আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ

এমদাদুল হক তুহিন  

বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ শব্দ দু’টি একে অপরের পরিপূরক বা পরিবর্তক শব্দ হিসাবেও প্রতিষ্ঠিত। আপেক্ষিক বিচারে শব্দ দু’টির গভীরতা অনুধাবন করে পার্থক্য খোঁজে বের করা অনেকটাই দুষ্কর! বঙ্গবন্ধু থেকেই মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের গহীন অরণ্যে চষে বেড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধু। সেই সূত্রে শব্দ দু’টি একই সূত্রে গাঁথা। ‘যুদ্ধ মানেই শান্তি’ বলা হয়ে থাকলেও যুদ্ধ শেষেই শান্তি আসে; আসে স্বাধীনতাও।

ভারতবর্ষে ঘটে যাওয়া দেশ বিভক্তি, দ্বিজাতি তত্ত্বের আলোকে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাও দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ইংরেজদের বিরুদ্ধের যুদ্ধ জয়ের ফসলই বটে। তবে বাংলা মায়ের ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া ঘটনা ভিন্ন কিছু; যেন এক প্রলয়ঙ্কারী মহাযুদ্ধ, জনযুদ্ধ।

যুদ্ধের ঐ সময়টিতে কম বেশি সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, সাহায্য করেছেন যোদ্ধাদের। খাসিয়া সম্প্রদায়ের মুক্তির বেটি কাকন বিবির মত দুঃসাহসী নারীরা আরও এক ধাপ এগিয়ে ছিলেন। জীবন বাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী পরিচালিত হয়েছে রেকি। সফলভাবে তা সম্পন্ন হলে ঝাঁপিয়ে পড়া, মুল যুদ্ধ; মুক্তিযুদ্ধ।

শিশুরাও পিছিয়ে ছিলো না তখন, কচুরিপানার ভিতর লুকিয়ে ধ্বংস করে দিয়ে বিধ্বংসী জাহাজ। সম্মুখ যুদ্ধের কথা বাদই দিলাম। যুদ্ধের সময় কত লোক পাগল বেশে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে তারও ইয়াত্তা নেই, যেমন নেই বীরাঙ্গনাদের; আমাদের বীর মাতাদের! তবু যুদ্ধ মানেই শান্তি, যুদ্ধ মানেই জয়-পরাজয়! তবে জনযুদ্ধে পরাজয় বলতে কোন শব্দ নেই। মাত্র নয় মাসের রক্ষক্ষয়ী এ সংগ্রামে দেশের তরুণেরা ছিনিয়ে আনে লাল সবুজের পতাকা।

জনযুদ্ধ প্রসঙ্গে পিতা মুজিব বলেছিলেন,‘‘শুধু মুক্তিবাহিনীর ভায়েরাই অস্ত্র নিয়ে সংগ্রাম করে নাই। জনগণকেও লড়তে হয়েছে স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে।’’ কি সাবলীল স্বীকার। স্বাধীন বাংলাদেশেই তিনি বলেছিলেন এ কথা, কিন্তু এর প্রতিফলন নেই কোথাও! বিভক্ত দু’টি শ্রেণি মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দিনের পর দিন ব্যবসা করেই চলছে। হটাৎ করেই বঙ্গবন্ধুর পোস্টার ছেয়ে যায় সর্বত্র! তখন হয়ত পিতার মৃত আত্মাও লজ্জা পান, অপমানিত হয়ে ধিক্কার দেয় ওই সব নেতাদের।

শোকের মাস আগস্ট এলে তো কথাই নেই। বাড়তে থাকে এ প্রবণতা। ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন, ম্যাগাজিন, লিটল ম্যাগ কত্ত কি! তবে এক দিক দিয়ে ভালোই, আলোচনা হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়তই আমরা নতুন নতুন তথ্য উপাত্তের সাথে পরিচিত হচ্ছি। খবর আকারেও প্রকাশিত হচ্ছে সদ্য ইতিহাস খুঁড়ে আনা অজানা কোন তথ্য। আর তথ্যের দোহাই দিয়ে হলেও বলি, ‘পিতা হত্যার প্রতিশোধের অন্যতম অস্ত্র হচ্ছে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী।’

বর্তমানে রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে কোটিপতি সকলই জাতির পিতা সম্পর্কে জ্ঞাত। জ্ঞাত বাঞ্ছনীয়ও বটে! তবে তারা যা জানেন, আংশিক কিংবা অর্ধ সত্য! পুরোটা জানা হয় না তাদের। ইতিহাস পড়ার সময় কই? অর্ধা-অর্ধি দিয়েই চলে তর্কাতর্কি, এমনকি ওটা ভোট ব্যাংক পর্যন্তও গড়ায়! তবু পুরো ইতিহাস জানা হয় না অনেকেরই।

