আজ মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

সবকিছু মিডিয়ার সৃষ্টি

মাসকাওয়াথ আহসান  

হঠাত ভরদুপুরে ঘুম থেকে উঠে গুঞ্জন রায়ের ওপর মতিউর রহমান নিজামী ভর করে। সে তোতা পাখীর মত বলতে থাকে সব কিছু মিডিয়ার সৃষ্টি।



কালে কালে সৃষ্টিকর্তা জোড়ায় জোড়ায় মীরজাফর ও জগতশেঠ জন্ম দেন। এইটাই জগতের নিয়ম। বিশ্বাসঘাতকতা একটি কাঠি দৌড়। সুতরাং নিজামী ও গুঞ্জন উভয়েই চার্মিং যে যার বৃত্তে। নিজামী যখন মিষ্টি মিষ্টি করে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতো; আয়োডিনের অভাবগ্রস্ত কিছু লোকের তাকে সাক্ষাত দরবেশ মনে হতো। গুঞ্জন যখন কন্ঠটাকে বেজে ফেলে খবর পাঠক দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়কে কপি করে অত্র এলাকার তারুণ্যকে জিজ্ঞেস করে, কেহমন আহছিসরে দাদাভাই; ছেলেপেলের আনন্দে পিলে চমকে যায়। এতো বিরাট বড় সেলিব্রেটি অথচ চলনে বলনে কী সাদাসিধে! এ বুঝি স্বর্গ থেকে দেবদূত নেমে এসেছে।

নিজামীর যেমন কাজ ছিলো মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে দুষ্টু দুষ্টু হাসি দেয়া; গুঞ্জনের প্যাটার্ণটাও একই। নিজামী নিজামী ভাব; শুধু দাড়িটার অভাব।

সামাজিক সিমপ্যাথি আদায়-এর কৌশলগুলো এজাতের লোকের ভালো থাকে। ফলে রাজনীতির বড় বড় রুইকাতলাদের কাছে হাত পেতে সাহায্য নিতে কোন সংকোচ নেই, আবার কখনো নিজের একটা ছদ্ম আভিজাত্য তুলে ধরতে কটা গাড়ী চেঞ্জ করেছে সে গল্পটাও শুনিয়ে দেয়। নিজামী সাদা পাঞ্জাবী পরতো; তাই গুঞ্জন রঙ্গিন পাঞ্জাবী পরে। সেক্যুলারের ভং ধরতে  আলাদা রঙের পাঞ্জাবী তো পরতেই হবে।

পারিবারিক সম্পত্তি থেকে নিজামী তার বোনদের বঞ্চিত করেছে, শরিয়া আইনের ভুজুং ভাজুং দিয়ে। গুঞ্জন একি কাজ করেছে সেক্যুলার কলাকৈবল্যে। সবার সামনে সাধুবাবার যে ভং-টা গুঞ্জন ধরে রেখেছে; কেউ বিশ্বাসই করবে না; গুঞ্জন বোনকে ফাঁকি দিতে এতো এবস্ট্রাক্ট থিয়েটার করেছে।

১৯৭১ সালে নিজামী দক্ষ দেখে পক্ষ নিয়ে ধরা খেয়েছে ২০১০ সালে। সেই হিসেবে গুঞ্জন ২০১০ সালে দক্ষ দেখে পক্ষ নিয়ে কত সালে ধরা খাবে ওটা ক্যালকুলেটার টিপে দেখে নিলেই হয়।

এখানে লক্ষ্যণীয় যে খুব সন্তর্পণে নিজামী যে ওহাবী পক্ষ নিয়েছিলো; গুঞ্জনও ঠিক সেই ওহাবী পক্ষই নিয়েছে। এর ওপরে চার্বাক দর্শনের গেরুয়া চড়িয়ে। “ঋণ করে ঘি খাই”।

নিজামীকে গাড়ীতে চড়ে সহাস্যে ঘুরতে দেখেই গুঞ্জনের মধ্যে গাড়ীতে চড়ার জিদ চেপেছিলো। সেকারণে ফেসবুকে গুঞ্জনের গাড়ীতে বসে ছবি উত্তোলনের এক গালফি রোগ হয়েছে।এর মধ্যে আরো কিছু নান্দনিক টোটকা তো জানাই আছে তার। জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাঁচটা লাইন, হঠাত হঠাত “ইচ্ছে করে সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে পাহাড়ে চলে যাই” টাইপের গৌতম বুদ্ধ ঘরানার ডায়ালগ, আর দেশপ্রেমের অশ্রুজলে ভিজিয়ে দেয়া শুষ্ক মাটি; ব্যাস; গুঞ্জন রায় হয়ে ওঠে দেশপ্রেমের ঠিকাদার। চারিদিকে ষড়যন্ত্র; লুকিং ফর শত্রুজ; কিন্তু গুঞ্জনের শরীরের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে রক্ষা করবে দেশমাতৃকাকে। গুঞ্জনের কথা শুনলে মনে হবে, অযথা সেনাবাহিনী রাখা হয়েছে; এক গুঞ্জনই যথেষ্ট।

গুঞ্জন তার স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সবই করতে পারে। তার মধ্যে বিকশিত এক অনিবার্য তৈলকার। গুঞ্জন মাঝে মধ্যে নিজেকে এক নির্যাতিত সংখ্যালঘু হিসেবে তুলে ধরে। তবে অন্য সংখ্যালঘুদের নির্যাতনে ওহাবী শান্তিকারদের হয়ে ওকালতি করে। নব উত্থিত গুঞ্জনের সিলেক্টিভ ট্রুথ নিয়ে তৈরী করা তৈলকর্ম নিয়ে ইদানীং তৈলকার মহেশ্বর রায় চিন্তিত। পাছে পারফরমেন্সে গুঞ্জন তাকে পিছে ফেলে না দেয়।

