প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
এমদাদুল হক তুহিন | ০১ ডিসেম্বর, ২০১৫
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আমাদের কাছে পবিত্রতম স্থান। পবিত্রতম এ স্থানটির সঙ্গে বাঙালি হৃদয়ের আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জড়িয়ে আছে গভীরভাবে। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে রক্ত দেওয়া সালাম-বরকতের অতৃপ্ত আত্মারা এখনও হয়ত স্থানটির আশেপাশেই ঘুরে বেড়ায়। জুতা পায়ে শহীদ মিনারের পাদদেশে ঘুরে বেড়ানো দেখে ভাষা শহীদেরা হয়ত লজ্জায় কেঁদে মরে!
কপোত-কপোতীর আড্ডা এখানে প্রতিনিয়ত। চলে নেঁচে গেয়ে বন্ধুদের ফটোশুট। বেশবুশায় প্রতিটি মানুষ অতি আধুনিক। শিক্ষিত ও মার্জিত। অথচ শহীদ মিনারের পাদদেশে উঠার সময়ও সবার পায়ে জুতা! নিত্যদিনকার এমন ঘটনায় প্রতিনিয়তই বিনষ্ট হচ্ছে তীর্থ এ স্থানটির পবিত্রতা। সভ্যতার শিখরে ওঠে যাওয়া ১৫’র বাংলাদেশে এর চেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা আর কিছুই হতে পারে না।
প্রতিদিনকার মতো লজ্জাজনক এমন একটি ঘটনা ঘটেছে রবিবার (২৯ নভেম্বর)। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে চলছে ‘নারী নির্যাতন বিরোধী পুরুষ সংহতি সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’। নারীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখছেন সমাজের নানা শ্রেণী-পেশার পুরুষ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের ডিরেক্টর অ্যাড. মাকছুদা আখতার। তিনি বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারকে বক্তব্য রাখার অনুরোধ করলেন। বক্তব্যের শুরুতেই শহীদ মিনারের পাদদেশে জুতা পায়ে হাঁটাহাঁটি করা একদল তরুণ-তরুণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। তাদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘দয়া করে শহীদ মিনারের পাদদেশ থেকে নেমে আসুন। ওখানে জুতা পায়ে হাঁটাহাঁটি করবেন না। আমরা ওখানে এভাবে যায় না। হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে। দয়া করে প্লিজ নেমে আসুন, আমাদের শহীদদের অপমান করবেন না!’
কিন্তু দূর্ভাগ্য কে শোনে কার কথা! ঘুরতে আসা ১০ থেকে ১৫ জনের ওই দলটি প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারের কথায়ও বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করে নি। বরং ওই দলের সঙ্গে থাকা এক তরুণী ফটোশুটে ব্যস্ত হয়ে ঠিক যেন লাফাচ্ছিলেন! অনেকটা পাখির মতো উড়ছিলেন। স্টেজে বসে থাকা একজন আপু বিরক্ত হয়ে মেয়েটি সম্পর্কে বাজে মন্তব্যও করলেন। অনুষ্ঠানস্থলে থাকা প্রতিটি মানুষ লজ্জাজনক ওই আচরণে বিব্রত বোধ ও অপমানিত হলেও তাদের আচরণে বিন্দুমাত্র তারতম্য ঘটেনি। ছবি ধারণ ও তাদের সে কী হাসি। উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত ওই হাসিতে অপমানিত হচ্ছিল পবিত্র শহীদ মিনার। অপমানিত হচ্ছিল অনুষ্ঠানস্থলের প্রতিটি মানুষ। শুধু ওরাই নয়, পাদদেশে ছিল আরও বেশ কিছু কপোত-কপোতী। তবে তরুণ ওই দলের আচরণ ছিল বেশ বিব্রতকর।
মহিলা পরিষদের ওই অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিল ছিলেন একাধিক গণমাধ্যম কর্মী, ছিলাম আমিও। বিবেকের দায় থেকে শহীদ মিনারের পাদদেশের দিকে এগিয়ে যাই। সঙ্গে জনকন্ঠের ফটোগ্রাফার জীবন ঘোষ ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক মিশু ভাই। দু’জনকে বললাম, ছবি তুলে নিন। তারা ছবি তুললেন।