আরেকটি কথা প্রচলিত আছে, জাতির পিতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন না এমন মূর্খ খোঁজে পাওয়াও দুষ্কর। তবে সে জ্ঞানের পরিধিও খুব সীমিত। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে প্রগতিশীল বাংলাদেশ গড়তে সীমিত জ্ঞানকে প্রসারিত করার সহজ পন্থাও বাতলে দেওয়া হয়েছে। আছে নেতা হওয়ার সহজ রাস্তাও। তবু, নেতারাই কেন যেন বই বিমুখ! এমনকি জাতির পিতার বইটির ক্ষেত্রেও!

বঙ্গবন্ধুর জন্ম এক জমিদার পরিবারে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ এলাকার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ বংশ নামে একটি জমিদার পরিবারের বসবাস ছিল। সে বংশেই জন্ম নেন স্বাধীন বাংলার স্থপতি। তবে বঙ্গবন্ধুর জন্মের পূর্বাপর সময়েই জমিদারিত্ব হারায় ওই বংশ। আর যে ঘরে জাতির পিতার জন্ম হয় তা ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। 

শেখ পরিবারের জমিদারিত্বের রেখে যাওয়া নিদর্শনের পাশেই ছিল কয়েকটি টিনের ঘর, আর এমন একটি টিনের ঘরেই জন্ম হয় জাতির পিতার। সেখানে ছিল না কোন আভিজাত্য। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘরকে আলোকিত করে তথা পুরো পূর্ববঙ্গকে সূর্যের আভায় আলোকিত করে জন্ম হয় মুজিবের। নাম তাঁর শেখ শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু তাঁর বংশধর ও জন্ম সম্পর্কে লিখতে গিয়ে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ' আমার জন্ম হয় এই টুঙ্গিপাড়া শেখ বংশে। শেখ বোরহানউদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ এই বংশের গোড়াপত্তন করেছেন বহুদিন পূর্বে। শেখ বংশের যে একদিন সুদিন ছিল তার প্রমাণস্বরূপ মোগল আমলের ছোট ছোট ইটের দ্বারা তৈরি চকমিলান দালানগুলি আজও আমদের বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি করে আছে।' আরও লিখেন, ‘জমিদারির সাথে সাথে তাদের বিরাট ব্যবসাও ছিল।'

ছাত্ররাজনীতি থেকেই জাতীয় রাজনীতিতে পদার্পণ। ১৯৩৮ সালেই ছাত্ররাজনীতি দিয়ে শুরু। মিশন স্কুলের রাজনীতি শেষে কলকাতা ধাপিয়ে দেশ বিভক্তির সময় আবার ঢাকায়। তখন তিনি মুসলিম লীগের বড় নেতা। মুসলিম লীগ প্রসারিত করতে ভারতের এ রাজ্য থেকে ও রাজ্য ছুটে বেড়াচ্ছেন। তবে খুব সম্ভবত একটি সুটকেস নিয়ে রাজধানী কলকাতা থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করতে হয়। দেশে তখন দিন্দু মুসলিম দাঙ্গাও চলে, তাও সামলান মুজিব।

ঢাকায় স্থায়ী হওয়ার পর এক সময় মুসলিম লীগ ভেঙ্গে আওয়ামী লীগ গঠন। জড়িয়ে পড়েন ঢাবিতে। ১৯৫২ সালের দিকে তিনটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন মুজিব। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের দাবী আদায়ের আন্দোলন এবং নির্বাচন ও দুর্ভিক্ষ বিরোধী আন্দোলন। তখন তাঁর রাজনৈতিক যৌবন চলছে।

সময়ের পরিক্রমায় বাঙালীর জীবনে আসে ৭ই মার্চ। আবহেলা ও নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় হল হল অবস্থা। তার আগেই চলছিল জল্পনা কল্পনা। ৭ মার্চ বিকেল তিনটায় ভাষণ দেবেন বাঙালীর প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ভোরের আলো ফোটে উঠার সাথে সাথেই পাল্টে যেতে লাগে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানের চারপাশ সকালের পর থেকেই জনস্রোত বয়ে যেতে লাগে পুরো ঢাকায়, বিশেষত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর কবিতায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে লিখেন, “একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে/ লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি?” সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তিনটা বিশ মিনিটে মঞ্চে আসেন বক্তৃতার শ্রেষ্ঠ কবি ।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দীর্ঘ ১৯ মিনিট বক্তৃতা করেন। ভাষণ চলতে থাকা সময়ে গর্জে ওঠে উত্তাল ওই জনসমুদ্র।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ‘যোগাযোগ বিদ্যার দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘প্রতি মিনিটে গড়ে ৫৮ থেকে ৬০ টি শব্দ উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু ১৯ মিনিটে এই কালজয়ী ভাষণটি শেষ করেছিলেন।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘এ ভাষণ যুগ যুগ ধরে বাঙালী জাতিকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় উজ্জীবিত রাখবে।’

