আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

অসির বিরুদ্ধে মসীর লড়াই

বন্যা আহমেদ  

২ জুলাই, ২০১৫ ব্রিটিশ হিউম্যানিস্ট এসোসিয়েশন আয়োজিত এই বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘ভলতেয়ার বক্তৃতা’ দেবার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও অভিজিৎ, বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মুক্তমনা আন্দোলন নিয়ে কথা বলতে তাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম। ইংরেজিতে লেখা আমার বক্তৃতাটি মুক্তমনা পাঠকদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করা হল।



শুভসন্ধ্যা সবাইকে।
শুরুতেই ঐতিহ্যবাহী ব্রিটিশ হিউম্যানিস্ট এসোসিয়েশনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাকে আপনাদের সঙ্গে আজকে কথা বলতে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য।



আমার প্রয়াত স্বামী ডক্টর অভিজিৎ রায় এবং আমি বাংলাদেশি-আমেরিকান নাগরিক, মানবতাবাদী এবং আমরা বাংলাদেশে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা ইসলামি মৌলবাদের সাম্প্রতিক শিকার। অভিজিৎ এবং আমি, এ বছর ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখে, অমর একুশে জাতীয় বই মেলায় অংশ নিতে আমাদের জন্মস্থান বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। এটি বাংলাদেশের মাসব্যাপী উদযাপিত জাতীয় বই উৎসব, হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করে এই মেলায়।



ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখ রাতে জনাকীর্ণ এবং আলোয় আলোকিত বই মেলা থেকে আমরা যখন গাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম, তখন ইসলামি মৌলবাদীদের একটি দল অভিজিৎ এবং আমার উপর চাপাতি দিয়ে নৃশংসভাবে হামলা চালায়। রাস্তার ধারে আমাদের কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়। আক্রমণের এলাকাটি বহু পুলিশ এবং নিরাপত্তা ক্যামেরা দিয়ে ঘেরা ছিল। হাজার হাজার মানুষও ছিল সেখানে। কিন্তু কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। কাছেপিঠে পুলিশও দাঁড়িয়েছিল। একজন তরুণ সাংবাদিক আমাদের রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যান, তার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।



হাসপাতালে নেবার পর অভিজিৎ মারা যায়। ঘাড় ও মাথার চার জায়গায় চাপাতির কোপে গুরুতর জখম হলেও প্রাণে বেঁচে যাই আমি। তবে হারাতে হয় একটি বৃদ্ধাঙুল; ক্ষতবিক্ষত হয় আমার দুই হাত, আঙুল এবং শরীরের বেশ কিছু জায়গা। ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ু এবং শিরা-ধমনী ঠিক করতে এর মধ্যেই একাধিকবার অপারেশন করতে হয়েছে। ঘটনার চার মাসের একটু বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পর এখনও আমার চিকিৎসা চলছে।



অভিজিৎ এই চাপাতিবাজ খুনিদের সবচেয়ে নামকরা শিকার হলেও ও প্রথম শিকার নয়, এমনকি শেষও নয়। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ওকে হত্যার পরপরই ইসলামি মৌলবাদীরা আরও দুজন বাংলাদেশি মানবতাবাদী ব্লগার-লেখককে একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে; অর্থাৎ কয়েক জন মিলে একইভাবে রাস্তার ধারে পেছন থেকে চাপাতি দিয়ে আক্রমণ করে। ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ৩০ মার্চ। পুলিশ নয়, উপস্থিত জনগণ দুজন আততায়ীকে ধরে ফেলে। পরবর্তীতে তারা স্বীকার করেছে যে, ওয়াশিকুরের কোনো ব্লগ না পড়েই মাদ্রাসার হুজুরের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমি আবার পরে আসছি।



এরপর ১২ মে অনন্ত বিজয় দাশকে হত্যা করা হয়। অভিজিতের মতো অনন্তও বিজ্ঞান ও দর্শন নিয়ে লেখালেখি করত এবং ‘যুক্তি’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করত। ও আমাদের খুব কাছের মানুষ ছিল, আমাকে বন্যা আপা ডাকত এবং একসঙ্গে অনেক বছর ধরে কাজ করেছে আমাদের সঙ্গে। যতদূর জানি, এখন পর্যন্ত ৮ জন সেক্যুলার কর্মী, ব্লগার ও লেখকের উপর আক্রমণ চালিয়েছে ওরা। এদের মধ্যে রয়েছেন, ২০১৪ সালে প্রফেসর শফিউল ইসলাম, ২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজিব হায়দার, ২০১৩ সালে আসিফ মহিউদ্দিনের উপর ব্যর্থ আক্রমণ; আর ২০০৩ সালে হুমায়ুন আজাদের উপর আক্রমণ তো আছেই।



এই হচ্ছে এখনকার ‘বাস্তবতা’। এবার আমি অভিজিতের জীবন, তার কাজকর্ম, লেখালেখি এবং আমাদের একসঙ্গে কাটানো জীবন সম্পর্কে কিছু বলব। তারপর আবার ফিরে আসব সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায়।

