আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

আমিও বিচার চাই না

বন্যা আহমেদ  

দীপনের বাবার মত আমিও বিচার চাইনা। আমি নিশ্চিত জানি টুটূলের স্ত্রী, দীপনের স্ত্রী, অনন্তের বোন, রাজিব, বাবু, নীলয়ের বন্ধুরাও আর বিচার চান না।

বাবাকে (ড. অজয় রায়) ফোন করলে উনি এখনো আশার কথা বলেন, জীবন যে থেমে থাকেনা সেটা বলেন, আমাকে অনুপ্রেরণা দেন যাতে আমি থেমে না যাই, আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে বলেন। আশি বছরের একজন সন্তানহারা পিতার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যাই, নিজেকে বলি, ওনারা এরকম ছিলেন বলেইতো একাত্তরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছিলেন। কিন্তু আমরা পারিনি, আমাদের প্রজন্ম পারেনি, সংখ্যায় ওরা ক্রমাগত বাড়ছে, খালি মাঠে যেভাবে আগাছা বেড়ে ওঠে প্রবল উদ্যমে। আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতাই ওদের এভাবে আগাছার মত বাড়তে দিচ্ছে।

এই সরকারের কাছ থেকেও কিছু চাওয়ার নেই আমাদের, একটাই অনুরোধ ওনাদের কাছে, দয়া করে দিনরাত আর ‘আমরা সেক্যুলার পার্টি’ বলে গলা ফাটিয়ে নিজেদের এনার্জি নষ্ট করবেন না। আপনারা আপনাদের লক্ষ্য পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত চুপ করেই থাকুন; অভিজিৎ, অনন্ত, রাজিব, নিলয়, বাবু, দীপনরা আপনাদের জন্য একেকটা স্কোর কার্ড। আপনারা বুক ফুলিয়ে বলে যান যে সবই ‘রাজনৈতিক খেলা’ সবই ‘পারসেপশান’।

মৌলবাদীদের চাপাতিতে নিশ্চুপভাবে তেল দিয়ে যান, না হলে আপনাদের ভোট কমে যেতে পারে। আপনারা খুব ভালো করে জানেন যে আপনাদের মৌনতাই ওদের অস্ত্রে শান দিতে সহায়তা করে যাচ্ছে। হয়তো আমরা দিনের বেলায় ভুল করে একে নিশ্চুপতা ভাবি। কে জানে, রাতের অন্ধকারে আপনারা হয়তো মুখর হয়ে ওঠেন, ভোট ভাগাভাগি করে নেওয়ার খেলায় যোগ দেন তাদের সাথে। আপনাদের দোহাই লাগে আপনারা ভোটের থলি পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত চুপ করেই থাকুন, আমরা আপনাদের কাছে আর কোনদিন বিচার চাইতে আসবোনা।

যারা মরেছে তারাতো মরেছেই, তাদেরকে তো আর পাবোনা, কোনদিনো না, ওরা আসবেনা। এই উদাসীন প্রকৃতির সীমাহীন নিস্তদ্ধতার মাঝে মাথা কুটে মরলেও ওরা আর আসবেনা।

আমি আশির দশকের শেষে ঢাকা মেডিকেলে পড়েছিলাম দুই বছর। মনে আছে, আমরা বলতাম জামাত-শিবির কোনদিনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে ঢোকার সাহস পাবেনা। তখন তো আনসারুল্লাহর মত জঙ্গি দলদের কথা চিন্তাও করতে পারতামনা। আজ শুধু তারা সেখানে ঢোকেইনি, চোখের সামনে একের পর এক হত্যার উন্মত্ত হোলি খেলাও চালিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা সবাই ওদের প্রলয় নৃত্য দেখে অসহায়, স্তম্ভিত।

দীপনের বাবা, অভিজিতের বাবারা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন সেখানেই, চোখের সামনেই, জঙ্গিরা চাপাতি চালায় তাদের ছেলেমেয়েদের উপর, বড্ড সাহস আজ তাদের। আজকাল আর রাতের আঁধারে চুপিসারেও আঘাত হানতে হয়না ওদের। আলোকিত রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ, পুলিশের সামনেই তারা বুক ফুলিয়ে চাপাতি চালায়।

