আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

গুজব মনস্তত্ত্ব

মাসকাওয়াথ আহসান  

'গুজব' বিষয়টি আজকাল প্রায়ই জনজীবনকে প্রভাবিত করে। গুজব পৃথিবীর সব সমাজেই প্রচলিত রয়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু এখনো পৃথিবী গ্রহেই রয়েছে; কাজেই এখানেও গুজব সৃষ্টি হয়; এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

মানুষের অভিমত কখনো গুজবে পরিণত হয় না। গুজব তৈরি হয় 'তথ্য'কে ঘিরে। আর এই তথ্য জনে জনে প্রচারিত হলে তবেই তা গুজবের রূপ পায়। সাধারণত যেসব তথ্য যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না বা কম থাকে সেসব তথ্যই গুজবে পরিণত হয়। আর যেসব তথ্যের জনজীবনে প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে কেবল সেগুলোই গুজবে পরিণত হয়।

জনমানুষ অনিশ্চয়তার মাঝে থাকলে তারা গুজবের ভোক্তা হয়। রাষ্ট্র-কাঠামোতে কী ঘটছে এটা জানানোর ব্যাপারে সরকারের স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ভূমিকা না থাকলে; সাধারণ মানুষ তাদের নাগরিক জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগে। কাজেই তখন গুজব আকারে আসা তথ্য তারা বিশ্বাস করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের জার্মানি কিংবা ষাট-সত্তর দশকের এমেরিকায় সিভিল রাইটস মুভমেন্টের অনিশ্চিত সময়গুলোতে সেসব দেশে গুজবের মাত্রাতিরিক্ত প্রকোপ দেখা যায়।

যারা দুশ্চিন্তার মাঝে সময় কাটায়; তারা চট করে গুজব বিশ্বাস করে। যে দেশে আইনের শাসন নেই, সামাজিক সুবিচার নেই, সম্পদের সুষম বণ্টন নেই; সে দেশে স্বাভাবিকভাবেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নাগরিকের সংখ্যা বেশি। এতে করে গুজবের গ্রাহক বেশি হয় সুশাসন বঞ্চিত সমাজে।

গুজব তখনই ছড়িয়ে পড়ে যখন জনজীবনে এর গুরুত্ব থাকে। জনজীবনে পেঁয়াজ -লবণ প্রতিদিনের খাদ্যগ্রহণে প্রয়োজনীয়। ফলে পেঁয়াজ ও লবণের মূল্য বৃদ্ধির 'গুজব' মানুষ সহজেই বিশ্বাস করে।

মানুষ গুজবকে সঠিক তথ্য বলে বিশ্বাস করে জন্যই তা প্রচার করে। এক্ষেত্রে মূলধারার মিডিয়ায় দেখা খবরে অবিশ্বাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মিডিয়া যেহেতু রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ; জনগণের পক্ষে সুশাসন আদায়ের লক্ষ্যে মিডিয়ার কাজ করার কথা। কিন্তু মিডিয়াকে যখন সরকার, বিরোধী দল, ব্যবসায়ী-ঠিকাদার, সামরিক-বেসামরিক আমলার স্বার্থ রক্ষা করে চলতে দেখে সাধারণ মানুষ; তখন তারা আস্থা হারায় মিডিয়ার ক্রেডিবিলিটিতে। এরকম সময়ে জনগণের 'তথ্য চাহিদা' পূরণে গুজব তৈরি হতে দেখা যায়।

মানুষের সতত প্রবৃত্তি নিজেকে অন্যের চেয়ে বড় করে দেখানোর। বাংলাদেশে যেমন আওয়ামী লীগ-হেফাজত সারাক্ষণ বিএনপি-জামায়াতের চেয়ে নিজেকে বড় করে দেখাতে নানারকম গুজবের জন্ম দেয়। আবার বিএনপি-জামায়াত চেষ্টা করে নানা গুজবের জন্ম দিয়ে নিজেদের আওয়ামী লীগ ও হেফাজতের চেয়ে বড় করে দেখাতে। এরকম দলীয় আগ্রহ থেকে গুজব ছড়ানো হয়।

গুজব ছড়িয়ে অনেকে 'আমার কাছে তথ্য' আছে জাতীয় আত্মতুষ্টি বোধ করে। এটা নিজের স্ট্যাটাস বাড়াতে ব্যবহার করে মানুষ। অডিয়েন্স অনুযায়ী সে বিভিন্ন গুজব বিভিন্ন জনের কাছে পরিবেশন করে একরকমের ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন অনুভব করে।