আগে দুটো ব্যাপার উল্লেখ করে নিই। প্রথমত, ইংরেজি আমার দ্বিতীয় ভাষা, যদিও বেশ কিছুদিন ধরেই এ ভাষায় কথা বলছি। আমার ইংরেজি উচ্চারণ বাংলাদেশি ইংরেজি, দেশে আমদানিকৃত হাজারও মার্কিন সিটকম, কানাডিয়ান, মিনেসোটান এবং সর্বোপরি আমাদের ‘সুপ্রিয়’ বাইবেল বেল্ট তথা ইউএসএএর দক্ষিণাঞ্চলের উচ্চারণের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। যদি আমার কথার কিছু বুঝতে আপনাদের সমস্যা হয় সেটা দয়া করে লিখে রাখবেন। বক্তব্য শেষে জিজ্ঞেস করলে আমি সানন্দে ব্যাখ্যা করব।



আর দ্বিতীয় ব্যাপারটা হচ্ছে, আমি খুবই, জানি না এখানে সঠিক শব্দটা কী হবে, আমি এখন খুবই বিক্ষিপ্ত, আমার জীবন বিক্ষিপ্ত, খুবই বিক্ষিপ্ত আমার মানসিক অবস্থা। অভিজিতের মৃত্যুর পর মাত্র ৪ মাস পেরিয়েছে। ও ছিল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, ছিল আমার সব ভালো এবং মন্দ কাজের সঙ্গী– সুখে-দুঃখে, দ্বন্দ্ব-সংঘাতে এবং ভালোবাসায়।



অভিজিৎ, অভি বলেই ওকে ডাকতাম আমি, ২০০১ সালে যখন সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়ো-মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংএ পিএইচডি করছিল, তখনই বাংলায় প্রথম ‘মুক্তমনা’ নামে মুক্তচিন্তার একটি প্লাটফর্ম গড়ে তোলে। মুক্তমনা শুধু একটা ব্লগ ছিল না, ছিল একটা মঞ্চ, একটা গোষ্ঠী। খুব অল্প সময়ে মুক্তমনা বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতাবাদী আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।



অভির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় ২০০২ সালে, এই মুক্তমনার মাধ্যমেই। এরপর থেকে বেশিরভাগ প্রকল্প এবং লেখালেখি আমরা মিলেমিশেই করতাম। আমরা একত্র হয়েছিলাম মানবতাবাদের নীতিতে। কিন্তু আবার কিছু মৌলিক বিশ্বাস এবং নীতিগত অবস্থানের ব্যাপারে আমাদের তীব্র মতবিরোধও ছিল, আমরা সেগুলো নিয়ে বিতর্ক করতাম। আমার ধারণা, যে কোনো মানবতাবাদী ব্যক্তি সেটা করতে বাধ্য।



আমরা লেখালেখি, বিশেষ করে মানবতাবাদের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে এতটাই প্রাণ ঢেলে বিতর্ক করতাম যে, অনেক দিন পর্যন্ত আমাদের মেয়ের ধারণা ছিল যে, আমরা বুঝি সারাক্ষণ ঝগড়া করি! তার বেশ কয়েক বছর লেগেছিল এটা বুঝতে যে, আমাদের এই ঝগড়ারূপী বেশিরভাগ আলোচনা, সব নয় অবশ্যই, মূলত দার্শনিক বিতর্ক, দাম্পত্য কলহ নয়।



অভি ছিল নাস্তিক, ব্লগার, লেখক, সর্বোপরি একজন ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী যার আগ্রহ ছিল জীবনের মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর অনুসন্ধান। বিজ্ঞান নিয়ে লিখতেই সবচেয়ে ভালোবাসত ও; শেষ বইটা লিখেছিল শূন্য থেকে কেমন করে মহাবিশ্বের উৎপত্তি হতে পারে তার সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক ধারণা নিয়ে। অভি বই লিখেছে জীবনের উৎপত্তি নিয়ে; সমকামিতার বৈজ্ঞানিক কারণ নিয়ে, ভালোবাসা নিয়ে– অবশ্যই বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে।



সাহিত্য নিয়ে খুব আগ্রহী ছিল অভি, একটা বই লিখেছিল কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর আর্জেন্টিনিয়ান নারীবাদী লেখক ভিকতোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে। কিন্তু ওর দুটি বই, ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ এবং ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ পাঠকপ্রীতি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি, আলোচিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। একদিকে এই বই দুটোর কারণে ও খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে বাংলাভাষী মুক্তমনা পাঠকদের কাছে, আবার ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের কাছে হয়েছে চরম ঘৃণা আর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু।



আমরা বাংলায় লেখালেখি করতাম; কারণ আমরা বিজ্ঞান, দর্শন ও শিল্প-সাহিত্যের মৌলিক এবং অত্যাধুনিক বিষয়গুলো এই ভাষাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম। কয়েক বছর আগে আমি ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ নামে জৈব-বিবর্তনের উপর বই প্রকাশ করি। অভি বেঁচে থাকতে অসংখ্য প্রবন্ধ, ব্লগ লিখেছিল। লেখালেখি ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান, জীবন; সত্যি বলতে সে কথায় নিজেকে যতটা না ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারত তার চেয়ে ঢের ভালো পারত লিখে প্রকাশ করতে। এমনকি সে মুখের ভাষায় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে এতটাই ব্যর্থ হত যে, আমরা আমাদের এই ১৩ বছরের ছোট্ট কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর জীবনে প্রায় হাতে লেখা চিঠি আদান-প্রদান করতাম নিজেদের মাঝে।