বিদেশী প্রভাবশালী পত্রিকা নিউজউইকে আখ্যা দেয়। ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ বলে আখ্যা আর পায় নি কোন নেতা। ওই ভাষণের সমতুল্য ভাষণ পৃথিবীতে আর একটিও নেই! এখানে সমতুল্য শব্দটি ব্যবহার করার অনেকটা পিতায় মূল্যায়নকে অবমূল্যায়ন করা শামিল! এর পর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার তেমন কোন প্রয়োজন ছিল না বলে মনে করে বিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ।

অন্যদিকে আরেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কাজী জাকির হাসান চন্দন বিডি নিউজের এক মতামত বিষয়ক সাক্ষাৎকারে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা শুনেছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘দেখুন, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরেই কিন্তু লড়াইয়ের জন্য মানসিকভাবে আমরা তৈরি হয়ে যাই। বুঝে যাই, সংগ্রাম করেই স্বাধীনতা আনতে হবে। ওই ভাষণটাই ছিল স্বাধীনতার ভাষণ। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের আর কোনো ঘোষণারই প্রয়োজন পড়ে নাই।’ (সুত্র: যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ৩৫ ‘‘অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেই রাজাকার হতে দেখেছি’’)

এর পরের ভয়াবহ ঘটনাটিই হচ্ছে ২৫ মার্চ কাল রাত। বাঙালীর জীবনে এক ভয়াবহ অন্ধকারের রাত। সারা দেশে চলে অপারেশন সার্চ লাইট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে মেধা ও মননের চিন্তাশীল প্রতিটি স্থানে আসে আঘাত। রাতের অন্ধকারে শুরু হয় নির্বিচারে মানুষ হত্যা। তবে ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু তখন আর্মিদের হাতে বন্দি। যা করার তা আগেই করে গিয়েছেন, সকল ছক কষে গিয়েছিলেন।

ধারাবাহিকভাবে বাঙ্গালীরা নয় মাসের যুদ্ধ জয় করে বাংলাদেশ। ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আসে স্বাধীনতা। পিতা মুজিব যুদ্ধের অনেক পর দেশে ফিরেন। যদিও বন্দিদশায় তাকে পাকিস্তানিরা হত্যা করার ষড়যন্ত্রও করে সফল হয় নি। ১০ই জানুরারি ১৯৭২ সালে বংবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। শুরু করে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠন। খাদ্য সংকট সহ নানা শঙ্কটে জর্জরিত একটি ভূখণ্ড। কোন সম্পদ নেই, নেই অর্থও। আছে মনোবল, আর কিছু বিদেশী সাহায্য। সাহায্য বণ্টনেও শুরু হয় হরিলুট। ইতিহাস প্রায় সকলেরই জানা। তবু বলার জন্যে বলা।

দেশ স্বাধীনের পর সব দিকে সফল হলেও গণমাধ্যমও শুরু করে নতুন ষড়যন্ত্র। সাথে যোগ দেয় তথাকথিত কিছু বা সংগঠন। যারা পাকিস্তান কায়েম করতে চেয়েছিল তারাও শেষ ছোবল দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধু ও গণমাধ্যম বইয়ে ওই ভাষণের শিরোনাম করা হয়েছে ‘সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে’। ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্র চাই কিন্তু উচ্ছৃঙ্খলা চাই না, কারও বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করতে চাই না। অথচ কোন কাগজে লেখা হয়েছে “মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য সংঘবদ্ধ হও’’। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতেও অনেক সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জামাত শিবির হায়েনারা একইভাবে কুৎসা রটনায় ব্যস্ত। শুধু ওই সময়টিতে নয়, এখনও। মনে রাখতে হবে আমাদের।

