প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আজম খান | ০৫ অক্টোবর, ২০১৫
২৪ বছরের পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসনের আগে আমরা ২০০ বছর ছিলাম ব্রিটিশ বুটের তলায়। ইংরেজরা আমাদের এখানে এই সুদীর্ঘ সময়ে নিজেদের শাসনের স্বার্থে বুঝিয়েছিলো, ব্যবসা হতে চাকুরি উত্তম। এই অঞ্চলের মানুষ ব্যবসায়ী হয়ে সম্পদ অর্জন করুক তারা তা শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত চায় নি। তারা অনুগত একটি মানবগোষ্ঠী চেয়েছিল যারা তাদের হয়ে কাজকর্ম করবে, সাধারণ মানুষ হতে ট্যাক্স উঠাবে। তাই একই সাথে তারা তৈরি করেছিল জোতদার, জমিদার এবং চাকুরে সম্প্রদায়। ইংরেজ আমল শেষ হয়েছে প্রায় ৭০ বছরের কাছাকাছি হয়ে গেলো কিন্তু আজো আমাদের অধিকাংশ তরুণের স্বপ্ন একটি ভাল চাকরি করা। স্ব-উদ্যোগে কোন প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো নয়। ইদানীং সে হালে কিছুটা পরিবর্তন হলেও তার গতি বড্ড ধীর।
এই অঞ্চলে ইসলামের আবির্ভাব হয়েছিল আনুমানিক খ্রিস্টাব্দ ৭ম কি অষ্টম শতাব্দীর কোন এক সময়ে। শোনা যায়, ইসলাম প্রচারের জন্য ইসলামের নবীর কোন কোন সাহাবি এই অঞ্চলে এসেছিলেন। যদিও তার কোন দালিলীক প্রমাণ নেই। ৯ম, ১০ম শতাব্দীতে এই অঞ্চলে পারস্য থেকে মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সুফিরা আসেন। তারা ভালবাসা দিয়ে মানুষকে জয় করতে চেয়েছিলেন। সেসব সাধুরা নব মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ প্রত্যেককে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল সার্বজনীন। এই ভূ খন্ডে মুসলমানদের মধ্যে সর্ব প্রথম তরবারি ব্যাবহার করেন ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি। লুটপাটের নেশায় আসক্ত এই তরুণ ডাকাত ছিলেন যেমন সম্পদ পিপাসু, তেমনি রক্ত পিপাসু। বাঙ্গালির প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী, এমনকি ইসলামের বয়সের চাইতেও বেশী পুরানো পৃথিবীর সর্ব প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখে তিনি ভেবেছিলেন কোন সমৃদ্ধ নগরী। সম্পদ বের করে দেয়ার জন্য আচার্য এবং অন্যান্য শিক্ষকদের উপরে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। তরবারি আর আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় কয়েক হাজার শিক্ষার্থী এবং অধিবাসীকে। এই বর্বর কল্পনাও করতে পারেনি নথিতে ভরা এই নগরী কোন কোষাগার নয়। সেই শুরু। কালক্রমে বাঙ্গালিকে শাসন করেছে তুর্কী, ইরানী, আফগান, আফ্রিকা থেকে আসা মামলুকেরা। রাজভাষা হিসেবে সমাদৃত হয়েছে তুর্কী, ফার্সি। সেসব শাসকেরা এমনকি রাজকার্য পরিচালনা করেছেন অধিকাংশ সময়ে তাদের যার যার জাতির জনবল দিয়ে। সনাতন ধর্মের মত করে এখানকার মুসলিমদের উপরেও আরোপ করা হয়েছিল জাত প্রথা।