অভিজিৎ শুধু বিজ্ঞান ও নাস্তিকতা নিয়েই লিখত না, সব রকম কুসংস্কার, অবিচার, অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক বিশ্বাসের বিরূদ্ধেও লিখত। ও লিখত সমাজের সকল অবিচার ও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে, ওর লেখার বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তি ছিল সীমাহীন। ও লেখালেখি করেছে নারীঅধিকার (হাইপোশিয়ার উপর একটি হৃদয়গ্রাহী নিবন্ধ লিখেছিল) থেকে শুরু করে, জাতীয়তাবাদ, ইসলামি মৌলবাদীদের দ্বারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠিত গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচার, ইরাক যুদ্ধের প্রতিবাদ, আবু গারাইব কারাগারের নির্যাতন, গুজরাট ও প্যালেস্টাইনে গণহত্যা, এমনকি বাংলাদেশ সরকার ও সামরিক বাহিনীর দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর উপর নিয়মতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী নির্যাতনের বিরদ্ধে।

 



গত বছরের শুরুতে আমেরিকার ইউএনসি চ্যাপেল হিলে গোলাগুলির বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করেছিল, ফেসবুকে নাস্তিকতার প্রচার চালাত এমন এক ব্যক্তি এক এপার্টমেন্টে তিনজন শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ প্রসঙ্গে অভি লিখেছিল:


‘‘নাস্তিকতার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অতিপ্রাকৃত দেবদেবীতে বিশ্বাস না রাখা। অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক বিশ্বাস নাস্তিকের থাকা উচিত নয়। স্রেফ নাস্তিক হলেই একজন সব রকম বিদ্বেষ ও ঘৃণা থেকে মুক্ত হয়ে যায় না, যদি না তার মানবতার প্রতি সহানুভূতি থাকে। কেউ ধার্মিক কী ধার্মিক নয় সেটা ব্যাপার নয়, অসহিষ্ণুতার উপস্থিতি সর্বত্র। ইতিহাসে দেখা যায়, এমন অনেক ধর্মহীন হৃদয়হীন স্বৈরাচারী শাসক ছিল যারা অসংখ্য স্বদেশীকে হত্যা করেছে। আমরা এখন জানি, ক্রেইগ স্টিফেন হিক্স নামক একজন আছে যে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা ধারণ করে। এইসব অপরাধীর কোনো ধরনের সহানুভূতি বা অজুহাত প্রাপ্য নয়। এনসি চ্যাপেল হিলের হত্যাকাণ্ড অমানবিক এবং প্রতিটি বিবেকবান মানুষের উচিত এই ঘটনার ভর্ৎসনা করা।’’



যদি ফ্রেডরিক নিটশে এখানে থাকতেন তাহলে হয়তো বলতেন, অভিজিৎ, ‘বিজ্ঞানকে দেখেছিল শিল্পীর চোখে আর শিল্পকলাকে জীবনের প্রেক্ষাপটে’— অর্থাৎ বিজ্ঞান ছিল ওর ধ্যান-জ্ঞান যা দিয়ে ও জীবনের মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজত আর শিল্পকলা ওর কাছে স্রেফ বিমূর্ত মূল্যহীন কিছু ছিল না বরং ছিল জীবনযাপনের সবচেয়ে বড় প্রভাবক।



অভি ছিল আলাভোলা ভালো মানুষ, গায়ক হিসেবে বড্ড বেসুরো, জীবনের বাস্তবতায় কিছুটা উদাসীন। একই সঙ্গে ছিল আদর্শ পিতা, ছিল আমাদের মেয়ের অনুসরণীয় চরিত্র এবং সবচেয়ে কাছের বন্ধু। অভিজিৎ খুব ভালো করে জানত ও কী চায়; জানত কী করছে এবং কতদূর যাবে। ও জানত, মাথা তুলে দাঁড়াবার ঝুঁকি কত বড়। একটা লেখায় ও বলেছিল:


‘‘যারা ভাবেন বিনা রক্তে বিজয় অর্জিত হবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের মতো জিনিস নিয়ে যখন থেকে আমরা লেখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালেখি করছি।’’



এই উক্তি আমাদেরকে নিয়ে আসে আরও বিস্তৃত প্রসঙ্গে, গভীর ইতিহাসে। কেন এবং কীভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হল? কাগজে-কলমে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে মানবতাবাদী-ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের রাস্তায় কুপিয়ে মারা হচ্ছে কেন?



