আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

তুমি হেরে যাচ্ছ বারংবার প্রিয়তমা আমার!

সঙ্গীতা ইয়াসমিন  

“কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে বাঁশি সঙ্গীত হারা, 

অমাবস্যার কারা
লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপ্নের তলে....।”

আজ আমাদের বাঁশি সত্যিই সঙ্গীত হারা, স্বপ্ন তলিয়ে গেছে অমাবস্যায়; প্রতিটি ভোর আজ সোনালি প্রত্যূষের অপেক্ষা করেনা। আজ কেবল মৃত্যুপুরীর বজ্রপাতের প্রতীক্ষা সবার! অকস্মাৎ যমদূতের আবির্ভাব হোক এই প্রত্যাশা করে সবাই (?)(!)

লক্ষ্মী পূজাকে ঘিরে ফেনীতে ঘটে যাওয়া নারকীয় ঘটনার সাথে সাথেই আবার চোখ ভেজাতে হল শুদ্ধস্বরের প্রকাশকসহ আরো দুজন ব্লগারকে হত্যা চেষ্টার সংবাদে। ওঁরা লড়ছে মৃত্যুর সাথে এখনো, জানিনা কতটা শঙ্কামুক্ত ওঁরা ! কিন্তু বেঁচে গেলেও কি শঙ্কামুক্ত হবে ওঁরা আমাদের কথিত এই স্বাধীন দেশে? দীপনের মৃত্যুতো সেই কথাই বলে গেল! কী আশ্চর্য দিন! কী অদ্ভুত সুন্দর রক্তঝরা সকাল! যেন এমনই হবার কথা ছিল! প্রতিদিন বাড়ছে লাশের সংখ্যা, মৃত্যুর মিছিলে আরো লম্বা হয়ে উঠছে ছাপ্পান্ন হাজার মাইলের বিস্তৃতি, বাড়ছে এই জঘন্য হত্যালীলার কলঙ্কঋণ !

“যাহারা তোমার বিষায়েছে বায়ু, নিভায়েছে তব আলো
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভাল?’’

ঈশ্বর বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথ প্রবল বিশ্বাস নিয়ে এই প্রশ্ন রেখেছিলেন বিধাতার কাছে, বহুকাল আমিও এমন বিশ্বাসই করতাম। জীবন যুদ্ধের কত দুঃসময়ে একেলা একাকী আমি এই চরণ দুটো নিভৃতে উচ্চারণ করেছি কোন এক অদৃশ্য শক্তির কাছে সাহায্য চেয়ে।

জানিনা তখনও কি ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-কলহের শেকড় সমাজের এত গভীরে প্রোথিত ছিল কিনা। তখনও মানুষের বাক স্বাধীনতার টুটি এইভাবে টিপে দেওয়া হত কিনা জানিনা। তবু কেন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- “প্রতিকার হীন শক্তের অপরাধে, বিচারের বানী নিরবে নিভৃতে কাঁদে..।”

আমদের কত রক্তঋণ জমা পড়ে আছে! অভিজিৎ, বাবু, অনন্ত, নিলয়ের সাথে আজ আবার যোগ হল দীপনের নাম! অথচ আমরা নির্বিকার-প্রতিকার হীন! এই শক্ত অপরাধের বিচার কে করবে আজ ? যে প্রশাসন অন্ধ ক্ষমতার মোহে, ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে আর কিছুই নেই যার কাছে, যে দেশের আইন রক্ষা নয় হয়রানীতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, যে দেশে জন্মিলেই মরিতে হইবে অপঘাতে; সেইখানে কার কাছে করি এই মানবীয় আবেদন! সংবিধান যেখানে গলা টিপে হত্যা করেছে বাক-স্বাধীনতাকে, সেখানে কেনই বা করি এই অরণ্যে রোদন?

বহুকাল আমিও বিশ্বাস করেছি ভগবান নিশ্চয়ই এত বড় অনাচার সইবেন না। কিন্তু আজ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ঈশ্বর বলে ভগবান বলে কেউ ছিলেন না কখনো, নেই এখনো; কোন অস্তিত্ব নেই এই মনগড়া ঈশ্বরের। যদি থাকত তবে এমনটি হতে পারত না। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে, সভ্যতা বিকাশের এই স্বর্ণ সময়ে ধর্মের কাছে জিম্মি হয়ে এইভাবে একের পরে এক নীরবে নির্বিচারে প্রাণ দিচ্ছে আগামীর স্বপ্নবান যুবকেরা, মুক্ত চিন্তকেরা, আর যেভাবে বসন উড়িয়ে উদ্ভট উটের পিঠে চলছে উদাস দেশ-প্রশাসন আর রাজনৈতিকেরা; সত্যই ঈশ্বর বলে কেউ থেকে থাকলে তিনি এই ধরায় নেমে আসতেন। তিনি নিজহাতে এর বিচার করতেন। দুর্গাদেবী ত্রিশূল হাতে নিধন করত অসুর রূপী মোল্লাদের, কিম্বা কৃষ্ণ এসে বর্ধিত নয়া কংস মামাদের !

