আজ মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

জার্নালিস্ট না একটিভিস্ট

মাসকাওয়াথ আহসান  

সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান দাবী করছেন, প্রবীর সিকদার জার্নালিস্ট না একটিভিস্ট উনি ঠিক বুঝতে পারছেন না! ভারতের প্রবাদ প্রতিম সাংবাদিক খুশওয়ান্ত সিং মি. খানের দেয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী জার্নালিস্ট নন; একটিভিস্ট। হয়তো মি. খান এটা উনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে ভুলে গেছেন, নব্বুই-এর গণ-অভ্যুত্থানের আগে উনি নিজে যেটা করেছিলেন; ওটাও তাহলে জার্নালিজম ছিলো না। একটিভিজম ছিলো।

অথবা জার্নালিজমই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে কার্যকর একটিভিজম। নইলে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরে ঘাতকদের কোন জার্নালিস্টকে হত্যার প্রয়োজন পড়তো না যদি তারা একটিভিস্ট না হতেন।



সাংবাদিকের নৈতিকতার জায়গা থেকে যা ঘটেছে তা-ই জানানো কর্তব্য। একজন প্রতিবেদক তা-ই করেন। প্রবীর সিকদার জনকন্ঠের জন্য যুদ্ধাপরাধী মুসা-বিন-শমসেরকে নিয়ে যে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন সেটি সাংবাদিকতাই। এমনকী এখনো উনি উনার উত্তরাধিকার৭১নিউজে যে খবর প্রকাশ করেন তা সাংবাদিকতাই।



সাংবাদিকতার কারণেই তিনি ২০০১ সালে আক্রান্ত হয়েছেন; গ্রেফতার হয়েছেন ২০১৫ সালে। কারণ স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর হিন্দু সম্পত্তি দখলের অভিযোগটি হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-ঐক্য পরিষদ উত্থাপন করেছে। সেই রেফারেন্সের ভিত্তিতেই সাংবাদিক প্রবীর সিকদার এ বিষয়ে কথা বলেছেন। সাংবাদিকতা নৈতিকতায় এটাও স্পষ্ট উল্লেখ করা রয়েছে, সংখ্যালঘু বা যুদ্ধাক্রান্ত মানুষের প্রতি বিশেষ স্পর্শকাতরতা প্রদর্শন করতে হবে।



প্রবীর সিকদার  যুদ্ধাপরাধী মুসার অপকীর্তি নিয়ে করা জনকন্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন উত্তরাধিকার৭১নিউজে পুনঃপ্রকাশ করার পরপরই উনার কাছে হত্যার হুমকি আসতে থাকে। এটা কমনসেন্স যে, প্রতিবেদনে বিক্ষুব্ধ পক্ষটিই হত্যার হুমকি দিয়েছে; শনি গ্রহের কারো তো হুমকি দেবার কথা নয়।কারণ প্রতিবেদন প্রকাশের আগে হুমকি আসেনি।



এরপরে সামান্য বিরতিতে হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টান ঐক্য পরিষদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দয়াময়ী ভবন ও ৮ বিঘা জমি দখলের বিষয়টিতে প্রবীর সিকদার প্রতিবেদন প্রকাশ করলে হুমকি আসতে শুরু করে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে মঙ্গলগ্রহের কেউ হুমকি দেয়নি। অর্থাৎ জার্নালিজমের কারণেই প্রবীর সিকদার জীবনাশংকায় পড়লেন।



নিয়ম অনুযায়ী তিনি পুলিশের কাছে যান জিডি করতে। পুলিশ জিডি নেয়নি। দুর্নীতিবাজ সাংবাদিক তিনি নন, ছদ্ম চাঁদাবাজির পয়সায় কেনা গাড়ীতে ডিজাইনার শার্ট পরে কাফলিং লাগিয়ে তো যাননি তিনি। পুলিশের তাকে অত কেউকেটা কেউ মনে হয়নি। বাধ্য হয়ে প্রবীর সিকদার উনার ফেসবুক পেজের পোস্টে জন-ডায়েরী করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উনি জনতার আদালতে উনার অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেছেন। যে দুটি প্রতিবেদন পুনঃপ্রকাশ ও প্রকাশের পর মি সিকদারের কাছে হুমকি এসেছে; ঐ প্রতিবেদনে বিক্ষুব্ধ তিনজনের নামই উনি উনার সম্ভাব্য হুমকি প্রদানকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি এসেছে জনমানুষের কন্ঠস্বর হয়ে; জনবান্ধব হিসেবে।



