আজ মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

রূপকথা চুপকথা

আবু সাঈদ আহমেদ  

রূপকথা আসলে রূপকথা নয়। রূপকথা তবে কি? রূপকথা হল চুপকথা, অর্থাৎ যে কথা চুপিচুপি বলতে হয়। চুপিচুপি বলার থেকে চুপ থাকা আরো ভালো। কিন্তু মানুষ চুপ থাকবে কেন! সে কথা বলবেই। সে চুপ না থেকে কথাটি বলবে চুপিচুপি। কিন্ত কতক্ষণ আর চুপিচুপি কথাটি চুপিচুপি বলে মন ভরে! আবার প্রকাশ্যে বলাও হিতে বিপরীত হতে পারে।



এদিকে চুপ থাকার অভ্যাস তো মানুষের চরিত্র নেই। তাই সে চুপিচুপি বলার কথাটা প্রকাশ্যে ভিন্নভাবে ও ভিন্নরূপে বলে। গল্প বানিয়ে ছড়িয়ে দেয় মুখে মুখে। মানুষের চুপ না থাকার স্বভাবই চুপকথাকে রূপকথায় রূপ দিয়েছ।



২.
দক্ষিণারঞ্জন মিত্র হতে শুরু করে উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী পর্যন্ত যে সকল বাংলা রূপকথা সংগ্রহ করেছেন- সেগুলো সাধারণ পাঠে ছেলেভুলানো রূপকথাই মনে হয়। কিন্তু একটু গভীর পাঠে ছেলেভুলানো রূপটি আর থাকেনা। অতি সাধারণ মানুষের সংগ্রাম, দূর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার, দূর্বলের দ্রোহ-জয়-পরাজয়, ভালো শাসকের প্রতি প্রজার আনুগত্য ও মন্দ শাসকের প্রতি ঘৃণা, প্রতিদিনের জীবনযাপন- এসবই রূপকথার উপজীব্য, বর্ণিত আখ্যান। যে কথাগুলো মানুষ সহজে বলতে পারে না তা রূপকের মাধ্যমে গল্পের আকারে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। মুখ থেকে মুখে সমৃদ্ধ হয়েছে।



৩.
অত্যাচারী রাজা বা জমিদারের বিরুদ্ধে কথা বলার ফলাফল ভালো হবেনা- কিন্তু মানুষ অত্যাচারীর বিরুদ্ধে কথা বলবেনা তা হতে পারেনা। তাই তারা গল্প বানিয়েছে। সেসব গল্পে হাজির থাকে টোনাটুনি, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গামি-, রাক্ষস-খোক্ষস, ডাইনি, সাধু সন্ন্যাসী আর একজন ভালো রাজপুত্র বা সাধারণ ভূমিপুত্র। এই রাজপুত্র বা ভূমিপুত্র সকল প্রতিবন্ধকতা জয় করে রাজসিংহাসনে বসে, প্রজাদের আর কোন দু:খ থাকেনা। সেই অনাদিকাল হতেই প্রজার স্বপ্ন ফুটে ওঠে এসব ছেলেভুলানো রূপকথার আদলে।



দুয়োরানী আর সুয়োরানী, ধুরন্ধর মন্ত্রী বা কোটাল- এরা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রেরই রূপক। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের এই গল্পগুলোতে সত্যের জয় হয়, তবে অনেক ত্যাগ আর তিতিক্ষার পরে। রাজার অযোগ্য পুত্র আর তার কর্মকান্ডও বাদ যায় নাই রূপকথা থেকে। কোন রাজা? ঐ যে তেপান্তর আর সাত সমুদ্রের পাড়ে ছিল একদেশ। সেই দেশের ছিল এক রাজা। আদতে এই দেশটা কিন্তু গল্প কথকেরই দেশ আর রাজাও গল্প কথকের দেশেরই রাজা।



৪.
এক ছিল টোনা আর এক ছিল টুনি। টোনার পিঠে খাবার শখ। টুনি তাকে ধরিয়ে দেয় বাজারের ফর্দ। বাজার করে ফেরার পথে সেধে সেধে দাওয়াত নেয় বাঘ মহাশয়। নিরুপায় টোনা বাঘকে না করতে পারেনা। সময়মত পিঠে খেতে টোনার বাসায় বাঘ হাজির। কিন্তু টোনার বাড়ি খালি। পিঠে খেয়ে টোনা তার টুনিকে নিয়ে উড়ে গেছে বহুদূরে। বাঘ বিফল হয়ে রাগে ক্রোধে ফিরে যায়। অতি প্রচলিত রূপকথা। কিন্ত এ গল্পের ছেলেভোলানো অংশটির গভীরে গেলে দেখা যাবে অন্যচিত্র। টোনাটুনিকে ধরে নেই সাধারণ মানুষের আর বাঘকে শক্তিশালী মানুষের প্রতীক।