কাজেই 'গুজব'-এর সঙ্গে ফেসবুকের তুখোড় নেটিজেনদের উত্থাপিত আয়োডিন ঘাটতির অভিযোগের কোন সম্পর্ক নেই। এই দশবছর আগে যার আয়োডিনযুক্ত লবণ খাবার সামর্থ্য ছিলো না; এক দশকের দুর্নীতি বিপ্লবে এখন বেশ আয়োডিনযুক্ত লবণ খেয়ে আর চর্বি জমিয়ে অনেকেই অতি-আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। তারা যে কোন গুজব প্রচারিত হলে বেশ মুঠি পাকিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এসে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে, গুজব যারা বিশ্বাস করে তাদেরকে লক্ষ্য করে।

আমাদের গ্রামে ধমক দিয়ে শেখানোর চল অতি প্রাচীন। এ কারণে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অথচ ভালো করে বুঝিয়ে বললে সহজেই শিক্ষার্থীদের মনোযোগ পাওয়া যায়। দশ বছর আগের আয়োডিন ঘাটতিতে মস্তিষ্কের আকার ক্ষুদ্র থেকে যাওয়ায়; অন্যদিকে দুর্নীতির চর্বিতে শরীর বেধড়ক স্ফীত হয়ে যাওয়ায়; জনজীবনে দুর্ভোগের জন্য জনগণকে গালাগাল করে ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তায় ধস নামায়; দলটির সহমত ভাইয়েরা।

অথচ এই সহমত ভাইয়েরা নিজেদের স্ট্যাটাস বাড়াতে ও নিজেদেরকে তাদের প্রতিপক্ষের চেয়ে বড় করে দেখাতে অসংখ্য গুজব প্রচার করে চলে। তাদের গুজবে কখনো দেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যায় তো কখনো লসএঞ্জেলেস। অথচ মানুষ যখন রেল-লাইনে লোহার পাতের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করায় রেল-দুর্ঘটনায় মারা যায়; তখন জনগণ বুঝতে পারে 'বাংলাদেশ'-এর চলতি মানই নেই পরিবহন ব্যবস্থায়। এরফলে সহমত ভাইদের বিশ্বাসযোগ্যতা শূন্যের কোঠায় চলে যায়। ফলে তারা যখন 'গুজব নিবারণী সংঘ' হয়ে নেমে এসে 'এটা গুজব নয়' বলে; জনগণ তাদের অবিশ্বাস থেকে তখন গুজবকেই 'সত্য' ভাবে। এর মানে হচ্ছে, নিজেদের বড় করে দেখাতে গিয়ে দিনের পর দিন গুজব ছড়িয়ে আজ জন-আস্থা হারিয়েছে সরকারি সমর্থকেরা।

যে দেশের ইতিহাসে যুদ্ধের মতো অনিশ্চিত ঘটনার নজির আছে; সেখানে যে কোন গুজবে প্যানিক তৈরির অনুকূল পরিবেশ থাকে। জার্মানিতে আজো একটু লম্বা ছুটি থাকলে মানুষ যুদ্ধের স্মৃতির প্যানিক থেকে বাজারে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রয়োজনের অনেক বেশি পণ্য কেনে। কাজেই এরকম প্যানিক বাংলাদেশে তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এ হচ্ছে জীনগত অনিশ্চয়তার বোধ।

আর বাংলাদেশ নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হওয়া দেশ। ফলে জনমানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা জীবনের সঙ্গে মিশে থাকা একটি উপাদান। কাজেই গুজব তৈরি হলেই জনগণকে দায়ী করে মুঠি পাকিয়ে আসাটা হচ্ছে; নিজেদের ব্যবস্থাপনার অক্ষমতা ঢাকতে অন্যের ওপর দোষ চাপানোর রাজরোগ।

রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকতে গেলে; জনগণের সঙ্গে সুব্যবহারের সংস্কৃতি রপ্ত করতে হবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যদের। জনগণকে নিশ্চয়তার বোধ দিতে হবে; তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে। কারণ রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর হারিয়ে যাওয়া আস্থা পুনরুদ্ধার সবচেয়ে কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজটি করতে পারলে 'গুজব'-এর প্রভাব আপনা-আপনি কমে আসবে।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