আমেরিকার দক্ষিণে আমাকে প্রায়ই এক ধরনের শূন্য দৃষ্টির সম্মুখীন হতে হয় যখন কাউকে বলি আমার আদি নিবাস বাংলাদেশে। আমি জানি আপনারা তেমন নন, তারপরও স্মৃতিটা একটু ঝালিয়ে নিচ্ছি। দুশ’ বছর ধরে বাংলা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ভারতীয় উপমহাদেশের একটা অংশ। ১৯৪৭ সালে এই উপনিবেশ দু’দেশে বিভক্ত হয়, ভারত এবং পাকিস্তান নামে। তড়িঘড়ি টানা সে সীমানা নির্ধারিত হয়েছিল ইসলাম এবং হিন্দুধর্মের বিভাজনের উপর ভিত্তি করে। ধর্মীয় এই বিভেদে প্রাণ যায় লক্ষাধিক মানুষের এবং দেশান্তরিত হয় কোটি মানুষ, যা কিনা ইতিহাসে মানুষের সর্বোচ্চ দেশান্তরের দৃষ্টান্ত।



ভারত-পাকিস্তানের এই বিভাজন শুধু দু’দেশের বিভাজনই ছিল না। পূর্ব বাংলা, যেটা পাকিস্তানের পূর্ব অংশ সেটার ও পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের মাঝে হাজার মাইল বিস্তৃত ভারতীয় অঞ্চল ছিল। পূর্বের মানুষের সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ও ছিল ভিন্ন। বাংলায়, বাঙালি এবং মুসলিম এই দুই আত্মপরিচয়ের এক ধরনের মিশেল ইসলাম প্রচারের ব্যাপার ছিল প্রথম থেকেই। অবশ্য বাঙালি সাংস্কৃতিক চেতনা বাঙালির মনের এত গভীরে প্রোথিত যে, এটা অবশ্যম্ভাবী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণ এ অঞ্চলের মানুষ এক সময় আর মেনে নেবে না। যার কারণে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর এ অঞ্চলের জনমানুষের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাও সৃষ্টি হতে শুরু করে।



পাকিস্তান সরকার যখন বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল তখন তরুণ বাঙালিরা তাদের জীবন দিয়ে এর প্রতিবাদ করেছে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার সংগ্রামে প্রাণ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের স্মৃতির সম্মানে, আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবস পালন করি (যেটা বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়), মাসব্যাপী ভাষার উৎসব করি, বই মেলা করি, যে বই মেলা প্রাঙ্গনে নিহত হয়েছে অভিজিৎ।



১৯৭১ সালে নয় মাসের দুঃসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যার নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নতুন সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র মৌলিক নীতি হিসেবে গৃহীত হয়, যদিও কোনোটাই ফলপ্রসূভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে এক অভূতপূর্ব মুসলিম আত্মপরিচয়ের উদ্ভব হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাদ দিয়ে ‘আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা’ এবং ‘গণতন্ত্র’ বাদ দিয়ে সামরিক শাসন স্থাপিত হয়।



এত কিছুর পরও আমার মনে আছে, সেই আশির দশকে যখন আমরা কিশোর ছিলাম তখনকার বাঙালি মুসলিমরা বেশ উদারমনা ছিল, অন্তত বর্তমানের তুলনায়। কিন্তু ধীরে ধীরে রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট বদলেছে, বাংলাদেশে উত্থান হয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদের। এই উত্থানের এক বড় নিয়ামক হচ্ছে আন্তর্জাতিক ইসলামিক দল জামায়াতে ইসলামী। সময়ের পরিক্রমায় শুধু যে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বেড়েছে তা নয়, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা অর্থে— অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যও গড়ে তুলেছে তারা স্বাধীন বাংলাদেশে। জামায়াত রাজনীতিতে তাদের প্রভাব বিস্তার করে মূলত ধর্মীয় রক্ষণশীলতা পুঁজি করে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তি আর জনসমর্থন কাজে লাগিয়ে এখন তারা এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে। ফলে আমাদের সব সরকারই, সেক্যুলার বা নন-সেক্যুলার, কোনো না কোনোভাবে এদের কাছে মাথা নত করেছে এবং করছে।



বাংলাদেশে এখন শাসক দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ। কাগজে-কলমে তারা এদেশের বৃহত্তম ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল। কিন্তু রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার নামে, তারা বারবার ধর্মীয় মৌলবাদের কাছে মাথা নত করেছে, সাড়া দিয়েছে, পূরণ করেছে তাদের অযৌক্তিক দাবি-দাওয়া। যাকে বলে ভোটের আশায় স্রেফ ঘুষ দেওয়া। যদিও এবারের আগের বার তারা ক্ষমতায় এসেছিল কিছু সমকালীন ইসলামি দলের নেতৃবৃন্দ যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদেরকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।



সে প্রেক্ষিতে ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধ বিচার আদালত গঠিত হয়। বিচারের কাজ আলো পেতে শুরু করে ২০১২ এর শেষে। ২০১৩ এর শুরুর দিকে, ইসলামিস্টরা প্রচণ্ড চাপে পড়ে যায়; কারণ তারা জনসমর্থন হারাতে শুরু করে এবং তাদের প্রবীণ নেতারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে একে একে দোষী সাব্যস্ত হতে থাকে। এ প্রতিক্রিয়ায় ধর্মীয় মৌলবাদীরা নাস্তিকদের উপর তাদের আক্রোশ প্রকাশ করতে শুরু থাকে। যদি ধর্মীয় নেতাদের যুদ্ধাপরাধের কারণে মৃত্যুদণ্ড হয়— যেটা বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা— তাহলে যে সব ধর্মনিরপেক্ষ ও নাস্তিকেরা ধর্ম অবমাননা করে তাদেরকেও একই পরিণতির হুমকি দেওয়া শুরু করে তারা।



