঠামোর দালালি করার লোভ দক্ষিণ এশিয়দের রক্তে কিলবিল করে। ফলে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর মাথায় ছাতা ধরার লোকের অভাব হয়নি। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুর মাথায় ছাতা ধরা, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া হয়ে এখন বেশ শেখ হাসিনার মাথার ওপর ছাতা ধরে আছে ছত্রীধরেরা। বঙ্গবন্ধু এদের বলতেন চাটার দল। আর এই জনপদ যে চোরের খনি সেই উপলব্ধিও বঙ্গবন্ধুর।
সেইখানে মুক্তিযোদ্ধা বাদল ও মুক্তিযোদ্ধা খোকা স্বাধীনতার পর বিভাজিত হয়ে পড়া দুজন রাজনীতিক। বাদল দাবি করছেন তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি। আর খোকাকে ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনের বিভাজন তত্ত্ব অনুযায়ী স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি বলতে হবে। যে যৌবনে বাদল ও খোকা মুক্তিযুদ্ধে গেলেন, ঠিক সেই যৌবনে দখলদার পাকিস্তান সরকারের দায়িত্বপালনরত বাবা ও মামার বাসায় নিরাপদে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করলেন; এমন মানুষেরাই ব্রিটিশদের অনুকরণে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তিতে বিভাজিত করে আজো বেশ বহাল তবিয়তে বাংলাদেশ আমলের সরকারি নিরাপত্তার মামা বাড়িতে অবস্থান করছেন।
মুক্তিযোদ্ধা বাদল জাসদ একাংশের নেতা। এই জাসদ স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বিরোধী দল হিসেবে সক্রিয় হয়। বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা থেকে সরানোর অভিমতে তাদের সমর্থন ছিলো। তবে তারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা সমর্থন করেনি; এটা মুক্তিযোদ্ধা বাদলের বক্তব্য থেকে মনে হয়। মুক্তিযোদ্ধা বাদলের অভিমত, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাঝ দিয়ে তার অসাম্প্রদায়িক-সাম্য ভাবনার দর্শনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এমনকি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাঝ দিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যা প্রচেষ্টা সেই একই দর্শনকে চিরতরে হত্যার চেষ্টা। নিঃসন্দেহে এটা খুব যৌক্তিক পর্যবেক্ষণ।
অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা খোকা জিয়াউর রহমানের বিএনপির রাজনীতির একজন শীর্ষ নেতা। এই জিয়া রাজনীতিতে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের পুনর্বাসিত করেছেন। এনিমিজ এনিমি মাই ফ্রেন্ড; এই নীতিতে যারাই আওয়ামী লীগের শত্রু; তারাই বিএনপির বন্ধু। গালিভারস ট্রাভেলস-এর লিলিপুটিয়ান আর ব্লেফুসকুডিয়ান; এই দুই পক্ষের মত আমৃত্যু শত্রুতা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির।
ফলে আওয়ামী লীগের মহাজোটে যোগ দেয়া মুক্তিযোদ্ধা বাদল আর বিএনপির শীর্ষনেতা মুক্তিযোদ্ধা খোকা মারা গেলেন; দুটি শত্রু শিবিরের মানুষ হিসেবে।
দক্ষিণ এশিয়ার ছত্রীধর সম্প্রদায়ের দালাল ও ঠগি গোষ্ঠীর যে লোকেরা আছে; তারা টাকা গোনার সময় দুই চোখ খোলা রাখে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাকে শেষ সম্মান জানানোর সময় এক চোখ বন্ধ করে ফেলে। এরা এক চোখা দুটি দালাল গোষ্ঠী; যাদের জীবনের উদ্দেশ্য দেশলুন্ঠন; বিদেশে সেকেন্ড হোম তৈরি। তারা অনলাইন সংবাদপত্রের মন্তব্যে আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের 'লাশকাটা ঘরে' দলান্ধ ও ধর্মান্ধ এই দুটি বক-জাতীয়তাবাদী শিবিরে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা বাদলকে ও মুক্তিযোদ্ধা খোকাকে ব্যবচ্ছেদ করছে।
দলান্ধরা মনে করে তারা দেশের মালিক; তারা যাকে সার্টিফিকেট দেবে সেই সহিহ দেশপ্রেমিক। আর ধর্মান্ধরা মনে করছে, তারা দেশ ও দোজাহানের মালিক; তারা যাকে সার্টিফিকেট দেবে তারা সহিহ ধার্মিক।
বাদল-খোকার মৃতদেহ বাংলাদেশের অসম্পূর্ণ স্বপ্নযাত্রার দেহাবশেষ; চোরের খনিতে চাটাচাটি করে লুণ্ঠনের জুয়াঘর চালিয়ে যাবার মহাযজ্ঞে; বাদল-খোকাকে বিভাজিত করে আলাদা আলাদা করে হাসান ও হোসেনের জন্য পুঁথিপাঠের আদিম আসরে; মুক্তিযোদ্ধা-মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী-স্বজন হারানো মানুষের অশ্রুজলকে বিভাজনের ফতোয়া দিয়ে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করার পায়তারা।
এই একবিংশের বাংলাদেশ-কালে বিএনপি-জামায়াত ও অধুনা আওয়ামী লীগ-জাসদ-হেফাজতের শাসনকালে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত মানুষ, ক্ষমতায় থাকা জল্লাদের টর্চার সেলে নিহত ছাত্র-জনতা, ধর্ষিতা নারী, নির্যাতিত কৃষক শ্রমিক আপামর জনতার উপায়হীনতার ট্র্যাজেডি; নিজভূমে পরবাসী হবার মর্মন্তুদ এক শোকগাথা।
বাদল ও খোকা যে যার জীবন বাস্তবতায় বেছে নেয়া স্বাধীনতাত্তোর রাজনৈতিক শিবিরের সদস্য হলেও; তাদের মিলের জায়গা হচ্ছে; তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা; বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধে না গেলে; আজ আমাদের পাকিস্তান উপনিবেশের দাস হয়ে থাকতে হতো। একটা রাষ্ট্র-পতাকা-সংবিধান-পাসপোর্ট উপহার দেয়ায় আমরা সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো জাতির এই দুই সূর্যসন্তানের প্রতি।
বাদল ও খোকা; মুক্তিযুদ্ধে এক সঙ্গে ছিলেন; স্বাধীনতাত্তোর প্রতিবিপ্লবে তারা দুটি শত্রু শিবিরে ছিটকে পড়লেও মৃত্যুতে আবার তারা সহগামী হলেন। একারণেই হয়তো কবি আবুল হাসান তার মৃত্যুভাবনায় উচ্চারণ করেছেন, মিলনই মৌলিক।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য