তবেই কিন্তু রূপকথাটির ভিতরের চুপকথাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গল্পটির মাঝে সেই সময়ের সাধারণ মানুষের অবস্থার যে চিত্র ফুঁটে ওঠে-
ক) সাধারণ মানুষের কাছে পিঠা একটা বিলাসী খাদ্য, যা সবসময় খাবার সামর্থ্য তাদের নেই
খ) শক্তিশালী বা ক্ষমতাবান মানুষের ইচ্ছের কাছে সাধারণ মানুষ নতজানু
গ) সাধারণ মানুষ ক্ষমতাবানের কাছ থেকে নিজেদের খাদ্য এবং জীবন বাঁচাতে ভিটেমাটি ছেড়ে যায়, পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।



শিয়াল পন্ডিত কুমিরের সাত ছানার মধ্যে ছয়টাকে খেয়ে বাকী একটাকেই সাতবার দেখায়- এখানে বাবু বা জমিদার গোষ্ঠীর ধুরন্ধর চরিত্র রূপকের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। রাজার বাড়ির পাশে ছোট গাছে টুনির বাড়ি। রাজা বারান্দায় তার টাকশালের টাকা শুকো দিয়েছেন। টুনি একটা টাকা বাসায় নিয়ে গিয়ে গান গাইছে - রাজার ঘরে যে ধন আছে/আমার ঘরে সে ধন আছে। তারপর রাজা এই টুনির কাছ থেকে পয়সা ফিরিয়ে নেয়। টুনি প্রতিবাদ করলে টুনিকে হত্যা করার চেষ্টা করে। টুনিকে হত্য করতে গিয়ে রাজা তার সাতরাণীর আর নিজের নাক বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়।



এই গল্পটি এক অত্যাচারী রাজার বিরুদ্ধে একজন সাধারণ যোদ্ধার উপখ্যান। যে যোদ্ধা বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় রাজার কাছ থেকে নিজের ন্যায্য পাওনা আদায় করে নেবার মন্ত্রে উজ্জিবীত হয়ে লড়াই করে যায়। রাজা প্রবল শক্তিশালী হয়েও পরাজিত হয়। সাত রানীর নাক কাটার সাথে সাথে নিজের নাকটাও বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়।



পাঠক প্রচলিত প্রতিটা রূপকথা গভীরভাবে পাঠ করলেই গল্পের ভিতরের চুপকথাটি অনুভব করতে পারবেন।



৫.
মানুষের সীমাবদ্ধতা এই যে- সে অর্থহীনভাবে কিছুই সৃষ্টি করতে পারেনা। তার চরম কাল্পনিক ভাবনার ভিত্তিও বাস্তবতার গভীরে প্রোথিত। মানুষ যখন পঙ্খিরাজ ঘোড়া কল্পনা করে তখন সে আসলে ঈগল বা চিলের উড়বার ক্ষমতার সাথে ঘোড়ার তীব্র গতির দৌড়ের মিশ্রণ ঘটায়- তাই পঙ্খিরাজ ঘোড়া সকল বাধা পেরিয়ে দৌড়ে বা উড়ে যায়। ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গামি হলো সাধারণের জৌতিষ, কালজ্ঞ। রাক্ষস-খোক্ষস-ডাইনি- অশুভ অজানা শক্তি আর অত্যাচারী রাজা জমিদার বা শক্তিমানের প্রতীক। অর্থাৎ রূপকথার চরিত্রগুলো বাস্তব চরিত্রের রূপান্তর, নিছক কল্পনা বিলাস নয়। সাধারণ মানুষ আনন্দে বা কষ্টে নিরেট বাস্তবকে কল্পনা ও রূপকের মিশেল দিয়ে গল্প রচনা করেছে, সেই গল্প মুখে মুখে ফিরে ফিরে সমৃদ্ধ হয়েছে। যুগে যুগে সাধারণ মানুষ রূপকথাকে আপন করে নিয়েছে কারণ অবচেতনভাবে রূপকথায় সে নিজেকে আর নিজের সময়কেই খুঁজে পেয়েছে।



৬.
প্রতিটি রূপকথাই চুপকথা। প্রতিটি রূপকথার ভিতরে চুপ করে আছে যাপিত জীবন আর সময়ের উপখ্যান। রূপকথার গভীরে ঘুমিয়ে থাকা চুপকথাগুলো কখনই জেগে উঠবেনা, আমরা যদি জাগিয়ে না তুলি!

আবু সাঈদ আহমেদ, লেখক, কলামিস্ট, অনলাইন এক্টিভিস্ট।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