প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
এমদাদুল হক তুহিন | ০৮ আগস্ট, ২০১৫
মুক্তচিন্তার খুন হওয়ার দলে রাজিব, দ্বীপ, অভিজিৎ, ওয়াশিকুর, অনন্তদের তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হলেন মুক্তমনা লেখক ও ব্লগার নিলয় নীল। শুধু তরুণ প্রজন্ম নয়, সমাজের প্রতিটি মানুষের শঙ্কা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে; পরের টার্গেট কে তা জানার জন্যে সকলেই যেন উদগ্রীব! না হয়েই উপায় কি? মুক্তমনা বধের চলমান এ মিছিল বন্ধ হওয়ার পন্থা যেন কারো জানা নেই।
সভা-সমাবেশ ও মিটিং মিছিল বন্ধ করতে ১৪৪ ধারা জারি করা সম্ভব হলেও মৃত্যুর এ মিছিল বন্ধ করতে কোন ধারা নেই, আইন নেই। এ যেন এক ব্লগার হত্যার মৃত্যু মিছিল! চলমান গতির আইন থাকা সত্ত্বেও প্রথম হত্যাকাণ্ডটি সংগঠিত হওয়ার পরই রাষ্ট্র-যন্ত্র সহ সকলের উচিত ছিল ‘এখানেই শেষ’ বলে সমাপ্তি টানার। জানি না কি এক ভিন্ন কারণে তা সম্ভব হল না। তবে কি এখানেই ব্যর্থ আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র!
গণজাগরণ মঞ্চ ও শাহবাগ আন্দোলনের সাথে জড়িত কোন কর্মীতো নয়ই, দেশের ভিন্ন কোন প্রগতিশীল চিন্তকও নির্মমভাবে চাপাতির আঘাতে খুন হবেন না; প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত ছিল এমন। তবু হয় নি, হয়েছে বিভক্তি! গ্রুপে গ্রুপে মুক্তচিন্তার মানুষগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে। অথচ একই ট্রেন, একই গন্তব্য!
চলতি বছরে আইসিটি অ্যাক্ট’র খসড়া নিয়ে কাজ চলছে। সরকারের আইসিটি ডিভিশন বলছে তারা আলোচনা ও সমালোচনাকে ইতিবাচকভাবে নিয়ে প্রয়োজনে আইনের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারে। এক অনুষ্ঠানে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, আমরা তরুণদের সব সময় স্বাগত জানাই। তাদের চিন্তা চেতনা গ্রহণ করি। কথার কথা বললেও পুরনো আইনের মত নতুন আইনের খসড়ায়ও রয়ে গেছে পুরনো আইন। কালো আইন, কথিত ৫৭! আর ওই ধর্ম অবমাননার অভিযোগেই জেল জুলুমের শাস্তি রয়েছে। তবে বড়ই পরিতাপের বিষয় আইনটি শুধুমাত্র মুক্তচিন্তা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে। কোন ক্ষেত্রেই এর দ্বারা ধরা হচ্ছে না জামাত শিবির! আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে জামাত শিবির দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অনলাইনে। চালাচ্ছে ধর্মের নামে কথিত সাইবার যুদ্ধও। ফারাবীর লিস্ট অনুযায়ী চলছে ব্লগার হত্যা। ফলে উৎকণ্ঠায় মুক্তবুদ্ধির মানুষ, শঙ্কায় মুক্তচিন্তা!
নীল হত্যার পর ওয়ার্ডপ্রেসের একটি ব্লগ ঘেঁটে দেখা যায়, ‘আসলে এরা নাস্তিক না এরা হচ্ছে ইসলাম বিদ্বেষী ও জ্ঞানপাপী।’ শিরোনামের একটি লেখায় বর্তমানে কারাগারে থাকা শাফিউর রহমান ফারাবী ব্লগার নিলয় নীল এর প্রতি ধর্ম বিদ্বেষের অভিযোগ তুলেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘কালের কন্ঠ পত্রিকার অভিযোগ হল আমি কেন রাজীব হত্যাকান্ডে অভিযুক্ত নর্থসাউথের ৬ জন ছাত্র অনিক, দ্বীপ, রুম্মান, নাফিস, ইরাদ ও সাদমানের মুক্তি চেয়েছি। আচ্ছা ভাই দাঁড়িপাল্লা ধমাধম, সাদিয়া সুমি উজ্জা, অনন্য আজাদ, Shuvo Michael D Costa, Niloy Neel এই ফেইসবুক আইডি গুলিতো প্রতিদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে অনেক অশ্লীল Status Post করে’।
ওই ব্লগটি ‘তাওহীদের ডাক’ ছদ্মনামে পরিচালিত এবং ২০১৩ সালের ২৮ আগস্ট ফারাবীর ওই স্ট্যাটাসটি তারা আপলোড করে। যেখানে রয়েছে চাপাতির আঘাতে সদ্য খুন হওয়া নীলের নাম! ছক কষে চলমান খুনের এও একটি বড় প্রমাণ। এবং খুনগুলো দেশের ভেতর থেকেই উগ্র-ধর্মীয় গোষ্ঠী দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে বলে আমার অভিমত। এবং কোন না কোনভাবে এর সাথে জামাত শিবির ও হেফাজতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংযোগ রয়েছে। এখানেই নির্বিকার ডিজিটাল সরকারের আইসিটি অ্যাক্ট!