জানা যায়, দেশ স্বাধীন হতে না হতেই একাধিক সংবাদপত্রের ব্যবসা শুরু হয়ে যায় এ দেশে। দেশী-বিদেশী টাকায় ওই সব সংবাদপত্র পরিচালিত হত বলে জানা যায়। বঙ্গবন্ধু এ সম্পর্কে ওই ভাষণে বলেন, ‘ আপনারা সরকারী কর্মচারীদের স্ক্রিনিং চান, শিক্ষকদের স্ক্রিনিং চান, বেতারের স্ক্রিনিং চান। অনুগ্রহ করে একটু নিজেদের স্ক্রিনিং করুন। একটু বলুন, এই লোকগুলো এই কাজ করছে। আমরা তা মেনে নেব। আর যদি নিজেরা কিছু না করেন আমাকে বলবেন। আমি করব। আমাকে করতেই হবে। কারণ, পাকিস্তানের নামে পয়সা নিয়ে এসে যদি কেউ রাতারাতি খবরের কাগজ বের করে, আর মানুষের স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে আমাদের সব নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন করাবার চেষ্টা করে, এখানে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়াবার চেষ্টা করে, জাতির আদর্শের বিরুদ্ধে কথা বলে, তবে সেটাকে স্বাধীনতা বলা যায় না। সে স্বাধীনতা কোন সরকার, কোন জনগণ, কোন প্রগতিশীল দল কোন দিন সমর্থন করতে পারে না।’ ক্ষিপ্ত হতে থাকে খুনী ও তার দোষররা! অপেক্ষা করে নতুন ছক কষে সামনে এগিয়ে যাবার। পন্থাও তৈরি হয় দেশের বৈরি পরিস্থিতিতে।

জাতির ইতিহাসে আসে ভয়াল অন্ধকার। ১৫ ই আগস্ট। পৃথিবীর ইতিহসে এমন দুর্ভাগ্যজনক দিন আর আসে নি কোনদিন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটিকে টার্গেট করে একদল উন্মাত সেনাবাহিনী।

১৫ আগস্টের বর্ণনা দিতে আন্থনী ম্যাসকার্নহাস তাঁর ‘ বাংলাদেশ: এ লিগ্যাসী অব ব্লাড’ গ্রন্থে লিখেছেন, ১৫ই আগস্ট ভোর ৪:৪০ মিনিট। ফারুকের বাহিনী আঘাতের জন্য সংগঠিত হয়ে যায় যার যার জায়গামতো পৌঁছার জন্যে প্রস্তুত। রাশিদের আর্টিলারি বাহিনী তাদের কামান নিয়ে নতুন এয়ারপোর্টের প্রান্তে দণ্ডায়মান। ল্যন্সার সারিবদ্ধভাবে সাজানো আছে ২৮টি ট্যাংক, ১২টি ট্রাক, ৩টি জিপ আর একটি ১০৫ মি. মি. হাউইটজার। এগুলোর সাথে রয়েছে রণ সাজে সজ্জিত ৪০০ সৈন্যের একটি শক্তিশালী দল। তাদের দুই-তৃতীয়াংশ ছিল কালো উর্দি যা পরবর্তীতে বাংলাদেশীদের মনে এক ভয়ঙ্কর পোশাক বলে পরিগণিত হতে পারে।

দিনটি ছিল শুক্রবার। এই শুক্রবারের ভূমিষ্ঠ হয় ফারুক। বাইরে বেরিয়ে আসতেই তার কানে ভেসে আসে আসে সুমধুর আযানের ধ্বনি। হয় আজ ফারুকের নব জীবনের সূচনা, নতুবা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর বাড়ির অবস্থা তখন গোলযোগপূর্ণ। ভোর সোয়া পাঁচটার মধ্যেই অন্য আরেকটি দল হাজির। মেজর মহিউদ্দিন, নুর আর হুদার নেতৃত্বে পরিচালিত প্রধান ঘাতক দলটি শেখ মুজিবের বাড়ি পৌঁছে যায়। রক্ষী বাহিনীর সম্মুখ দিয়েই ফারুক বাহিনী অতিক্রম করে, তবু তারা ছিল নির্বিকার। মুলত বাধ্য হয়েই। নিজেদের সামনে ট্যাংক দেখে ওরা গায়ের মশা পর্যন্ত নাড়াবার সাহস দেখায় নি।

৩২ নম্বরের বাড়ির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ঘাতকেরা! মহিউদ্দিন, হুদা আর নুর বাড়ির প্রতিটি কামরা মুজিবের খোঁজে তন্ন তন্ন করে চষে বেড়ায়। হঠাৎ মহিউদ্দিন মুজিবকে পেয়ে যায়। সে দু’তলায় উঠতেই সিঁড়ির গোঁড়ায় পা ফেলতেই শেখ মুজিবকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পায়। তাদের মধ্যে দূরত্ব ২০ ফুটের বেশি হবে না। মহিউদ্দিন শেখের সামনে দাঁড়িয়ে পুরোপুরিভাবে মনোবল হারিয়ে ফেলে। মহিউদ্দিন আমতা আমতা করে তাঁকে বলেছিল, ‘স্যার আপনি আসুন।’

