আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

পরিচয় ধর্মে নয়, সংস্কৃতিতে

ইমতিয়াজ মাহমুদ  

পশ্চিমবঙ্গ থেকে যারা মাইগ্রেট করে এপারে এসেছিল ওদেরকে 'ঘটি' বলে একসময় ঠাট্টা করতো এপারের লোকেরা। এখন সকলে একরকম মিলেমিশে গেছি, এখন সেই ঘটি-বাঙাল প্রসঙ্গ বাংলাদেশে খুব একটা চলে না। অবাঙালি যারা সেসময় মাইগ্রেট করে এসেছিল ওদেরকে নিয়ে সমস্যা এখনো আছে। এদের বড় অংশ বিহার থেকে এসেছিল বলে কিনা জানিনা, এদেরকে সবাই বিহারী হিসেবেই চেনে। এমনকি যারা মধ্য প্রদেশ না উত্তর প্রদেশ থেকে এসেছিল ওদেরকেও সবাই বিহারীই বলে।



এ বিহারীরা ১৯৭১ সনে আমাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, অনেকে গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল। স্বাধীনতার পরেও ওদের একটা বড় অংশ চেয়েছিল পাকিস্তানে ফেরত যাবে। আটকেপড়া পাকিস্তানী হয়ে তারপর থেকে জেনেভা ক্যাম্পে শুরু হয় ওদের মানবেতর জীবনযাপন।



একাত্তরে বিহারীদের ভূমিকা নিয়ে ওদের প্রতি একধরনের বিরাগ তো আমাদের আছেই। কিন্তু এই বেচারাদের অবস্থা দেখলে একটু মায়াও লাগে। উড়িষ্যা বিহার উত্তর প্রদেশ মধ্য প্রদেশ আরও কোন কোন এলাকা থেকে এই মানুষগুলি এখানে এসেছিল বসতি স্থাপন করবে বলে। কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসের মিল ছাড়া এদের সাথে আমাদের আর কোন মিল নাই। আর এই ধর্মীয় বিশ্বাস যে মানুষের মধ্যে আসলেই কোন অর্থবহ বা স্থায়ী ঐক্য গড়ে তুলতে পারেনা তার মর্মান্তিক প্রমাণ হয়ে এই লোকগুলি আমাদের দেশে এখনো করুণ জীবনযাপন করছে।



পাকিস্তান ওদেরকে নেয়না। কেন নেবে? অবিভক্ত ভারতের যে অংশটা এখন পাকিস্তান হিসেবে চিহ্নিত সেই অংশের সাথে ওদের কিই বা যোগাযোগ আছে! ওরা এসেছিল ভারত থেকে, বসতি স্থাপন করেছিল আমাদের দেশে, পাকিস্তান ওদের কে? এই বেকুব সম্প্রদায়টা তবু একান্তে নিজেদেরকে পাকিস্তানীই মনে করে। আজব!



= দুই =
১৯৪৭’র পর সেসময় যেসব মুসলমান নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুসলমানদের নয়া দেশ পাকিস্তানে ‘হিজরত’ করেছিল দ্বিজাতিতত্বের ভ্রান্তির শিকার হয়ে কি মূল্যই না ওরা দিচ্ছে! আমাদের এখানে বিহারীদের অবস্থা তো দেখছেনই। পাকিস্তানে মুহাজিরদের যে কি করুণ অবস্থা সেই খবর যদি নেন তাইলে বুঝবেন বেচারাদের কি অবস্থা! পাকিস্তানে মুহাজিররা থাকে মূলত সিন্ধু প্রদেশে। সিন্ধুর রাজধানী করাচী হচ্ছে ওদের মুল আস্তানা। করাচী সহ গোটা পাকিস্তানে ওদেরকে ঠাট্টা করে ডাকা হয় 'ভাইয়া' 'গাদ্দার' 'মাক্কার' এরকম আরও নানারকম বিচিত্র নামে।



এখনো, পাকিস্তান সৃষ্টির পঁয়ষট্টি বছর হয়ে গেছে, এখনো সেখানে মুহাজিরদেরকে বাকি পাকিস্তানীরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। মুহাজিররা নিজেদের দল বানিয়েছে, ওদের নেতা পাকিস্তানেই থাকতে পারেনা, লন্ডনে গিয়ে আস্তানা গেড়েছে। ওদেরকে পুলিশে মারে, আর্মিরা মারে। জেনারেশন পার হয়ে গেছে কিন্তু ওদের শরীর থেকে মুহাজির নাম মুছে যায়নি। কি ট্র্যাজেডি!



ট্রাজেডি দেখেন। এই মুহাজিররা মোটামুটিভাবে সবাই উর্দুভাষী। কিছু অবশ্য গুজরাটি খাড়েবোলি বা ভোজপুরি ভাষায়রও লোক আছে, কিন্তু এরা সবাই উর্দুভাষী হিসেবেই পরিচিত। তো ওদের ভাষা উর্দু পাকিস্তানের মুল রাষ্ট্রভাষা, দাপ্তরিক ভাষা। আর উর্দুভাষীদেরকেই কিনা পাঞ্জাবী আর সিন্ধি ভাষাভাষীরা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে।

 

এ এক বিচিত্র অবস্থা। বাইরের দুনিয়ায় যা কিছু পাকিস্তানী হিসেবে জানে সবাই, তার বেশিরভাগই এই মুহাজিররা ভারত থেকে নিয়ে গেছে। উর্দু ভাষা, উর্দু সাহিত্য, কাবাব, নিহারি, হালিম এইসব খাবার সবকিছু ওরা ভারত থেকে সাথে করে নিয়ে গেছে। গোটা পাকিস্তানে কোন এলাকারই স্থানীয় ভাষা উর্দু না, এটা মুহাজিরদের ভাষা।



