আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

থামাও এ লাশের মিছিল

এমদাদুল হক তুহিন  

প্রগতিশীল মানুষ হত্যায় যোগ হল নতুন মাত্রা। এবার আর ব্লগার নয়, খুন হলেন প্রকাশক।

‘১৩ পরবর্তী সময়ে ব্লগারদের সম্পর্কে এমন একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি সম্ভব হয়েছিল যে, ব্লগার শব্দটি অনেকের কাছেই ‘গালিতে’ রূপান্তর হয়। কিন্তু প্রকাশক! তাহলে বলতে হয়, এবার কি প্রকাশক সম্পর্কেও নেতিবাচক ধারণা তৈরির পথ রচিত হল? প্রকাশক দীপন তার জীবদ্দশায় কোন ব্লগ লেখেন নি। তিনি কোন ব্লগারও নন। তবু অতি সহজ সরল এ মানুষটিকে হত্যা করা হল!

কেবল চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা নয়, হত্যা পরবর্তী সময়ে বাইরে দিয়ে রুমের দরজা আটকে দেওয়ার নতুন একটি ট্রাডিশনও তৈরি হল। আজিজ মার্কেটের ওই দোকানের সব ফুটেজ আছে, আক্রমণকারীদের চেহারাও স্পষ্ট। এখনও গ্রেফতার হয় নি, হবে কিনা এ নিয়েও সন্দেহ আছে। তাই প্রকাশক দীপনের বাবা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘আমি কোন বিচার চাই না।’ শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে কিনা জানি না, তবে মানুষ হত্যার এ ট্রাডিশন যদি এখনই বন্ধ না হয়-কেবল বই পড়ার অপরাধে আক্রান্ত হতে পারেন পাঠকও! নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তখন এ হত্যাযজ্ঞ কোনক্রমেই থামানো সম্ভব হবে না।

প্রচলিত আছে, আগুন ও মানুষ হত্যার রাজনীতি মানুষের আদি বৈশিষ্ট্য। মানবিক গুণাবলি বিকশিত হওয়া শুরুমাত্রই মানুষ পাশবিক বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করে আলোর পথে হাঁটতে থাকে। আলোর পথে হাঁটতে থাকা মানুষগুলোকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে দিতে কিংবা আলোর পথে হাঁটার রাস্তা বন্ধ করে দিতে অন্ধকারের মানুষেরা এমন কোন পন্থা নেই যা অবলম্বন করছে না।

কথায় আছে, অন্ধকারকে ভয় পাওয়া শিশুদের মতো মানুষ মাত্রই মৃত্যুর ভয়ে অচ্ছন্ন। আর ধর্মে মৃত্যু পরের জীবন নিয়ে অনাদিকালের কথা বলা হয়েছে। ফলে স্বভাবজাতভাবেই মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায়। ঐশ্বরিক ঈশারা ও প্রাকৃতিক নিয়মে মৃত্যু আসে, আসবে। অথচ চিরন্তন মৃত্যু ভয়কেই বেছে নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক টাম্পকার্ড হিসাবে!

দু’বছর ধরে চাপাতির কোপে একের পর এক প্রাণ হারাচ্ছেন প্রগতিশীল ও মুক্তচিন্তার মানুষ। সুক্ষ্মভাবে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে একেকটি তরতাজা প্রাণ। বিনষ্ট করা হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ ও অসীম স্বপ্ন। প্রতিবন্ধক হিসাবে নির্মাণ করা হচ্ছে এক অজানা-অচেনা দেয়াল। অথচ অনেকটাই নিশ্চুপ ও নির্বিকার রয়েছে প্রগতিশীল সরকার! হরতাল-অবরোধ ও আগুনের রাজনীতি বন্ধ করতে সরকার সমর্থ হলেও কোন এক অজানা কারণে দীর্ঘ ২ বছরে চাপাতি নিষিদ্ধ করা সম্ভব হয় নি। বন্ধ হয় নি চাপাতির কোপ!

নাস্তিকতার ইস্যু চাপিয়ে শুরু হয়েছিল ব্লগার হত্যা। প্রচারিত হতে থাকে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অপরাধ। অপরাধের জন্যে প্রচলিত আইনে শাস্তির বিধান থাকা সত্বেও বেছে নেওয়া হয় চাপাতি। চাপাতির আঘাতে মুক্তচিন্তার মানুষ খুন হচ্ছে তা নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে যারা কথা বলেছে; আক্রান্ত হচ্ছেন তারাই। তবে এক্ষেত্রে কৌশলে নির্ধারিত হচ্ছে টার্গেট।