প্রচলন করা হয়েছিলো আশরাফ এবং আতরাফ শ্রেণীর। আশরাফ ছিলেন এই অঞ্চলের বাইরে থেকে আসা মুসলিমরা। খুব স্বল্প পরিমাণে এ অঞ্চলের মানুষেরা আশরাফ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। অবশ্যই শুধু মাত্র ধনীরা। অন্যদিকে, বাদবাকি ৯৯ ভাগ বাঙ্গালি মুসলমানকে রেখে দেয়া হয়েছিল আতরাফ হিসেবে। তারা নিচু শ্রেণীর মুসলমান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন অনেক কারণে। এরমধ্যে প্রণিধানযোগ্য হচ্ছে দুটি। একটি কারণ হচ্ছে তাদের পূর্ব পুরুষেরা হিন্দু বা অন্য কোন ধর্মাবলম্বী ছিলেন। অন্যটি হচ্ছে, দৈহিক বরণ কালো কিংবা শ্যাম বরণের এবং দৈহিক আকৃতি, উচ্চতা। এমনকি, তাদের ভাষাটাও যে নিম্ন পর্যায়ভুক্ত তাও বার বার মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে। সাহিত্যেও অবহেলিত ছিল আমাদের ভাষা। কারণ আমাদের সাহিত্যিকদের শুধু মাত্র ভাষাগত কারণে অচ্ছুত করে দেয়া হয়েছিল। সে সময়ের শিল্পকর্মগুলোতেও আমরা দেখি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে মধ্য এশিয়ার রীতিকে। অথচ, আমাদের নিজেদের শিল্পকলা তাদের চাইতেও পুরানো ইতিহাসের সাক্ষী, সে সময়েও ছিল যে কোন বিচারে সুনিপুণ। এভাবে ধাপে বিদেশী শাসকেরা তাদের শাসনের সুবিধার্থে আমাদের মনোজগতকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। এক সময়ে আমরা তাদের ভাষাকেই ঐশ্বরিক হিসেবে মেনে নিলাম। এমনকি, ধর্মটাকেও তাদের মত পালনের ব্রত নিলাম। একটা জাতির জন্য কি গ্লানিকর মর্মন্তুদ ব্যাপার, তাই না?
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান পত্তনের পরে পশ্চিম পাকিস্তানীরাও একই রাস্তা নিলো। ভাষা একটি জাতি গোষ্ঠীর প্রাণ স্পন্দন। বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানী আলফ্রেড কিনসে যাকে আখ্যা দিয়েছেন "লাইফ সাইন" হিসেবে। পাকিস্তানীরা শত শত বছর ধরে শাসন করা তুর্কী, ইরানী, আরব শাসকদের চাইতেও আক্রমণাত্মক হয়ে চেয়েছিলো বাঙ্গালি জাতির প্রাণ স্পন্দন হত্যা করে নির্জীব, শিকড়হীন একটি জাতি তৈরি করতে। তাই তারা উর্দু নামক একটি কৃত্রিম ভাষা চাপিয়ে দিতে। যে ভাষার কোন ইতিহাস নেই, পরম্পরা নেই, পাকিস্তান তৈরির সাথে সাথে সে ভাষার জন্ম হয়েছিল। যার কারণে তাদের বর্ণমালাটা পর্যন্ত আরব থেকে ধার করে নিয়ে আসতে হয়েছিল। ১৯৫২ সালের সেই উত্তাল সময়ে বাঙ্গালি তা মেনে নেয়নি। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ব-দ্বীপ থেকে উর্দুকে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিলেন। কিন্তু মন? সেখান থেকে কি ৮০০ বছরের ঔপনিবেশিক ক্লেদ দূর হয়েছিল?