‘তোমরা কি চাও?’ মুজিব কর্কশ ভাষায় জিজ্ঞেস করেন। ‘তোমরা কি আমাকে খুন করতে চাও? ভুলে যাও। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তা করতে পারেনি। তোমরা কি মনে কর তা করতে পারবে?’

ওই দিনের ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে কর্নেল ফারুক আন্থনী ম্যাসকার্নহাসকে বলেছিল, ‘ শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব ছিল অত্যন্ত প্রবল। মহিউদ্দিন তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে একেবারে নতজানু হয়ে পড়েছিলো। ঐ মুহূর্তে নূর চলে না আসলে কি যে ঘটতো তা আমার আন্দাজের বাইরে।’ মহিউদ্দিন তখনো ঐ একই কথা বলে চলছিলো, স্যার আপনি আসুন। আর অন্যদিকে শেখ মুজিব অত্যন্ত কড়া ভাষায় ধমকিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় নূর এসে পড়ে। তার হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। সে বুঝে ফেলে, মুজিব সময় কাটাতে চাইছেন। মহিউদ্দিনকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে নূর চিৎকার করে আবোলতাবোল বকতে বকতে তার স্টেনগান থেকে মুজিবের প্রতি ‘ব্রাশফায়ার’ করে। শেখ মুজিব তাকে কিছু বলার আর সুযোগ পেলেন না। স্টেনগানের গুলি তাঁর বুকের ডানদিকে একটা ছিদ্র করে বেরিয়ে গেল। বাঙালী জাতীয়তাবাদের মহান নেতার প্রাণহীন দেহ সিঁড়ি দিয়ে কিছুদূর গড়িয়ে গিয়ে থেমে রইলো। তাঁর ধূমপানের প্রিয় পাইপটি তখনও তিনি শক্তভাবে দান হাত দিয়ে ধরে রেখেছিলেন। সময় তখন সকাল ৫ টা ৪০ মিনিট। বাঙালী জাতির সঙ্গে শেখ মুজিব প্রচণ্ড ভালবাসার চিরতরে অবসান ঘটলো।’

সেইদিন সপরিবারে শহীদ হন পিতা মুজিব। ছোট শিশু রাসেল থেকে শুরু করে সবাই, শুধু বেঁচে যান প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও শেখ রেহানা। দেশের বাইরে হিলেন বলে! পিতা মুজিব! ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে আজও লেগে আছে রক্তের ছোপ ছোপ ছোপ দাগ। আজও ওখানেই রাসেল আত্মা কেঁদে ওঠে বলে 'আমার মত শিশুকে গুলি করে হত্যা করতে হয়? কি ছিল আমার অন্যায়?' আর মুজিবের আত্মা কি ধিক্কার দেয় বাঙালীদের; যিনি আজন্ম যুদ্ধ করেছেন বাঙালীদের হয়ে? মৃত্যুর সময়ও যার ভাবনায় ছিল, অন্তত বাঙালিরা আমাকে হত্যা করতে পারে না!

হায় বাংলাদেশ! হায় মুজিব! স্বাধীনতা অর্জনের কয়েক বছরের মধ্যেই এই কি ছিল আমাদের স্বাধীনতা! পিতা মুজিব তোমাকে লিখতে গিয়ে আমার যে আবেগ দরকার, যে ভালবাসা দরকার, যে প্রেম দরকার; কী করে সেই প্রেম পাই; এ তো তোমারই বাংলাদেশ! আমার শরীরেও কি বয় না কোন মীরজাফরের রক্ত! আমাদের? পিতা তুমি নেই, শোকাবহ এই আগস্ট শক্তি হয়েও আসে না আমাদের মাঝে। এ যেন এক কর্পোরেট যুগ! কর্পোরেট বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে শোকের দিবস!

ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের কসম, কসম তোমার মৃত্যুর, কসম ওই শিশু রাসেলের আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পিতা হত্যার প্রতিশোধের সাথে সাথে তোমার স্বপ্নের সেই সোনার বাংলা গড়বই, গড়বো! জয় বাংলা।

এমদাদুল হক তুহিন, ব্লগার, কবি ও সংবাদকর্মী। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