প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ১৯ নভেম্বর, ২০১৫
১০-১৫টা যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রক্রিয়াটি ছিলো আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার একটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। এই ন্যায় বিচার জনগণের প্রাধিকার; কিন্তু সেটিকে আওয়ামী লীগ "লিখে রেখো এক ফোটা দিলেম শিশির" সংগীতে পরিণত করে জনগণকে কৃতজ্ঞ করে রাখার চেষ্টা করে চলেছে।
যুদ্ধাপরাধীগুলো যতদিন বেঁচে আছে; ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিচারিক দীর্ঘসূত্রিতায় আওয়ামী লীগ সেসময়টা ক্ষমতায় থাকবে। অবশ্য ক্ষমতার অংশীদারিত্বে থাকবে রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী বেয়াই সমাজ। অন্যধর্মের মানুষের ওপর নির্যাতন-ভূমি থেকে উচ্ছেদ চলবে। জামাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চেক গ্রহণ চলবে।
গণমাধ্যমগুলোকে এক অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে সেলফ সেন্সরশীপ আরোপে বাধ্য করে দুর্নীতি ও দলীয় মাস্তানীর খবর প্রকাশ ও প্রচার হতে দেয়া হচ্ছে না। সেই মুহূর্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটিই হয়ে উঠেছিলো স্বৈরাচারী এরশাদের সাধন সঙ্গী স্বৈরাচারী আওয়ামী অপশাসনের সবচেয়ে বড় মাথা ব্যথা। থলের কালো বেড়ালগুলো বার বার বেরিয়ে যাচ্ছিলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ শ্লোগানের সঙ্গে প্রতারণা করে আওয়ামী লীগ ফিরে যেতে চায় একদলীয় এনালগ পাকশালীয় শাসন ব্যবস্থায়; যেখানে ধর্মের হেফাজতের নামে লালসালুর মাজার গড়ে মজিদেরা পাকিস্তানের কায়দায় ধর্ম নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাবে। দলীয় ক্যাডার-প্রশাসন-পুলিশ তাদের লুন্ঠন চালিয়ে যাবে ঔপনিবেশিক কায়দায়।
নিরাপত্তার অজুহাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এরা বন্ধ রাখবে যেন গণজাগরণের মতো কোন নবজাগরণ না ঘটে; আওয়ামী লীগের উতপাদিত মিথ্যাশ্রিত সত্যই ধ্রুব সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এস এস সি, এইচ এস সি, উচ্চশিক্ষায় ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে যাতে টুঁ শব্দটি না হয়, বিসিএস-এর মাধ্যমে রাজকর্মচারী হিসেবে প্রবেশ করানো যায় দলীয় কর্মী ও আত্মীয় স্বজন।
কাল্পনিক উন্নয়নের পরিসংখ্যানে জনগণকে বিভ্রান্ত করে আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চাওয়ার যে উদগ্র কামনা-বাসনা তা চরিতার্থ করতে গেলে লুকিং ফর শত্রুজ বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ রাখা ছাড়া আর যে কোন পথ খোলা নেই ঔপনিবেশিক পাকিস্তান মডেলের এই ধূর্ত শাসক -শোষক ও নিপীড়ক গোষ্ঠীর।
মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইবুনাল ও উচ্চতর আদালতের বিচারিক গতি খুবই মন্থর। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় এতো দীর্ঘসময় লাগা বাস্তবসম্মত নয়। একবার ট্রাইবুনালের রায়ে বিরিয়ানী খাওয়া-আরেকবার উচ্চতর আদালতের রায়ে বিরিয়ানী খাওয়া-আরেকবার রিভিউ ফলাফলের পর বিরিয়ানী খাওয়া; এতে আমাদের রীতিমত কোলেস্টেরল হাই হয়ে গেলো; কিন্তু বিচার শেষ হলোনা। বুশ যেমন ওয়ার অন টেররের কথা বলে বলে ক্ষমতায় ছিলো, ওবামা যেমন লাদেনের হত্যা উপহার দিয়ে দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জিতেছিলো; এই কয়টি যুদ্ধাপরাধী কুমীর দেখিয়ে দেখিয়ে তেমনি আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছে। অথচ অধরা রয়ে গেছে বেয়াই যুদ্ধাপরাধী নুলা মুসা, মন্ত্রী হয়ে বসে আছে রাজাকারের ছেলে, যার হাতে মুক্তিযোদ্ধারা নিঃগৃহীত হয়েছে বেয়াইপুরে। সুতরাং যেসব পরস্পর বিরোধী খেলাধুলা লক্ষ্য করা গেছে তাতে স্বাভাবিক বুদ্ধাংকের যেকোন মানুষের বোঝা উচিত এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের দীর্ঘস্থায়ী খেলাটি কত অতীন্দ্রিয় পিং পং খেলা।
প্রসিকিউটর নিযুক্তিতে সরকার পক্ষ ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালসহ পৃথিবীর প্রায় সব মানবতাবিরোধী অপরাধ সম্পর্কে জ্ঞাত উপদেশকদের পরামর্শ প্রথমটায় শোনেনি। পরে যখন সে পরামর্শ সামান্য শোনা হয়েছে; তখনই বিচারটি দ্রুতি পেয়েছে। তথ্য-উপাত্ত-প্রমাণাদি-সাক্ষী-সাবুদ জোগাড় করে দেয়া হয়েছিলো দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে। দুর্বলতা ছিলো প্রসিকিউটরদের পেশাদারিতায়।