যারা সেই প্রিন্ট মিডিয়ায় কাজ শুরু করেছিলেন; তাদের সাংবাদিকতার সাদাকালো যুগটি ফুরিয়েছে।পৃথিবীর নানাদেশে সংবাদপত্র ছাপা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ নাঈমুল ইসলাম খানদের সাংবাদিকতার সোনালী সময়টি অতিক্রান্ত প্রায়। অভিবাদন ছাপার মাধ্যমে উনাদের সুকৃতির জন্য। কিন্তু মিডিয়া প্যারাডাইম শিফটের কারণে মিডিয়া এখন নিউ মিডিয়া-ইন্টারনেট ভিত্তিক সংবাদপত্র এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় জায়গা করে নিচ্ছে। যারা অনলাইন সাংবাদিক প্রজন্ম তারা জানেন কীভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই খবর দিচ্ছে; শিরোনাম তৈরী করছে। আর সিটিজেন জার্নালিজম প্রচলিত সাংবাদিকতার মনোপলি ভেঙ্গে দিয়েছে।



মি. সিকদারের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের টাইমলাইনে আমরা উনার ওয়েব পোর্টালের খবরের লিংক দেখতে পাই বেশী। আর ডিজিটাল ডায়েরী; সেখানে ব্যক্তিগত চিন্তার উদ্ভাস তো থাকবেই। কিন্তু উনার সাংবাদিকতা এবং ব্যক্তিগত ডায়েরী সাংঘর্ষিক হয়নি। নৈতিকতার জায়গা থেকেও বিচ্যুত হয়নি।



সাংবাদিক হিসেবে প্রিভিলেজ কারা নেয়; কারা সাংবাদিকতাকে টিভি টকশোতে উদ্দেশ্যহীন অন্তঃসারশূণ্য কথার সার্কাসে পরিণত করেছে; তাদেরকে তো আমরা চিনি। প্রবীর সিকদার সাংবাদিকতা করেন; প্রিভিলেজ নিয়ে বেড়ানো খরগোস সমাজের লোক নন উনি। আর খুশওয়ান্ত সিং সাংবাদিক হয়েও অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে যে এক্টিভিজম চালিয়েছেন বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে; সাংবাদিক প্রবীর সিকদারও তাই করেন।



সাংবাদিক নৈর্ব্যক্তিকতা মানে যুদ্ধাপরাধীদের বা অন্যান্য অপরাধীদের পক্ষে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলা নয়। বরং ভিকটিমের পক্ষে কথা বলা।



সাংবাদিকতা বিষয়টির প্রয়োজনই পড়েছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় জনমানুষের কন্ঠস্বর হয়ে ওঠার প্রত্যয়ে। সেই ক্ষেত্রে মূলধারার মিডিয়া কখনো সরকারের পক্ষে কখনো মালিকের পক্ষে সম্পাদকীয় নীতি জলাঞ্জলি দিয়ে জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে অনেকাংশে ব্যর্থ হবার কারণেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিকল্প মিডিয়া হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।



মি. খান হয়তো বয়সের কারণে অনলাইন মিডিয়ার সঙ্গে একটা প্রজন্ম ব্যবধানে পড়ে গেছেন। উনি একজন সাব-এডিটরকে জিজ্ঞেস করলেই সে জানাবে, আজকাল সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই বিভিন্ন উদ্ধৃতি জোগাড় করতে হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন, সাব এডিটরদের চোখ রাখতে হয়েছে তার টুইটার একাউন্টে। বাংলাদেশের দৃশ্যপটও দ্রুত বদলাচ্ছে। ধীরে ধীরে প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতি যোগাড়ের একমাত্র উৎস হয়ে দাঁড়াবে সোশ্যাল মিডিয়া।



আর সোশ্যাল মিডিয়াও কয়েক বছরে পরিণত এবং বিকশিত হয়েছে। ইউফোরিয়ার সময় শেষ হয়ে এসেছে। এখন মূলধারার মিডিয়ার আগেই খবর আসে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই মুহূর্তে ভুরুঙ্গামারীতে কোন ঘটনা ঘটলে ঘটনাস্থল থেকে একজন পথচারীই ছবি তুলে ঘটনাটা ফেসবুকে জানিয়ে দেয়। কখন রিপোর্টার আসবে; রিপোর্ট ফাইল করবে, সেই রিপোর্ট সম্পাদনা হবে, বার্তা সম্পাদক গম্ভীরভাবে চোখ বুলিয়ে দয়া করে ছাড়লে খবরটা আসবে; এ যুগে এতো সময় কারো হাতে আছে নাকি যে অপেক্ষা করবে খবরের জন্য!



অথবা এই যে সিলেটের শিশু রাজন হত্যা; এই হত্যাকান্ডের ভিডিও ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা না হলে, মূলধারার মিডিয়া জানতেই পারতো না রাজনের ট্র্যাজেডী। মানুষ বঞ্চিত হতো সমাজের আসল ছবিটি দেখা থেকে।সামাজিক নিমজ্জন তুলে ধরতে মূলধারার মিডিয়ার অনেক দিনের সীমাবদ্ধতা ও মিডিওক্রেসির কারণেই আজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এসে মূল সত্যটি আবিষ্কার করছে সমাজ সম্পর্কে।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