মৌলবাদীরা কয়েক বছর ধরে কয়েকটি হত্যার তালিকা তৈরি করেছে, যেখানে তারা রেখেছে বুদ্ধিজীবী, লেখক ও ব্লগারদের। যাদেরকে তারা পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চায়। সেটা তারা অনলাইনেও প্রচার করতে থাকে। ২০১৩ সালে ৮৪ ব্লগারের এক কুখ্যাত ‘তালিকা’ তৈরি করা হয় যা কিছু মূলধারার রাজনৈতিক দল সরকারের কাছে হস্তান্তর করে। তালিকাভুক্তদের ধর্ম অবমাননার দায়ে গ্রেফতার এবং মৃত্যুদণ্ডের দাবি তোলা হয় ইসলামপন্থী নানা মহল থেকে। তারা নতুন একটা ব্লাসফেমি আইনের প্রস্তাব করে (যা অবশ্যই আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে পড়ে না) যাতে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং মুক্তমনা মানুষ, লেখক ব্লগারদের উপর ইসলাম অবমাননার দায়ে আইনটি প্রয়োগ করার দাবি তোলে।



ব্লগারদের বিরুদ্ধে সকল মাধ্যমে অপ্রপ্রচার চালানো শুরু করা হয়; উস্কানিমূলক মন্তব্য, আহবান জানানো হয় ভালো মুসলমানদের এগিয়ে এসে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়ার জন্য। এখানে উল্লেখ্য যে, মধ্যযুগের ধর্মতাত্ত্বিক আল-গাজ্জালি একইভাবে সকল ‘ভালো’ মুসলমানকেই মুসলিম দার্শনিকদের হত্যার অধিকার দিয়ে রেখেছেন যারা কিছু আধিভৌতিক ব্যাপারে ভিন্নমত ধারণ করবে। অন্যভাবে বললে, রাজনৈতিক ইসলামিস্ট এবং জঙ্গি ইসলামিস্ট উভয়ে নিয়ম করে তাদের বিরোধীদের মৃত্যু-হুমকি দিচ্ছে এবং পালন করছে ভয়-ভীতি-আক্রমণের সংস্কৃতি।



এই পরিস্থিতিতে, শেখ হাসিনা সম্ভবত এসব অন্ধ মৌলবাদীদের থামিয়ে দিতে পারতেন। তিনি বলতে পারতেন, না, মানুষের প্রতিবাদ করার, লেখার, প্রশ্ন করার এবং সমালোচনা করার অধিকার আছে। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে তিনি বলেছেন:


‘‘আমাদের নতুন করে ব্লাসফেমি আইনের দরকার নেই; কারণ আমাদের ইতোমধ্যেই ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ দেওয়ার বিরুদ্ধে আইন আছে এবং এটা দিয়েই আমরা ব্লগারদের আইনের আওতায় আনতে পারব!’’

ফলে কর্তৃপক্ষ এই ব্লগারদের তালিকা পাবার পর, কর্মকর্তারা ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন এবং এই তালিকার চারজন ব্লগারকে গ্রেফতার করে কোর্টে হাজির করেন। অভিজিৎ এই ব্লগারদের মুক্তির জন্যে দিনরাত সংগ্রাম করেছিল অনলাইন এবং অফলাইনে।



নিপীড়ক যা চায় তাকে কি সেটাই দেওয়া উচিত? যখন তাদের উদ্ভট দাবিদাওয়া আপনি আমলে নেবেন, তখন কী ঘটে? শিগগিরই প্রায় এক লাখ ইসলামিস্ট ঢাকার রাস্তায় মিছিল শুরু করে শুধু ‘নাস্তিক ব্লগারদের মৃত্যুদণ্ডের’ দাবিতে নয়, বরং নতুন শিক্ষানীতি যেখানে নারীশিক্ষার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিলো সেটাও বাতিলের দাবিতে। সরকার এবারও তাদের সঙ্গে আপোস করে। ২০১৩ সাল থেকেই সরকার ইসলামিস্টদের একের পর এক দাবি মেনে চলছে।



নাস্তিকদের উপর সহিংসতার আরেকটি উদাহরণ হতে পারে, ২০১৩ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের নতুন একটি ধারার সংযোজন। আইনটি প্রস্তুত হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের আগে ক্ষমতায় থাকা জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলের হাতে। এর মাধ্যমে সাবেক রক্ষণশীল সরকার বিভিন্ন প্রকাশনা, টিভি চ্যানেল বা ওয়েবসাইট যেগুলো তাদের দৃষ্টিতে ‘ভুয়া’ এবং ‘অশ্লীল’ (অশ্লীলতা– যেটার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই) এবং যেসব বক্তব্য জনগণের মতামত ‘কটাক্ষ’ করে (আবারও একটি অসংজ্ঞায়িত শব্দ) সে সব বেআইনি হিসেবে ঘোষণা করেছে।



এই শব্দগুলোর মাধ্যমে আপনারা নিশ্চয়ই এখন শুনছে পাচ্ছেন সক্রেটিসের বিরুদ্ধে আনা সেই অভিযোগগুলোর প্রতিধ্বনি, যিনি নাকি তরুণদের দিকভ্রান্ত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, এই তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে এমন যে কোনো মন্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। উপরে উল্লিখিত অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধীকে দশ বছরের কারাদণ্ড এবং চড়া জরিমানার বিধানও রয়েছে।