সম্প্রতি, লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের প্রকাশকসহ তিনজনের ওপর হামলা দিয়ে শুরু হয় নতুন মিশন। এবার ব্লগার নয়; আক্রান্ত হলেন প্রকাশক, কবি ও লেখক। যখন ঢাকা মেডিকেলে আহতদের নিয়ে যাওয়া হল ঠিক সেসময়েই জানা গেল অপর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জাগৃতির স্বত্বাধিকারি ফয়সাল আরেফিন দীপনের খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে যখন তাঁর দোকানে খোঁজে পাওয়া গেল তখন দীপন আর নেই। না ফেরার দেশে। শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল সহ অপর দুজনকে কুপিয়ে যেভাবে দরজা ও কলাপসিবল গেট আটকে রাখা হয়েছিল, ঠিক একইভাবে দীপনকেও কুপিয়ে হত্যা করে দরজা বন্ধ করে রেখে যাওয়া হয়।

চালু হল নতুন ট্রাডিশন! ব্লগার নয়, আক্রান্ত হচ্ছেন প্রকাশক। ঠিক পরের দিনই হুমকি দেওয়া হল সময় প্রকাশনের প্রকাশক ফরিদ আহমেদকে। প্রকাশকের পর কোন গোষ্ঠী হবেন হয়ত তারও ছক কষার বাকি নেই। একটি মতামত কলামে লিখেছিলাম, ‘কে হচ্ছেন পরবর্তী টার্গেট’ এমন প্রশ্নটি যেন আর আমাদের মনে উদয় না হয়। কিন্তু কি করার! জিজ্ঞাস্যু হৃদয়ে প্রশ্নের উদয় হবে এটাই স্বাভাবিক। বর্তমান পরিস্থিতিতে আজান্তে হলেও সকলের মনেই এমন প্রশ্ন জাগা আর অস্বভাবিক নয়। বরং হয়তো কারো কারো প্রশ্নটি এমন, ‘এটিই কি আমার শেষ লেখা?’ ‘বাসা থেকে বের হচ্ছি, ফিরে আসবো কি?’ হ্যাঁ, ফিরে না আসার ক্ষীণ আশঙ্কা থাকলেও কেউ বসে নেই। থেমে নেই মত প্রকাশ। বরং প্রতিটি ঘটনার পর ক্রমবর্ধমানহারে অনুভূতির প্রকাশ ঘটছে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে।

আর এমনি করে বোকার স্বর্গে বসবাসকারী উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্ররোচনায় ছড়িয়ে পড়ছে অবিশ্বাসের ভাইরাস। অনেকে সরে যাচ্ছেন ধর্মের মূল থেকে। কারো কারো নিজের ধর্মের প্রতি অজান্তে হলেও তৈরি হচ্ছে ঘৃণাবোধ! ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভ পুঞ্জিভূত না থেকে দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। ওই আগুনের দহনে স্বার্থপর গোষ্ঠী সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ না হলেও প্রগতির উর্বর এ ভূমিতে তারা উচ্ছ্বিষ্টে পরিণত হচ্ছে দিনকে দিন। উগ্রপন্থীদের বিষাক্ত মতে ক্ষতিগ্রস্থ সাধারণ মানুষ কোনদিন ক্ষমা করে নি তাদের, করবেও না জানা সত্ত্বেও তৈরি করছেন মতপ্রকাশের কথিত বাঁধা! হাজারো বিপত্তি উপক্ষো করে চিন্তা ও চেতনায় জাগ্রত হচ্ছেন ভবিষ্যতের কান্ডারীরা।

যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে আর প্রতিবাদ নয়, আসতে পারে মহা প্রতিরোধের ডাক। তখন হয়ত উগ্রপন্থীদের পালানোর শেষ রাস্তাও বন্ধ হয়ে যাবে। আগুন সন্ত্রাসীরা থেমেছিল, থামতে বাধ্য হয়েছিল বৈকি। যে বাংলায় ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুঁলতে হয় বাংলা ভাইয়ের, সে বাংলা কোন ক্রমেই দীর্ঘ সময়ে জঙ্গিদের উর্বরভূমি হতে পারে না। বরং ক্রমেই সংকুচিত হয় উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর পা রাখার স্থান, সরে যেতে থাকে পবিত্রভূমি।

দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত ব্লগার হত্যা, বিদেশী নাগরিক হত্যা, শিয়া মসজিদে বোমা হামলা, প্রকাশক হত্যাসহ সাম্প্রতিক সহিংস প্রতিটি কর্মকান্ডই যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার অপকৌশল। ফলে সহজেই বলা যায় কৌশল অবলম্বনে যারা মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তাদের চেহারা সাধারণের কাছে স্পষ্টভাবেই উন্মোচিত। সর্বোপরি এদেশে ধর্মকে ইস্যু করে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে ধ্বংস করার খেলা চলছে।

কোন কারণে সরকার এ খেলা বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে বহু বছরের জন্যে পিছিয়ে যাবে এ দেশ। বৈশ্বিক নানা সূচকে যে উত্থান ঘটেছে তাতে ঘটবে পতন। এমনকি পরাশক্তিগুলো ত্রিশ লক্ষ শহীদের মাটিতে শাসন কায়েমের নেশায় উদগ্রিব হয়ে উঠবে বলেও ধারণা অনেকের। তাই এখনই সময়, থামাও এ লাশের মিছিল।

এমদাদুল হক তুহিন, ব্লগার, কবি ও সংবাদকর্মী। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