আমি নিজেই তো, মাথায় চারটা চাপাতির আঘাত আর ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকা আঙুল হারানো হাত নিয়ে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাহায্য ভিক্ষা করেছিলাম শত শত মানুষের কাছে! লোকে লোকারণ্য সেই রাস্তায় কেউ কি এগিয়ে এসেছিল? জীবন এগিয়ে আসার আগে মানুষেরা গোল হয়ে ঘিরে মজা দেখেছে, পুলিশও ছিল সেই ভীড়ে। জীবনদের সংখ্যা এখন খুব কমে গেছে, ওদের মত মানুষেরা আজ দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে।

আমাদের শোক আর ক্রোধে পরিণত হয়না, আমরা আর '৫২ তৈরি করতে পারিনা, আমরা আর '৬৯, '৭১ তৈরি করতে পারিনা। নির্যাতনের এই রাষ্ট্রযন্ত্র আজ এতটাই সার্থকভাবে আমাদের স্তব্ধ করে দিতে পেরেছে যে আমরা ভয়ে নিথর হয়ে যাই। আলোর সামনে অসহায় হরিণের দল যেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ঠিক তেমনি আমরাও দাঁড়িয়ে থাকি রক্তাক্ত এই দেশ দেখে।

অনেকের কাছে শুনেছি, আজকাল যারা এগিয়ে আসে সাহায্যের জন্য তাদেরকেই নাকি পুলিশ উলটো হেনস্থা করে, সেই ভয়ে কেউ আর এগিয়েও আসেনা। তাই নীলয়কে ঘরে ঢুকে হত্যা করা যায়, অনন্তকে রাস্তার দিনের আলোয় শিকার করা যায়, টুটুল, রণদা, তারেককে অফিসে ঢুকে বহু মানুষের মধ্যেও কুপানো যায়, দীপনকে আজিজ সুপার মার্কেটের মত ভীড়ের জায়গায়ও খুন করা যায়। খুনীরা জানে ওদের আর কোন ভয় নেই, ওরা জানে ওদের অভয়ারণ্য সর্ব-বিস্তৃত, ওরা জানে ওদেরকে নিশ্চুপতার জয়মাল্য দিয়ে বরণ করা হবে। অথবা আরো এক ডিগ্রী বাড়িয়ে বরং আমাদেরকেই ৫৭ ধারায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।

এদেশে আদালতে বিচার হয়না সেটা আমরা জেনে গেছি। ইদ্রিসদের জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয় সেটাও জানি। ছোট খাটো ভাড়াটে খুনীদের ধরে এনে প্রেস রিলিজের প্রহসন করা হয়।

দীপনের বাবা ঠিকই বলেছেন, এটা রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক। আমি আরেকটু যোগ করে বলবো এটা বৈশ্বিক এবং জাতীয় রাজনীতি, অর্থনীতির এবং সংস্কৃতির সম্মিলিত যোগ বিয়োগের ফলাফল। মৌলবাদ বলুন, সাম্রাজ্যবাদ বলুন, এদের কারোরই শক্তি কম নয়, আর ওদের সম্মিলিত শক্তির তো কোন তুলনাই নেই আজকের পৃথিবীতে।

আজকে আমাদের দেশে যা ঘটছে তা পূর্বপরিকল্পিত, বহুদিনের চাষের ফসল। আমরা ওদের জায়গা করে দিয়েছি, উর্বর জমিগুলো সব খালি করে দিয়েছি। সার, পানি দিয়ে বড় হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছি। এদের হাত অনেক লম্বা, এদের ব্যাপ্তি অনেক গভীর। শুধু কথায় আর কিছু হবেনা, এদের রুখতে হলে ভিতর থেকে সব কিছু ভেঙেচুরে বদলাতে হবে।

সবকিছু নষ্টদের অধিকারে চলে যাওয়ার আগেই সেটা করতে হবে।

বন্যা আহমেদ, লেখক, ব্লগার; ভিজিটিং রিসার্চ স্কলার, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