আমরা যারা জীবনে নুন্যতম ধর্ম কর্ম করেছি বা করতে দেখেছি বাঙ্গালি মুসলমান তাদের ধর্মীয় আয়োজনে আজো ফার্সি কিংবা উর্দু ব্যাবহার হয়। যেন এই ভাষাগুলোকে তাদের উপাস্য নৈকট্য লাভে ব্যাবহার করতে বলেছেন। নতুবা তিনি বাংলা ভাষা বুঝেন না। আমি জানি, যারা ধর্ম মানেন তারা উপরের দুইটি যুক্তির একটিকেও মানবেন না। আসলে সমস্যাটা নিতান্তই মনস্তাত্ত্বিক। নিজেকে নিজের শেকড়কে হীনভাবে চেতন কিংবা অবচেতন মনে উপস্থাপনের চেষ্টা। আমাদের মাদ্রাসার কেতাব সমূহের অধিকাংশ ফার্সি কিংবা আরবিতে। হুজুর মোনাজাত ধরেন কিন্তু তিনি কি বলেন অধিকাংশ সময়ে বুঝা যায় না। কারণ তা আরবি নয়তো ফার্সি। এখনো এই দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষদের অধিকাংশ এসব ভিনদেশী ভাষাকে পবিত্র জ্ঞান করেন। এমনকি, আধুনিক মনা অনেক মানুষ একটি বাক্যের মধ্যে তিনটি বাংলা শব্দ, চারটি ইংরেজি শব্দ ব্যাবহার করেন। যার সবচাইতে বড় প্রমাণ নানা এফএম রেডিওর আরজেরা। তাদের কথা শুনলে মাঝেমধ্যে মনে হয় তারা ভাষা ভিত্তিক কোন খিচুড়ি বানাচ্ছেন। কেউ কেউ বা "র" কে "ড়" উচ্চারণ করেন ইংরেজি ভাষার আদলে। ইংরেজিতে "র" শব্দটি নেই। তাই তারা তা উচ্চারণ করতে অভ্যস্ত নন। কিন্তু আমাদের বর্ণমালায় দুটি অক্ষরই বিদ্যমান। আমাদের ভাষা এতটাই সমৃদ্ধ। কিন্তু সেই উপনিবেশিক মনের কারণে অন্যকে শ্রেষ্ঠ ভাবতেই আমরা বেশী ভালবাসি।
টিভিতে রমজান মাসে নানা চ্যানেলে ইসলামি ঘরানার সঙ্গীতের আয়োজন থাকে। সেখানেও দেখি উর্দু কিংবা ফার্সি গজল প্রায়শই থাকে। শিল্প নিয়ে কোন সমস্যা নেই, থাকা উচিতও নয়। কিন্তু শিল্পের যে ধরনের প্রকাশ হীন মানসিকতা থেকে আসে তা নিশ্চিতভাবে আর যাই হোক মঙ্গলদায়ক নয়।
সালমাদের এবারের সফরের চূড়ান্ত রকমের বিরোধী ছিলাম। সাকিব-মাশরাফিরা হলে আমি মোটামুটি নিশ্চিত ও সফর বিরোধিতার চোটে হতে পারতো না। কিন্তু মেয়েদের ক্রিকেটের গ্ল্যামার কিংবা প্রচার পসার দুটোই কম। প্রতিবাদ করাটা প্রচারণার দিক দিয়ে খুব অলাভজনক ছিল বিধায় হয়তো যে পরিমাণে হবার কথা ছিল সে পরিমাণে হয়নি। বিরক্তির চোটে এ সফর নিয়ে বন্ধুবর শরীফ ভাইর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লাইক দিয়ে একমত পোষণ করেছিলাম এবার তারা যেমন খেলুক তা মাথাতেই আনবো না। কিন্তু আঁতে ঘা দিলেন নারী দলের অধিনায়ক সালমা উর্দুতে সংবাদ সম্মেলনে জবাব দিয়ে। উর্দুর সাথে আমাদের বৈরিতা নাড়ির মধ্যে। ভাষার লড়াই দিয়ে এই দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের সুদীর্ঘ সূচনা। এই দেশের প্রতিনিধি হিসেবে উর্দুতে কথা বলে সম্মান ধুলোয় লুটিয়েছেন। সালমার উর্দু প্রীতি বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। ছোটকাল থেকে এই দেশের অন্য অনেক তরুণ তরুণীর মত উর্দুকে আশরাফদের ভাষা হিসেবে জেনে এসেছেন। হয়তো সংবাদ সম্মেলনে উর্দুতে কথা বলে নিজেকেও আশরাফ মুসলমান হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হায়, এই দেশের এরকম অনেক সালমার মত তিনিও জানেন না রক্ত দিয়ে যে ভাষার অধিকার একবার রক্ত দিয়ে অর্জিত হয় তার চাইতে পবিত্র এবং গর্বের কিছু পৃথিবীতে আর হয় না, কখনো হবেও না।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য