অবশ্যই শাস্তিটা কঠোর। কিন্তু মনে রাখা দরকার, আমরা এখনও ২০০৬ সালের মূল আইন নিয়ে কথা বলছি। এর সকল অপরাধ ‘অ-আমলযোগ্য’ ছিল। ‘অ-আমলযোগ্য’ শব্দটি শ্রীলংকা, ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের দণ্ডবিধির একটি মৌলিক পরিভাষা। একটি ‘অ-আমলযোগ্য অপরাধ’ হচ্ছে এমন অপরাধ যার পুলিশি তদন্ত এবং গ্রেফতারের আগে ম্যাজিস্ট্রেটের বাধ্যতামূলক অনুমতির প্রয়োজন। কিন্তু ২০১৩ সালের আইনে সংশোধনী এনে চার ধরনের অপরাধ আমলযোগ্য ঘোষণা করা হয়। যার ফলে ভবিষ্যতে কোনো ধরনের ছদ্ম ‘ব্লাসফেমি’ অপরাধ অপরাধ বিবেচনা করতে বিচার বিভাগের অনুমতির প্রয়োজন পড়বে না। একই সঙ্গে এই অপরাধগুলো করা হয়েছে অ-জামিনযোগ্যও।



আইনটির সবচেয়ে কুখ্যাত ৫৭ ধারা যদিও আমলযোগ্য নয়, কিন্তু পুলিশের ভিন্ন রাস্তা খুঁজে পেতে সময় লাগেনি। কৌশলটি হল, পুলিশ প্রথমে অপরাধীকে গ্রেফতার করে আমলযোগ্য অপরাধ ৫৪ ধারা ব্যবহার করে। তারপর তার বিরুদ্ধে ৫৭ ধারার অভিযোগ যুক্ত করা হয়। ঠিক এভাবেই ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের খুশি করতে উপরোক্ত আইনটি ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ ব্লাসফেমি-সংক্রান্ত যে কোনো অপরাধ এখন পুলিশ কারও অনুমতি ছাড়া আমলে নিতে পারে, গ্রেফতার করতে পারে।



মানহানিকর অপরাধ ছাড়াও বাংলাদেশের দণ্ডবিধির আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, ‘ধর্মানুভূতিতে আঘাত’ যাকে বলমাত্র মুদ্রিত মিডিয়ার জন্য প্রযোজ্য এবং যে অপরাধের শাস্তি ২ বছরের কারাদণ্ড। দণ্ডবিধিটির মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যথেষ্ট পরিমাণে মনে হয় আটকানো যাচ্ছিল না; তাই এক ধাপ এগিয়ে আইসিটি আইনের মাধ্যমে ইন্টারনেটে ধর্মের সমালোচনা করলে ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান করা হয়।



অদ্ভুত হলেও সত্যি, এখন আপনি ইন্টারনেটের মাধ্যমে ধর্মের সমালোচনা করে কিছু লিখলে আপনার চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড হবে আর প্রিন্ট মাধ্যমে লিখলে হবে দুই বছর। এর মানে হল, (উদাহরণস্বরূপ) ফেসবুকে আপনার বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করা বক্তব্য জাতীয় পত্রিকায় প্রথম পাতায় প্রকাশিত আক্রমণাত্মক সংবাদের তুলনায় সাতগুণ বেশি মাত্রার অপরাধ। আইসিটি আইনের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই অনেক লেখক, ব্লগার, সাংবাদিককে অপদস্থ করা হয়েছে, যার উদাহরণ আমরা দেখেছি ভুরি ভুরি।



মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রচ্ছায়ায় বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামি মৌলবাদের ব্যাপক উত্থান হয়েছে এবং স্থানীয় ও বৈদেশিক, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের অর্থ দিয়ে দেশের আনাচে-কানাচে অসংখ্য মসজিদ-মাদ্রাসা স্থাপন করার মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি শক্ত ভিত পেয়েছে। মসজিদ-মাদ্রাসা ব্যবহার করে ইসলামি মৌলবাদীরা প্রতিনিয়ত তাদের ঘৃণা এবং অসহিষ্ণুতার বাণী প্রচার করে যাচ্ছে।



আমার স্বামী অভি, ওয়াশিকুর বাবু এবং অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার পর কী হল? প্রায় কিছুই না! তারা একজনকে গ্রেফতার করল যে অভিজিৎকে ইন্টারনেটে হুমকি দিয়েছিল এবং একটি অদৃশ্য অনলাইন গ্রুপ যারা হত্যার দায় স্বীকার করেছে তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। এত সময় পেরিয়ে যাবার পর পুলিশ বা সরকার কারও পক্ষ থেকেই আমার সঙ্গে একবারও যোগাযোগ করা হয়নি। এমন একটা অবস্থা যে, তাদের কাছে আমার কোনো অস্তিত্বই নেই।