মৃত্যুর ৮৩ দিন পূর্বে নীল একটি উৎকণ্ঠামূলক স্ট্যাটাস ফেইসবুকে শেয়ার করে। সেখানে তিনি বলেছেন, দুটি ছেলে পাবলিক বাস থেকে অনুসরণ শুরু করে লেগুনা হয়ে অতঃপর একটি গলি পর্যন্ত তাকে অনুসরণ করে! বিষয়টি নিয়ে সে কিছু উৎকণ্ঠায় পড়ে যায়। বাধ্য হয়ে থানায় ডায়রি করতে গিয়েছিল। কিন্তু এ থানা থেকে ও থানা ঘুরিয়েও শেষ পর্যন্ত দেশত্যাগের পরামর্শ দেওয়া হল। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে কয়েক বছর পূর্বে সরকার অনলাইনে জিডি করার পদ্ধতি শুরু করে, কিন্তু কারো কারো পকেটে টান পড়বে বলে 'সিস্টেম অকার্যকর' দেখিয়ে তা বন্ধ রাখা হয়। যেহেতু আমরা অনলাইন কেন্দ্রিক মানুষ ও দিনে দিনে ডিজিটাইজড হচ্ছি; উচিত ছিল পদ্ধতিটি চালু রাখা। যদি তা সম্ভব হত তাহলে নীলকে থানায় থানায় ঘুরে ঘুরে সাধারণ ডায়েরি করতে যেয়ে শুনে আসতে হত না, দেশত্যাগ করুন! হয়ত বেঁচেও যেতে পারতো নীলাদ্রি নীল।
বর্তমান সময়ে আরও একটি প্রবণতা লক্ষণীয়, হত্যা হলেই প্রথমেই জানতে চাওয়া হয়, 'তিনি কি ব্লগার? কোন ব্লগে লিখতেন? কোন নিকে?' কিন্তু জানতে চাওয়া হয় না তার মতাদর্শ কি ছিলো! এমনটিও জানতে চাওয়া হয় না, তিনি কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতেন কিনা? আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, একে একে ৬ ব্লগার হত্যার মূল কারণই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। তারাই বিচার চেয়েছিলেন, নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। জামাতের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে অসীম সাহস দেখিয়ে তারা বলতে পেরেছিলেন, 'তুই রাজাকার'। হয়ত তারই অপ্রকাশ্য ফল চাপাতির কোপ।
নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে হত্যার পরপরই হত্যার দায় স্বীকার করে আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের (একিউআইএস) বাংলাদেশ শাখা, আনসার আল ইসলামের নামে ই মেইল পাঠিয়েছে গণমাধ্যমে। ওই ইমেইলের শেষ অংশে সংগঠনটি হুমকি দিয়ে লিখেছে , 'যদি তোমাদের ‘বাক-স্বাধীনতা’ কোনও সীমানা না মানতে প্রস্তুত থাকে, তবে তোমাদের হৃদয় যেন আমাদের ‘চাপাতির স্বাধীনতার’ জন্য উন্মুক্ত থাকে।'
প্রকাশ্য এ হুমকির বার্তা তৈরিতেও হয়ত ছিল এ দেশীয় কোন হাত, হতে পারে জামাত শিবির। আমি কোনভাবেই মানতে রাজি নয়, বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। জঙ্গি হওয়ার এ রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল এ আওয়ামী লীগ সরকারই। প্রশ্ন জাগে, ব্লগারদের ব্যাপারে সরকার এতোটা নিশ্চুপ কেন! নির্দয় কেন!
সবশেষে বলতে চাই বিচার না হওয়ার যে সংস্কৃতি শুরু হয়েছে, বিশেষত ব্লগার হত্যার ক্ষেত্রে; এরচেয়ে ঢের উত্তম সবাইকে একসাথে ঝড়ো করে গণহত্যা করা। আর যদি বাঁচাতে চান, প্রয়োজনে অন্য সব কিছু বন্ধ রেখে হলেও প্রথমেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করুন। ব্লগারদের রক্ষা করুন। যুদ্ধাপরাধী মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে এদের অবদান কোন অংশে কম নয়, বরং এ প্রত্যাশাকে জিইয়ে রেখেছে এরাই!
৬ টি তাজা প্রাণ চাপাতির কোপে ঝরে গেলেও রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ হবেই হবে, এটাই প্রত্যাশা। তবু মিনতি আমাদের, আমাদের জন্যে না হলেও; অন্তত আমাদের পরিবারের কথা বিবেচনা করে; দ্রুত সময়ে ব্লগার হত্যার এ অনাকাঙ্ক্ষিত মিছিল বন্ধ করুন।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য