আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

Advertise

সাইবার অপরাধে দায়মুক্তির সংস্কৃতি

সাব্বির খান  

‘সাইবার অপরাধ’ শুধু বাংলাদেশে নয়; সারাবিশ্বেই বহুল পরিচিত দু’টি শব্দ। বিশ্বের শিক্ষিত সাইবার অপরাধীরা নিজের পরিচয়কে আড়াল করার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়ে থাকেন, যার মধ্যে প্রক্সি-সার্ভার থেকে অটো জেনারেটেড আইপি অ্যাড্রেসের (IP Adress) ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।



সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অবশ্য নিজেকে আড়াল করার উপায়টা ভিন্ন। এক্ষেত্রে সাইবার অপরাধীরা নিজেদের আসল নাম বা পরিচয় গোপন রেখে ফেইক আইডি বা ভুয়া নাম, ঠিকানা ব্যবহার করে থাকেন। এক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটিত হলেও সাধারণের পক্ষে অপরাধীকে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।



তবে এ-ধরনের অপরাধ শনাক্তের জন্যও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তি, যা সাধারণত সাধারণের নাগালের বাইরে বিধায় সচরাচর অপরাধীরা যেকোনো অনৈতিক কর্ম সম্পাদনের পর সহজেই পার পেয়ে যেতে পারেন।



এসব সামাজিক মাধ্যমের অনৈতিক অপব্যবহারের কারণে ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সামাজিক জীবনে ঘটছে বিপর্যয়, যার ধরন এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্যের সাথে চিরপরিচিত ভূ-বাস্তবতার মিল নেই। স্বভাবতই এর প্রতিকারের বিষয়েও দেখা দেয় বিভিন্ন ধরনের বিপর্যয়। তবে এক্ষেত্রে ব্যক্তি তথা সামাজিক সচেতনতাকে অগ্রগণ্য মনে করাই সম্ভবত প্রতিকারের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এছাড়াও প্রযুক্তির সঠিক এবং যৌক্তিক ব্যবহারবিধি জানাও খুব প্রয়োজনীয়, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অগ্রাহ্য করার প্রবণতা লক্ষণীয়।



সাইবার অপরাধ সম্পর্কে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে যেসব তথ্য জানা যায়, বাস্তবে তার ব্যাপকতা আরো অনেক বেশি। অপরাধীদের তৎপরতা সাইবার জগতের হলেও ভূ-রাজনীতিতে তাদের ক্ষমতার বলয় এতো বেশি গভীরে যে, সাধারণ ভুক্তভোগীদের অভিযোগ আইনি-সংস্থাগুলো খুব একটা আমলে নিতে তৎপর হন না। অপরাধ প্রতিকারে সরকারের ভিতরের বিভিন্ন সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা এবং অভিজ্ঞতার অভাব এতটাই প্রকট যে, অপরাধীরা অপরাধ সংঘটনে হয়ে ওঠে আরো বেশি ভয়ঙ্কর এবং শক্তিশালী।



সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ‘সিপি গ্যাং’ নামে সরকার সমর্থিত একটি সংগঠনের বিভিন্ন অপকর্মের খবর প্রকাশ হয়। তাদের লাগামহীন অপরাধের বিবরণ দেখে যেকোনো সুস্থ মানুষও অসুস্থ হতে বাধ্য। তবে যে বিষয়টি উত্তপ্ত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে তা হলো—তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে উদ্ভাবনী কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে অনুদান পেয়ে ফেইসবুকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার সমর্থকদের ইন্টারনেটভিত্তিক সংগঠন ‘সিপি গ্যাং’।



‘সিপি গ্যাং’ নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণাকারী বলে দাবি করলেও, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরাই মূলত তাদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। সেক্ষেত্রে নারীরাও রক্ষা পাননি বলে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য যে, ‘সিপি গ্যাং লিমিটেড’ নামের সরকার সমর্থিত এই সাইবার সংগঠনটি অনুদান হিসেবে চার লাখ টাকা পেলেও ঘোষণার পাঁচদিন পরে সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগ সিপি গ্যাংকে দেয়া অনুদান বাতিল ঘোষণা করে।



তথ্যপ্রযুক্তির উদ্ভাবন তহবিল থেকে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের অনুদান দেয়া হয়। তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন উদ্ভাবনী ধারণা নিয়ে আবেদন আহ্বান করা হয়। পরে আবেদনকারীদের উদ্ভাবনী তহবিল কমিটির সামনে ধারণা উপস্থাপন করতে হয়। সবশেষে কমিটি কর্তৃক নির্বাচিত আবেদনকারীদের অনুদান দেয়া হয়। সিপি গ্যাং অনুদান পাওয়ার লক্ষ্যে ‘ডিজিটাল ডাটাবেজ ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম’ শিরোনামে একটি প্রজেক্ট পেপার জমা দেয় কর্তৃপক্ষ বরাবর যা চূড়ান্ত অনুমোদন পায় এবং চার লাখ টাকা অনুদান পায়।



সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটা সংস্থা যখন অনুদান দেয়ার জন্য একটা প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন করে, তখন প্রথমত প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব আছে কিনা এবং সংগঠনটির বিভিন্ন কার্যক্রম সম্বন্ধে জানার আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে তার কিছু যে করা হয়নি, তা তাঁদের অনুদান ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া দেখেই প্রমাণ হয়। সেইসাথে সিঁদ-কেটে জন্ম নেয় একটি অপরাধ, যার দায়ভার বর্তায় অনুদানদাতা এবং গ্রহীতা দু’পক্ষের উপরেই।



এক্ষেত্রেও একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয় যে, সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ কোনো সুস্থ ও যৌক্তিক বিবেচনা ছাড়াই একটি সংগঠনকে অনুদান দেয়ার জন্য নির্বাচন করেন, যাদের সত্যিকার অর্থে কোনো সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। এক্ষেত্রে সবকিছুই ঘটেছে অনেকটা ‘ব্যাঙ্কে চেক জালিয়াতি’-র মতো। কর্তৃপক্ষ অনুদান দিয়ে তা আবার ফিরিয়ে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু প্রক্রিয়াগত যে অপরাধ এরই মধ্যে সংঘটিত হয়েছে, তার কোনো তদন্ত করার আগ্রহ তাঁরা দেখাননি।



সংবাদমাধ্যমের খবরগুলো পড়ার পরে যে কারো মনে স্বভাবতই একটি সংঘবদ্ধ চক্রের অপরাধের কথাই মনে করিয়ে দেবে। যে প্রশ্নগুলো জনস্বার্থে গণমাধ্যমে প্রকাশ করা উচিত ছিল তা হলো—
১. কে বা কারা এই প্রজেক্ট পেপার জমা দিয়েছিলেন?
২. প্রজেক্ট পেপারের সাথে যে ফরোয়ার্ডিং লেটার দেয়া হয়েছিল তাতে কি লেখা ছিল?
৩. সংগঠনের জন্য প্রজেক্ট পেপারের উপরে কার বা কাদের সুপারিশ ছিল?
৪. যেহেতু একেবারে জিরো থেকে হিরো পর্যায়ে নিয়ে ভুঁইফোঁড় নটোরিয়াস একটা সংগঠন সিপি গ্যাংকে অনুদান দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, সেক্ষেত্রে উচ্চপর্যায় থেকে কোন ধরনের তদবির ছিল কিনা?
৫. যেই সংগঠনের নামের শেষে ‘গ্যাং’ লেখা থাকে, সেই সংগঠনের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি কেন?
৬. এই সংগঠন যেহেতু একটা কোম্পানি, সেহেতু তাদের রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল কি না?
৭. যেহেতু সিপি গ্যাং লিমিটেড একটা কোম্পানি, সেহেতু এই কোম্পানির পরিচালকমণ্ডলীতে কারা আছেন এবং তাঁদের নাম কী? ইত্যাদি।



অনুদান দিয়ে ফেরত নেয়ার মানে দাঁড়ায় একটাই যে, জেনে হোক বা না জেনে হোক, সংগঠিত একটা অপরাধ ঘটেছে। সেজন্য জনস্বার্থে তদন্ত সাপেক্ষে উপরের এই প্রশ্নগুলোর জবাব পাওয়ার চেষ্টা করে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের নৈতিক দায়িত্ব ছিল। ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। ফেইসবুকে অশালীন মন্তব্য করার অভিযোগে তথ্য-প্রযুক্তি আইনে এক মামলায় সরকার সমর্থকদের ইন্টারনেটভিত্তিক সংগঠন ‘সিপি গ্যাং’-এর এক সদস্যকে গ্রেপ্তারের কথা জানা গিয়েছে সংবাদমাধ্যমে। বিষয়টি সরকার এবং অনুদান বিতরণ কর্তৃপক্ষের জন্যে নিঃসন্দেহে ছিল বিব্রতকর।



ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে যে সরকার বিরামহীন কাজ করে চলেছে, সে সরকারের জন্য ঘটনাগুলো নিশ্চয়ই অসম্মানজনক এবং বিব্রতকর। অথচ ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা ঘটিত অপরাধকে আশ্রয় এবং প্রশ্রয় দিয়ে পক্ষান্তরে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার সরকারকে ধারাবাহিকভাবে অপমান করা হয়েছে।



সাইবার অপরাধ সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ভয়াবহভাবে গ্রাস করতে পারে, যদি শুরুতেই সতর্ক না থাকে সরকার। দেশকে ডিজিটাল করাই শেষ কথা নয়, একে রক্ষা করাটাও অতি গুরুত্বপূর্ণ।

সাব্বির খান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কলাম লেখক ও সাংবাদিক। ইমেইল : [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