আজ (২ জুলাই) সকালেই জানতে পেরেছি যে, বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ভারতীয় উপমহাদেশের আল-কায়েদার শাখা, একিউআইএসএর ১২ সদস্যকে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করেছে অভিজিৎ রায় এবং অন্যান্য লেখক, মুক্তিচিন্তকদের হত্যায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে। এখনও বিস্তারিত কোনো কিছু না জানায় এ ব্যাপারে মন্তব্য করা থেকে নিজেকে বিরত রাখছি।



আমার কাছে অনেকেই জানতে চান, আমি কেমন করে নিজেকে উদ্দীপ্ত রাখি? সমমনা মানুষদের উপস্থিতি, সহানুভূতি (যদিও স্বীকার করছি আমার অন্যের থেকে সহানুভূতি নিতে ভালো লাগে না) বিশেষ করে আমার আত্মীয়, বন্ধু এবং চেনা-অচেনা মানুষসহ সমগ্র মুক্তমনা পরিবার আমার সঙ্গী থাকার কারণেই আমি সব হারিয়েও উজ্জীবিত থাকার চেষ্টা করতে পারছি। মুক্তমনার উপদেষ্টামণ্ডলী এবং এর সম্পাদকেরা তাদের সকল দায়িত্ব সীমাহীন নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে চলছেন। অভিজিৎ শুধু লেখালেখিই করেনি, সারা জীবন সে আমাদের দেশে এমন একটা শক্তিশালী মঞ্চ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে যেখানে চিন্তা ও বাকস্বাধীনতার মুক্ত চর্চা করা যাবে। অভির মৃত্যুর পর কাবেরী গায়েন, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যাঁকেও মৃত্যু-হুমকি দেওয়া হয়েছে, আমাকে এক ব্যক্তিগত বার্তায় লিখেছিলেন:


‘‘আমি জানি এটা আমাদের আইনি সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে যেখানে লেখার প্রতিবাদে চাপাতি ব্যবহার করা হয়। তারপরও, অভিজিতের হত্যাকাণ্ডের পর, নাস্তিকদের এবং মুক্তচিন্তার চর্চাকারীর পাশে দাঁড়ানোর সামাজিক যে ছুৎমার্গ সেটা ভেঙে পড়েছে। চারিদিকে মানুষ প্রতিবাদে উচ্চকণ্ঠ হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই মানুষ লিখছে, প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল করছে।’’



ইতিহাসের শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা সবাই জানি যে, সমাজ সরল পথে এগোয় না, এঁকেবেঁকে আগ-পিছ করে চলাই এর রীতি। পরিবর্তন তো রাতারাতি ঘটে না।



যখনই আমি ব্যক্তিগত শোকানুভূতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকি, ততবারই আমার মন হয় আমি এখনও একটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছি, আমার আজ কথা বলার মঞ্চ আছে, জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আছে, আছে এক দল ভালো বন্ধু ও আপনজন যারা আমাকে এই দুঃসহ সময়ে সমর্থন দেবেন। কিন্তু তাদের কী হবে যাদের কোনো কণ্ঠ নেই, সংগঠন নেই?



যখন হাজার হাজার নারী-পুরুষকে পাচারের উদ্দেশ্যে উঠিয়ে দেওয়া হয় গভীরের সমুদ্রের বুকে ছোট নৌকায়, যখন মেয়েরা গণধর্ষণের শিকার হয় গণপরিবহনে, আইসিসের কসাইরা শিরোচ্ছেদ করে নিরপরাধ মানুষের, যখন তারা মেয়েদের যৌনদাসী হতে বাধ্য করে, যখন বোকো হারাম শত শত বালিকাকে অপহরণ করে মধ্যযুগীয় কায়দায় বিক্রি করে দেয়, দরিদ্র দেশগুলোতে হাজারও শিশু যখন মারা পড়ে, আমি দেখি যে, তাদের কোনো কণ্ঠ নেই। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমাদের একটা সম্মিলিত দায়িত্ববোধ এবং চেতনা থাকা দরকার। কোনো ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়, আমাদেরকে বুঝতে হবে আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ, বুঝতে হবে প্রতিটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাবলী কীভাবে একে অপরের সঙ্গে জড়িত।



আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পশ্চিমে এই মানবতাবাদের ধারণা সেই প্রাচীন গ্রিসের বীরত্বগাথা, মধ্যযুগের পার্সি এবং মুরদের প্রভাব, রেনেসাঁর সময়ে ধ্রুপদী-চর্চার পুনরুত্থান, রোমান্টিসিজম, এনলাইটেনমেন্ট, ফরাসী বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব ইত্যাদি বহু পথ পাড়ি দিয়ে এমন পর্যায়ে এসেছে। বিশ্বের অনেক অংশ, যেমন বাংলাদেশ, এমন ধরনের নানা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের ধাপ পার করেনি।



ভেবে দেখুন, পশ্চিম যখন গত কয়েক শতাব্দী ধরে এসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন বাকি বিশ্বে কী ঘটছিল? ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল একটা বিলেতি উপনিবেশ। আফ্রিকা নিষ্পেষিত হচ্ছিল বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তির হাতে। আমেরিকার আদিবাসীরা নিয়মতান্ত্রিক হত্যাযজ্ঞের শিকার হচ্ছিল। এসব বিশ্বশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় বর্ণবাদ, দাসপ্রথাও চালু ছিল। তাই সব জায়গার সব পরিস্থিতি সব সময় একই রকম ছিল না এবং থাকেও না।