= তিন =
আমাদের এখান থেকেও একটা বিশাল জনগোষ্ঠী ভারতে চলে গেছে। হিন্দুরা পশ্চিমবঙ্গেই গেছে বেশিরভাগ, কিছু মানুষ আবার ত্রিপুরাতেও গেছে, আসামেও গেছে। পশ্চিমবঙ্গে আমাদের এখান থেকে যাওয়া মানুষেরা প্রথমে নানারকম মানবিক সমস্যায় পড়েছিল। অনেক কষ্ট করেছে প্রথম প্রজন্মের রিফিউজিরা। থাকার যায়গা ছিল না, কাজকর্ম পায়নি, তীব্র অভাব অনটনের মধ্যে জীবনযাপন করতে হয়েছে অনেককে। সাংস্কৃতিক বৈসাদৃশ্য নিয়েও এই রকম ব্যাপার ঘটেছে, ঘটিরা বাঙ্গালদেরকে 'জমিদার' বলে ঠাট্টা করে এরকম আমিও দেখেছি। কিন্তু ধীরে ধীরে ওরা মিশে গেছে। অনেকটা আমদের এখানে আসা মুসলমান ঘটিদের মতই।



ত্রিপুরাতে তো বাংলাদেশ থেকে যাওয়া লোকদের নিয়ে সেরকম কোন সমস্যাই হয়নি। ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গে আমাদের দেশের ছেলেরা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছে, আরও কত কী। ভারত থেকে আসা বাঙালি মুসলমানরা তো আমাদের দেশে ভালই আছে। বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরার মধ্যে এই দেশত্যাগ অভিভাষণ এইসব তো এখনো চলে। আমার বন্ধুরাও দুএকজন দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছে। একজন তো বাইশ-তেইশ বছর বয়সে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে এখন দমদমে ভালোই ব্যাবসা ফেঁদে বসেছে।



কিন্তু আসামে সমস্যা হয়েছে। আসাম থেকে যারা ১৯৪৭’র পর আমাদের এদিকে চলে এসেছে, ওদের কোন সমস্যা হয়নি। মওলানা ভাসানীর মত 'কনফিউজড মওলানা' আসাম থেকে এসে আমাদের এখানে এতো বড় নেতা হয়েছিলেন। এখনো যদি কোন বাঙালি আসাম থেকে মওকা মতো এপারে চলে আসতে পারে, একটু চেষ্টা করলেই আমাদের মূলধারার সাথে মিশে যেতে পারবে। কিন্তু যেসব বাঙালি আমাদের এখান থেকে আসামে গেছে, ১৯৪৭’র আগে বা পরে, ওদের সেখানে সমস্যা হচ্ছে।



= চার =
আসলে আসামে যে বাঙালিদের সমস্যা হচ্ছে সেটা নিয়েই এই লেখাটা লিখব ভেবেছিলাম। এই যে এখন আসামে জাতীয় পর্যায়ে নাগরিকদের নিবন্ধন হচ্ছে সেখানে বাঙালিরা একরকম মুশকিলে পড়েছে। লিগ্যাসি ডাটা নাকি লিগ্যাসি ডকুমেন্ট কিসব জোগাড় করতে হচ্ছে বাঙালিদেরকে। লিগ্যাসি ডকুমেন্ট না থাকলে নাগরিকত্ব তালিকায় নাম উঠবে না, আর নাগরিকত্ব তালিকায় নাম না উঠলে কী হবে এই আতঙ্কে অনেকে সেখানে ইতিমধ্যে আত্মহত্যা করেছে।



আসামে লিগ্যাসি ডকুমেন্ট নিয়ে এই হেনস্তাটা হচ্ছে মূলত বাঙালিদেরই। বাঙালিদের মধ্যে অনেকেই আতঙ্কে আছে, লিগ্যাসি ডাটা না থাকলে কি তবে ওদেরকে থেকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে? ভেবেছিলাম এইটা নিয়ে লেখাটা লিখব।



তবে সেটা নিয়ে আরেকদিন লিখব। বরং আজ আপনাদেরকে মানুষের পরিচয়ে ধর্মীয় বিশ্বাস আর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এই দুইয়ের ব্যাপারটা ভাবতে বলি।

দেখেন, আমাদের এখানে হিন্দু আর মুসলমান এই দুই ধর্মের লোকদেরকে দুই জাতি বলে একটা কৃত্রিম বিভক্তি হয়েছিল সেটা যে ভ্রান্ত ছিল তাতে তো আর এখন কোন সন্দেহই নাই। কেবলমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে একদল মানুষ নিজেদেরকে সম্পূর্ণ আপন ভাবতে পারেনা। হয়না। এটা স্বাভাবিক না।



বিহারীরাও মুসলমান আমরাও মুসলমান, কিন্তু আমাদের মধ্যে এটা হয়নি। মুহাজিররাও মুসলমান, কিন্তু মুসলমান দেশ পাকিস্তানে ওদের স্ট্যাটাস তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকের মত। সাংস্কৃতিক মিল না থাকলে ধর্ম দিয়ে হয়না। আসামে অসমি আর বাঙালির সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণেই সমস্যা হচ্ছে।



= পাঁচ =
হ্যাঁ, ধর্মও গুরুত্বহীন না। ধর্মীয় বিশ্বাস ঐক্য তৈরি করতে না পারলেও ধর্মকে ব্যবহার করে আপনি বিভক্তি তৈরি করতে পারেন ঠিকই!

 

ইমতিয়াজ মাহমুদ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