আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

পাকিস্তানি সাফাই সাক্ষী : অস্বাভাবিক কিছু কি?

কবির য়াহমদ  

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের পাকিস্তান সংযোগের কাহিনী সকলের জানা। তাদের পক্ষে পাকিস্তানে প্রতিক্রিয়া হবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ, কেবল একাত্তরেই নয় জীবনের সকল পর্যায়েই তারা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত ছিল। সে হিসেবে সেখানে তাদের একটা শুভাকাঙ্ক্ষী মহল গড়ে ওঠাটাই অস্বাভাবিক কিছু নয়।

নিকট অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায়, যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পর পাকিস্তান পার্লামেন্টে শোক প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে। সেখানকার বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, সরকারের মন্ত্রী বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বিষোদগার করেছে, প্রধান রাজনৈতিক নেতা সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান সহ সেখানকার অনেকেই ফাঁসি কার্যকর নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।

অতি উৎসাহী অনেকেই বাংলাদেশ আক্রমণের কথাও হয়ত বলেছে। কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন সংক্রান্ত দাবি এসব ত ডাল-ভাতের পর্যায়ে। এ নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কিছু নাই। এক হিসেবে পুরো বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেও ভাবা যায় কারণ যারা পেছন ভুলে যাওয়ার নসিহত দিয়ে যাচ্ছিল নিত্য এটা তাদের জন্যে বিশাল এক চপেটাঘাত বলা যায়। তবে এখানেও ভাবনার আছে কিছু, কারণ সে বোধজ্ঞান তাদের অবশিষ্ট আছে কীনা সেও প্রশ্ন।

কষ্টকল্পিত ধারণা যে, পাকিস্তানপ্রেম আমাদের সমাজে এতখানি তীব্র যে অনেকক্ষেত্রে অনেকেই তুলনামূলক আলোচনায় পাকিস্তানকেই এগিয়ে রাখতে পছন্দ করেন।

শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী তার পুরো জীবনে ধরাকে সরা জ্ঞানে স্বেচ্চাচারিতা চালিয়ে এসেছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলাকালে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিচারকদেরকেও অপমান করে এসেছেন। তিনি কখনই ভাবেননি যে তার এমন পরিণতি হতে পারে। প্রথমে একে আত্মবিশ্বাস ভাবা হলেও এখন এটা পরিস্কার যে কাদেরকে তিনি খুঁটির জোর ভেবেছিলেন। তার ভাবনাগুলো ঠিকই ছিল কারণ এখন পর্যন্ত তাকে বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে তার পুরনো বন্ধু পাকিস্তানই।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগ চুড়ান্ত রায়ে সাকা চৌধুরীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর মামলার রিভিউয়ের পর্যায়ে সাক্ষ্য নেওয়ার বিধান ও নজির নাই- এটা সাকা চৌধুরীর আইনজীবিরাও জানে, কিন্তু তবু তারা এ পর্যায়ে সাক্ষী তলবের আবেদন করেছেন। উদ্দেশ্য পরিস্কার- বিচার প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করা। এটা উল্লেখের দাবি রাখে, এ মামলার সকল পর্যায়েই সব ধরণের অপপ্রচারকে অতিক্রম করে চুড়ান্ত রায়ের পর এ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী ফাঁসি কার্যকরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে। ট্রাইব্যুনালের রায়ের ঠিক আগে খসড়া রায় ফাঁস থেকে শুরু করে কী করেনি তারা? সুখবর হচ্ছে ফাঁসকৃত সে রায় ছিল ভুয়া, যা প্রমাণ হয়েছিল আগেই।

এত বাধা বিপত্তি, অপপ্রচারের পর মামলার রিভিউয়ের সময়ে তার পক্ষে ৫ পাকিস্তানির সাক্ষ্য দিতে চাওয়া আমাদের জন্যে বিব্রতকর ও খানিকটা আশঙ্কার হলেও সাকা চৌধুরীর জন্যে নিশ্চয়ই আশাপ্রদ যে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তার স্বজাতি তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। আমরা আতঙ্কিত হই যদি কোন কারণে পার পেয়ে যায় সে? যদিও এ ধরনের মামলায় অপরাধীর পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ সামান্যই। কারণ, রিভিউ করা হয় শাস্তির প্রকাশে আইন ব্যাখ্যার কোনো ব্যত্যয় হয়েছে কিনা তা পর্যালোচনার জন্যেই।