এ কারণে আমরা যখন কোনো নির্দিষ্ট জাতি-গোষ্ঠীর মানবতাবাদ নিয়ে আলোচনা করব তখন সতর্ক থাকতে হবে। উত্তর-ঔপনিবেশিক কামালবাদের মতো করে কোনো জনগোষ্ঠীর উপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া উচিত হবে না। নির্দিষ্ট কোনো জাতি ও সংস্কৃতির আঞ্চলিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের সঙ্গে বৈশ্বিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের সম্পর্কগুলো ও ঘটনা এ প্রেক্ষাপটগুলো আমাদের চিন্তা করতে হবে।



যা হোক, গত কয়েক মাসে নানা সময় আমি আমার নিজের অনুভূতিগুলো নিয়ে ভেবেছি— সব হারানোর শোকে কাতর হয়েছি, ক্রুদ্ধ হয়েছি। মাঝে মাঝে আমার হারানোর বেদনা আমার কাছে প্রচণ্ড বাস্তব আর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়, আমি হয়ে যাই শুধুমাত্র ‘আমি-কেন্দ্রিক’। পরমুহূর্তেই ভাবি, আমার এসব প্রচণ্ড শক্তিশালী অনুভূতি উদ্দেশ্যহীন, উদ্বেগহীন, মূল্যহীন মহাবিশ্বের বিশালতার কাছে কতটাই না নগণ্য। মানব মূল্যবোধের সঙ্গে মহাজগতের এই উদ্দেশ্যহীনতার বৈপরীত্যই আমার কাছে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদীদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

এই হেত্বাভাস আমরা কীভাবে গ্রহণ করব? আমার মতে, দুই উপায়ে। প্রথমেই উপলব্ধি করতে হবে এই উদ্দেশ্যহীন, শূন্য মহাবিশ্বের মূল্যহীনতা। তারপর ভাবতে হবে, মহাবিশ্বের তুলনায় আমরা নগণ্য হলেও আমাদের চিন্তা, অনুভূতি, হারজিত, জীবনের অর্থ, এগুলো জীবনের এই ক্ষুদ্র মঞ্চে খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের ক্ষুদ্রতা অনুভব করে আমরা যতক্ষণ না ‘আমাদের’ ব্যক্তিগত জীবনবোধ সমগ্র মানবজাতির জন্য বিস্তৃত করতে পারছি, ততক্ষণ এর মূল্য নেই। শুধু নিজের জন্য নয়, পাচার হওয়া প্রত্যেক মানুষ, অপহৃত লেখক, একাকী কিংবা দিগভ্রান্ত মন সবার কথা ভাবা সমান গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান।



তাত্ত্বিকভাবে আমরা এসব জানি। আমাদের এখনই এই ঘৃণা আর বিক্ষোভের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বের সকল সীমানার উর্ধ্বে উঠে, আমাদের ব্যক্তিগত ভালোবাসা ও সমানুভূতির বৃত্ত প্রসারিত করতে হবে প্রত্যেক মানুষের জন্য। সবাইকে ভাবতে হবে পরিপূর্ণ এবং স্বাধীন মানুষ হিসেবে। এভাবেই আমরা অভিজিতের জীবনবোধ উদযাপন করতে পারব, উদযাপন করতে পারব অনন্তসহ আর সবার জীবন যারা দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন কিংবা বেঁচে আছেন মৃত্যু-ঝুঁকি নিয়ে।



বাংলাদেশে মুক্তচিন্তকরা চাপাতির বিরুদ্ধে লড়ছেন কলম দিয়ে। সারা বিশ্বেই মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে সহানুভূতি, যুক্তিবোধ, সর্বজনীনতা এবং বিভিন্ন সংঘাতকের কারণ গভীরভাবে উপলব্ধির মাধ্যমে। এটাই মানবতাবাদের একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ।
ধন্যবাদ সবাইকে।

 


বন্যা আহমেদের বক্তৃতার ইউটিউব লিংক: https://youtu.be/RVTqdwyv74o

সহায়ক:
১. ব্রিটিশ হিউম্যানিস্ট এসোসিয়েশনের লিংক:
https://humanism.org.uk/2015/07/02/attacked-bangladeshi-humanist-blogger-bonya-ahmed-delivers-2015-voltaire-lecture/


২. ‘ভলতেয়ার বক্তৃতা’ প্রসঙ্গে রায়হান রশীদের ব্লগের লিংক:
https://blog.mukto-mona.com/2015/07/15/46797/


৩. গার্ডিয়ানে প্রকাশিত নিক কোহেনের মূল ইংরেজি নিবন্ধের লিংক:
http://www.theguardian.com/commentisfree/2015/jul/04/islamism-prevails-we-suppress-free-speech-bangladeshi-blogger


৪. নিক কোহেনের নিবন্ধের বাংলা অনুবাদের লিংক:
https://blog.mukto-mona.com/2015/07/12/46734/

বন্যা আহমেদ, লেখক, ব্লগার; ভিজিটিং রিসার্চ স্কলার, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