আমি অতি দুর্বল চিত্তের মানুষ; বড় অসহায় বোধ করি এই দুঃসময়ে । আমার ধর্মবোধ মানবতার ঊর্ধ্বে ওঠেনি কোনদিন। শৈশবে বাবার বন্ধু নিতাই ঘোষ, নারায়ণ চন্দ্র এরাই ছিল আমার প্রাণের কাকু । হঠাৎই এক সকালে শুনতাম নিতাই কাকুরা ভারতে চলে গেছেন। বুকের ভেতরে কেমন ফাঁকা লাগত। যদিও চলে যাওয়ার কারণ জানার কৌতূহল নিবৃত্ত হতে খুব বেশি দেরি হয়নি।

স্কুলের গণ্ডিতে পা রেখে সেই কৈশোরে আমার প্রিয় বন্ধু হল মাধুরীলতা, কৃষ্ণা হালদার; কলেজে নীলিমা, বনানী বিশ্বাস, শিখা আর মিলন মুখুজ্জে । যৌবনে আমার প্রিয় বন্ধু ছিল সবুজ চন্দ; হয়তো বন্ধুর চেয়েও আরও বেশি কিছু হতে পারত চাইলে । এসব সম্পর্কের জালে জড়িয়ে নিজেকে কোনকিছু প্রমাণ করতে চাইনি; এসব হয়ে গিয়েছিল। কারণ, ভেতরের বোধে হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ আর সাম্প্রদায়িকতা দেয়াল তুলে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি কোনদিন। আমি খুব প্রগতিশীল, আধুনিক মানুষও নই; কেবল ভেতরের আমি’র সাথে লড়াই করে বেড়ে ওঠা অতি সাধারণ একজন । আমার জীবনবোধে রঙ ছটানো অকারণ আধুনিকতা যেমন নেই তেমনি সস্তা প্যাকেটে মোড়ানো ধর্মের অন্ধ খোলসও নেই।

আমি আস্তিক কতটা সন্দেহ আছে, আবার নাস্তিক হতে পারি তেমন সাহসও নেই; এই সাহসহীনতা মৃত্যুভয়ে নয়, অজ্ঞতা! জ্ঞান তো শক্তির আঁধার! জেনেছি অসির চেয়ে মসি বড়! কিন্তু আজ দেখছি মসি ভূলুণ্ঠিত, কেঁদে ফিরছে মানবতার দ্বারে, হেরে যাচ্ছে মসি, জিতে যাচ্ছে অসি। নিরব নিথর বাকরূদ্ধ হয়ে পড়ে আছে সব লেখনী, ভেসে যাচ্ছে সব যুক্তি তর্ক রক্তের বন্যায় ।

আজ আমারও রক্ত মিছিলে যেতে ইচ্ছে করছে। আমার অসহায়ত্ব আমাকে সাহসী করে তুলছে ভীষণ! আজ আমি প্রস্তুত দিতে বলিদান! আজ এই মুহূর্তে আমি ঘোষণা দিচ্ছি আমি নাস্তিক! আমার এই স্পর্ধার জন্য আমাকে মেরে ফেলা হোক! তবু আমি দেখবনা এই বীভৎস হত্যার প্রলয়োল্লাস! সুন্দর এই চোখে জীবনের এতো কদর্য রূপ! তবু বন্ধ হোক হত্যার এই মহোৎসব! জীবনের মিছিলে হেরে গিয়েও এই আমি এবার জিতে যাব নিশ্চয়ই। আমি জিতে গেলে আরেকবার জয়োল্লাসে মেতে উঠবে দেশ-প্রশাসন-আর ঘৃণ্য নোংরা ধর্মীয় জঙ্গিবাদ! কিন্তু আরেকবার হেরে যাবে তুমি মা, বারংবার তুমি হেরে যাচ্ছ! আমার প্রিয়তমা জননী, প্রিয় স্বদেশ!

 

সঙ্গীতা ইয়াসমিন, কানাডা প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