সরকারের এই দীর্ঘ প্রত্যাশিত ন্যায়বিচারের অধিকার নিশ্চিত করার কাজটি প্রশংসনীয়। সে প্রশংসার ঔদার্য্য আমরা দেখিয়েছি। কিন্তু সচেতন মানুষ হিসেবে যে কোন স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত ও মনোভাবের প্রতিবাদ করাই কর্তব্য মনে করি। বিএনপি-জামাতকে সচেতন সমাজ আগেই প্রত্যাখান করেছে। তার মানে এই নয় যে সব বিষয়ে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে হবে আওয়ামী লীগের কাছে।
কারা সন্ত্রাসী? উত্তর জামাত ও তার সশস্ত্র উইংগুলো। এরা নামাজের অজুহাতে মসজিদে মিলিত হয় গ্রুপ কম্যুনিকেশানে; ম্যাসকম্যুনিকেশানে ব্যবহৃত হয় ওয়াজ মেহেফিল; আর জামাতের প্রতিটি সদস্যই একটি মিডিয়া। এরা মাসোহরা পায় জামাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মুনাফার অর্থ থেকে। এদের সন্ত্রাসী চক্র পৃথিবীর অন্য জায়গার অপরাধীদের মতই টর বা প্রক্সি ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসে। কাজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করলে সন্ত্রাস কমবে এই অজুহাতটি বাস্তবসম্মত নয়। এটি সরকারের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি লুকানোর অজুহাত এবং জনমানুষের কন্ঠস্বর কেড়ে নেবার অপচেষ্টা বলে মনে হয়।
দেশের একজন মন্ত্রী যখন বলেন, ইসলামী ব্যাংক আমার ভাগ্য বদলে দিয়েছে; তখন তিনি জামাতের ব্র্যান্ড এমব্যাস্যাডর হয়ে যান অজান্তেই। আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা যখন মুসাবা করে হাসিমুখে জামাত সদস্যদের আওয়ামী লীগে প্রবেশ করান; তখন দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা গিয়ে জামিনে মুক্ত করে নিয়ে আসে আটক জামাতঘন সন্ত্রাসীদের। জামাতের প্রক্সি গ্রুপ হেফাজতে শফি হুজুরের মাদ্রাসাকে যখন সরকার রেলের জমি উপহার দেয় তখন তারা অনুপ্রাণিত বোধ করে। জামাত কীরকম কালসাপ তা আমরা ১৯৭১ সালে দেখেছি; ১৯৭৫ সাল থেকে আজ অবধি দেখছি।
সাকা-মুজাহিদ গতকাল জন্মায়নি; ১৯৭১ থেকে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তারা দানব। এই বাস্তবতায় ৭টি বছর ক্ষমতায় থেকেও কেনো মিশর-পাকিস্তানের মত ধর্মভীরু দেশে যেমন তল্লাশী চালিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়া গেলো; সেখানে জামাত-মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দেয়া সম্ভব হলো; সেটা পারলো না ব্রুট মেজরিটির আওয়ামী লীগ সরকার; এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সন্ত্রাসবাদের সূতিকাগার এবং অভয়ারণ্য বাঁচিয়ে রেখে "ফেসবুক" বন্ধ করে সন্ত্রাসদমন খুবই জাদুবাস্তব। সত্য একটিই হয়। হয় দেশে জঙ্গীবাদ আছে বা নেই; এই দুই অনুসিদ্ধান্তে পেন্ডুলামের মত দুলতে দেখা গেছে সরকারকে।
আওয়ামী লীগের দূরদর্শী নেতা সৈয়দ আশরাফ ২০০৯ সালেই বলেছিলেন, শিবিরের ছেলেরা ছাত্রলীগে ঢুকেছে; উনার এই সত্যভাষণকে অনুসরণ করে ছাত্রলীগকে শিবিরের গুপ্তচর মুক্ত করা যায়নি। উত্থাপিত যুক্তিতর্কে এটাই প্রমাণিত হয়, সরকার হলো সেই বৃদ্ধা যার কেবল বর্ষাকাল এলেই ঘরের চাল সারানোর ইচ্ছা জাগে। যেহেতু চাল সারানো হয়না; তাই বালতি নিয়ে ছোটাছুটি করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করাটা বালতি নিয়ে ছোটাছুটি করা; চাল সারানো নয়। এরপরেও কেউ যদি বলে আর কটা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি; সেটাতে আশ্বস্ত হতে গেলে আমাকে অবশ্যই মোরণ বা নিম্নবুদ্ধাংকের লোক হতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা যে নরভোজী গোষ্ঠীটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের পর তাদের স্বভাবসুলভ গুজব প্রচার করে; তারা পরাজিত হয়েছে মানবতা বিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে উচ্চকিত তারুণ্যের ক্রমাগত সত্য অন্বেষণ ও উচ্চারণে।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিলো না বলেই ষড়যন্ত্রকারীদের মুখে মুখে প্রচারিত গুজবগুলো শ্রোতা পেয়েছিলো; কিন্তু সত্য তুলে ধরার সুযোগ পায়নি সচেতন জনগোষ্ঠী এরকম কোন যোগাযোগ মাধ্যমের অভাবে। ফলে বাংলাদেশ হারিয়েছে তার জন্মদাতা পিতাকে। সরকারী গণমাধ্যমের মাইক্রোফোন দখল করে খুনীরা দম্ভের সঙ্গে উচ্চারণ করেছে তাদের অপকর্মের কথা।
তাই সরকারের বোঝা জরুরী, সচেতন সমাজকে সক্রিয় সামাজিক যোগাযোগের মাঝে রাখলে; ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীর মুখে মুখে প্রচারিত কোন গুজব আর হালে পানি পাবে না।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য