আদতে সাকা চৌধুরীর পক্ষে পাকিস্তানিদের হাজির করেছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। বার্গম্যান জাতীয়তায় ব্রিটিশ হলেও বাংলাদেশে থাকেন এবং সম্পর্কে তিনি ড. কামাল হোসেনের মেয়ের জামাই। এ সাংবাদিক আদালত অবমাননার কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে শাস্তিপ্রাপ্ত, এবং তার একমাত্র কাজই ট্রাইব্যুনাল ও বাংলাদেশে চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে অপপ্রচার।

সাকা চৌধুরীর আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদনের দিন (সোমবার, ১৯ অক্টোবর) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা অনলাইনে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে শাস্তিপ্রাপ্ত এ ব্রিটিশ সাংবাদিক পাঁচ পাকিস্তানি সাকার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে চায় বলে প্রতিবেদন প্রকাশের পর সাকা চৌধুরীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য আটজন দেশি-বিদেশির নাম উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় একটি আবেদন করা হয়। সাকা চৌধুরীর পক্ষে আদালতে এসে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ওই আটজনের নামে সমন জারির আবেদন জানানো হয়। এ ধরনের আবেদন গ্রহণ নজিরবিহীন হলেও মূল সিদ্ধান্ত দেবেন আদালতই।

চতুর সাকা চৌধুরী, তার আইনজীবি ও ডেভিড বার্গম্যান ভালো করেই জানেন রিভিউয়ের পাকিস্তানি কেন বাংলাদেশের নাগরিক কারোরই সাক্ষী হওয়ার সুযোগ নাই, কিন্তু তবু তা সামনে আনা হয়েছে কারণ এর মাধ্যমে বিদেশে ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে অপপ্রচার চালানো যাবে। সাকা চৌধুরী বিএনপি নেতা হলেও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধিকাংশই জামায়াতে ইসলামির নেতা। যে কোন ভাবে এ বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করাতে পারলে রাজনৈতিকভাবে তারাই লাভবান হবে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশিয় দোসরেরা একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল। পাকিস্তান এখনও সে গণহত্যাকে অপরাধ বলে স্বীকার করে না, ক্ষমা চায় নি এবং সে সম্ভাবনাও নাই। সে হিসেবে তাদের সাক্ষ্য দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। যদি একাত্তরের গণহত্যাকে তারা অপরাধ হিসেবে দেখত, ক্ষমা চাইত, তবে প্রশ্ন আসত- একাত্তরে সাকা কোথায় ছিল অথবা ছিল না। যদিও আইসিটি ও আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষ প্রয়োজনীয় সাক্ষী, তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন একাত্তরে সাকা বাংলাদেশে ছিল, সে পাকিস্তানিদের সাথে গণহত্যার অংশীদার ছিল এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ তার মাধ্যমে সম্পাদিত হয়েছে।

শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর (সাকা চৌধুরী) পক্ষে পাকিস্তানিদের শেষ চেষ্টা আমাদের বিচলিত করছে ঠিক, কিন্তু স্বস্তির খবর হলো এর মাধ্যমে পাকিস্তানিরা তাদের আপনজনকে আর একবার প্রকাশ করল সকলের সামনে।

যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের পর পাকিস্তান প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল, সাকা চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকরের আগে থেকেই করছে; পার্থক্য এখানেই। যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি কার্যকর পথে পাকিস্তানিরা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে- এ সংবাদ প্রকাশ হলে আমরা বিব্রত হচ্ছি ঠিকই, কিন্তু নির্মোহ ও ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলে আশ্বস্ত হতে পারি আমরা ভুল করছি না, ট্রাইব্যুনাল ভুল করছে না; বাংলাদেশের বিচার বিভাগ ভুল করছে না।

পাকিস্তানিরা যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার পর যদি কখনও প্রতিক্রিয়া না দেখায় সে দিন আমাদেরকে ভাবতে হবে- কোথাও কোন ভুল করছি না ত!

কবির য়াহমদ, প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর; ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