ওদের একজন জিজ্ঞেস করলো, ছবি তোলে কি করবেন? হয়ত আমি উত্তরটা এভাবে দিয়েছিলাম, আপনাদের মতো অতি আধুনিক মানুষ এভাবে শহীদ মিনারকে অপমান করছেন! কথা বলার এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে তরুণদের ওই দল। পরিচয় জানতে চাইলো আমার। এমনকি আইডেনটিটি শো করার জন্যে অনেকটা আদেশ করতে থাকলো! চার-পাঁচ জনের দল ঘিরে ধরলো চারদিক থেকে। আমি একা কথা বললেও ওরা একসঙ্গে পাঁচ-ছয় জন আপত্তিকর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে থাকলো। আমার পকেটে আইডি কার্ড আছে। কিন্তু কয়েকজন অপরাধীর কাছে আমাকে আমার নিজের পরিচয় প্রদর্শন করতে হবে, এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে! আইডি কার্ড বের না করে শেষতক আমার নাম বলতে বাধ্য হলাম।
ওদিকে ফটোগ্রাফার জীবন ঘোষ ভাই বলতে থাকেন, তিনি আমাদের জনকন্ঠের রিপোর্টার। কিন্তু এরপরও তারা ক্ষান্ত হয় নি। বলতে শুরু করলো অপনাকে আচরণ সংযত করতে হবে। সঙ্গে আসা ফটোগ্রাফার মিশু ভাইকে আশেপাশে খোঁজে পাওয়া গেল না। শহীদ মিনারে দায়িত্ব পালন করা একজন অপরিচিত সাংবাদিক এগিয়ে আসলেন। ওরা হাত নাড়াচড়া করছে, তিনি বাঁধা দিতে চাইলেন। কিন্তু তার ওপরও অনেকটা চড়াও হল তারা। বাধ্য হয়ে তিনি সরে গেলেন।
এবার ওরা আরও ক্ষিপ্ত! আমাকে 'সরি' বলতে হবে। সরি বলানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চলতে থাকলো। বলতে শুরু করলো, একজন সুপ্রিম কোর্টের ল'য়ারে সঙ্গে কিভাবে আচরণ করতে হয় তা শিখতে হবে। ওদের ভাষায়, ‘আপনি জানেন, এখানে ২-৩ জন সুপ্রিম কোর্টের ল'য়ার রয়েছে। আপনি আমাদের আইন শেখাচ্ছেন। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এটা পাদদেশ নয়।’ কিন্তু এতোক্ষণে তারা পাদদেশ থেকে নেমে গেছে। অপর একজন বলতে শুরু করলো, আপনিও তো পাদদেশে দাড়িয়ে আছেন। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। অনেকটা বোকা বনে গেলাম। অনেকটা অপমানিত হলাম। পাদদেশে ছিল তারা! রামেন্দু মজুমদারের মতো আমিও তাদের শুধু স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। এতেই তাদের ওই ক্ষিপ্ততা! তবু প্রশ্ন থেকে যায়, সুপ্রিম কোর্টের ল'য়ারদের জন্যে কি কোন আইন নেই!
শুধু সুপ্রিম কোর্টের ল'য়ার পরিচয় দিয়েই তারা থেমে যায় নি। পরিচয় দিতে থাকলে ঢাবির, ঢাবির এক নেতার। সুপ্রিম কোর্টের নেতার। তবে তাদের পরিচয় অস্পষ্ট। কেননা তাদের পরিচয় জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না আমার। পরবর্তীতে জানা গেল, এর শিক্ষানবীশ আইনজীবি হিসাবে আইনজ্ঞের অধীনে কাজ করছে। আইনের নিয়ম কানুন জানতে থাকা এসব শিক্ষার্থী যদি শহীদ মিনারকে এভাবে অপমান করতে থাকে তাহলে সমাজের আট-দশটা মানুষের অবস্থা নিয়ে ভাবতে সত্যি কষ্ট হচ্ছে! প্রশ্ন থাকে ওদের পরিচয় যদি সত্য হয়ে থাকে তবে ঢাবির শিক্ষার্থী ও সুপ্রিম কোর্টের ল'য়ারদের জন্যে কী আলাদা আইন? শহীদ মিনারের পাদদেশে জুতা পায়ে তাদের ঘুরাফেরা কি বৈধ? রামেন্দু মজুদমদার কেন তাদের পাদদেশ থেকে নেমে আসার অনুরোধ করেছিলেন?
হ্যাঁ, গতকালের ঘটনার পর থেকে মনে হচ্ছে, একজন সংবাদকর্মী হিসাবে প্রথমবারের মতো কিঞ্চিত অপমানিত হয়েছি! অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে অপমানিত হওয়া লজ্জার না সম্মানের তা আমার জানা নেই। কী ছিল আমার অপরাধ সে আমার জানা নেই। শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে শহীদদের অপমানের কথা তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া ও বিবেকেরে দায় থেকে ফটোগ্রাফারদের ছবি তুলতে বলাই হয়ত ছিল বড় ধরণের কোন অপরাধ! কী জানি-সে তো অপরাধ নয়।
শুধু ওই তরুণ-তরুণীর দল নয়, প্রতিদিনই জুতা পায়ে অসংখ্য সাধারণ মানুষ শহীদ মিনারের পাদদেশে চলাফেরা করছে। নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কেউ মানছে না ওই নির্দেশনা। প্রশ্ন থেকে যায় কী করে বিষয়টি নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের চোখ এড়িয়ে যায়?
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য