গুঞ্জনের বাবা-কাকারা খাঁটি মানুষ ছিলেন। কাজেই পরিবার নয়; পরিপার্শ্বই গুঞ্জনের এই মেটামরফসিসের কারণ। গুঞ্জনের স্ত্রী’র ভালো লাগতো গুঞ্জনের সেই স্বপ্ন দেখার কালকে; যখন গুঞ্জন বল পয়েন্ট কলমে নিউজপ্রিন্টে খস খস করে নির্যাতিত মানুষের পক্ষে লিখতো। সেই গুঞ্জন নির্যাতকের পক্ষে “ হিজ মাস্টার্স’ ভয়েস” হয়ে পড়বে এ কথা সে জীবনেও ভাবেনি। মাঝে মধ্যে বলে, গুঞ্জন ছাড়ো না এসব। এমনিতেই তো আমরা ভালো থাকতে পারি। এই বদলে যাওয়া গুঞ্জন আমার ভালো লাগে না।

গুঞ্জনের এক কবি বড় ভাই বলে, গুঞ্জন বাদ দাও না শান্তিকারী; এসো আবুল হাসানের কবিতা নিয়ে গল্প করি।
গুঞ্জন হেসে বলে, আবুল হাসানের “উদিত দুঃখের দেশে” কবিতাটির নাম এখন হবে “উদিত সুখের দেশে”। কবি বড় ভাই অবাক হয়। ইচ্ছে হয় ওর মুখে ছিপি দিয়ে দিতে।

গুঞ্জন খুব হাইকমান্ডের চোখে পড়ার চেষ্টা করে। নাকে রঙ্গিন বল লাগিয়ে ডিগবাজী দেয়। গালে দুঢেলা লাল রঙ মেখে রিং-এর মাঝ দিয়ে লাফ দেয়। সোশিওপ্যাথ হয়ে পড়ে। শিশু হত্যা-নারী নিগ্রহ-হত্যা-লুন্ঠন-হিন্দু সম্পত্তি দখল কিছুই আর তাকে স্পর্শ করেনা। হয়তো ইট-পাথরের শহরটাই কাল হয়েছে; গুঞ্জনের কোমল হৃদয়টি এখন একটি পাথরের ঢেলায় পরিণত হয়েছে। এ যেন ম্যাটাডোরের ষাঁড়ের লড়াই-এর লালকাপড় ওড়ানো এক অন্যগুঞ্জন। ঘুমের মধ্যে সে একটা সিঁড়ি দেখতে পায়। আকাশ থেকে নেমে আসছে একটা সিঁড়ি। গুঞ্জন হাত দিয়ে সিঁড়িটাকে ধরতে গেলেই সিঁড়িটা ফস্কে যায়। ঘুম ভেঙ্গে ওঠে ফস করে একটা সিগ্রেট ধরায়। ব্যালকনীতে পায়চারী করে। একবার আকাশের দিকে তাকায়; না সিঁড়িটা নেই।

ওদিকে হাইকমান্ডও অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে তৈলকারদের এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যারা সমালোচক তাদের পরামর্শকেই বেশী গ্রহণযোগ্য মনে হতে থাকে। কারণ অন্য সব গুঞ্জনদের অধিক ভক্তি চোরের লক্ষণ হিসেবে প্রতিভাত হয়।

গুঞ্জনের দুঃখ হয়, দীর্ঘশ্বাসে বলে, আমিও বিধবা হলেম, আর বাজারে লাল পেড়ে শাড়ী এলো। নিজেকে একজন ব্যর্থ তৈলকার মনে হয়।

সিগ্রেট শেষ করে গুঞ্জন ঘুমিয়ে পড়ে। এবার দেখে কিছু বানর একটা সিঁড়ি নিয়ে শিয়রে দাঁড়িয়ে। বানরগুলো গুঞ্জনকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। সবাই সমস্বরে বলে ও বস, ও দাদা ঘুম থেকে উঠুন; এই দেখুন আপনার ওপরে ওঠার সিঁড়ি। বানরেরা হাইকমান্ডের বাড়ীতে নিয়ে যায়। সেলফি তোলে। অবশ্য হাইকমান্ড তখন বাড়ী নেই। বানরেরা অটোগ্রাফ নেয় গুঞ্জনদার। একজন পন্ডিত প্রকৃতির আইটি গিক বানর বলে, অত্র তল্লাটে গুঞ্জনদার মতন স্বাধীনতার চেতনা নিয়া এতোবার কেউ কতা বলে নাই; উনার স্বাধীনতা পদক ডিউ হয়ে গেছে।

এমন সময় চৌকিদার এসে খবর দেয়, উনি বাড়ী ফিরতেছেন; আপনেরা এখন ফুটেন।

গুঞ্জনের মনটা ডুকরে কেঁদে ওঠে।চৌকিদারকে বলে, ইস একবার যদি দেখা পেতাম, বুক চিরে দেখিয়ে দিতাম দলের প্রতি আনুগত্য।

চৌকিদার বলে, দিন বদল হইছে দাদা। মুশতাকের মত অনুগতদের আর ফিউচার নাই। হাইকমান্ড এখন সৈয়দ নজরুল-তাজউদ্দীনদেরকেই ভালোবাসেন।

গুঞ্জন চিৎকার করে বলে, সিঁড়িটা কই; সিঁড়িটা কই! দেখে বানরেরা দৌড়ে নানা দিকে পালাচ্ছে। সিঁড়িটাও নেই।

আচমকা ঘুম ভেঙ্গে দেখে বালিশের কাছে একটা বলপয়েন্ট কলম আর নিউজপ্রিন্টের নোটবুক।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