আজ থেকে ২৩ বছর আগে ১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'। মূল দাবি ছিল '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াত-শিবির চক্রের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। গঠনকালে নির্মূল কমিটি ঘোষণা দিয়েছিল_'আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারীবৃন্দ এই মর্মে ঘোষণা করছি, বেআইনিভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে যদি অবিলম্বে দেশ থেকে বহিষ্কার করা না হয়, তাহলে আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ২১তম বার্ষিকীর দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশিষ্ট নাগরিক ও আইনজ্ঞ সমন্বয়ে গঠিত প্রকাশ্য গণআদালতে গোলাম আযমের বিচার হবে...। একই সঙ্গে আমরা দাবি জানাচ্ছি, একাত্তরের ঘাতকদের দল জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্ম ব্যবসায়ীদের সব রাজনৈতিক দল অবিলম্বে নিষিদ্ধ করতে হবে...। ঘাতকদের নির্মূল করার লক্ষ্যে আমরা শুরু করতে যাচ্ছি মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়।'
দেশবাসীর ধারণা জন্মেছিল, 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'র আন্দোলন শুধু ওই বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকবে। ২৩ বছর পার করে এসে আজ সবার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। পাল্টানোর কারণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার পক্ষে নির্মূল কমিটির জনকল্যাণমুখী বিবিধ কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ।
২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত সমগ্র দেশজুড়ে চালায় এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। এর প্রথম শিকার ছিলেন রাজশাহীর বৃদ্ধ শিক্ষক দশরথ কবিরাজ। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আশা-ভরসা দেন ও সাহায্য করেন। জোট সরকার তাদের শাসনামলের পুরো সময়টাই এ ধরনের নির্যাতন চালিয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ের রাধা রানীকে গণধর্ষণ করে দু'চোখ উপড়ে তুলে ফেলেছে। বাতাসী বেওয়ার ছেলেকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। কেন্দ্রের নেতা-সদস্যরা অতিদ্রুত তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। বিএনপি সন্ত্রাসীদের অন্যতম শিকার গণধর্ষিত কিশোরী পূর্ণিমা। তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি ঢাকায় নিজের বাসায় তার আহত মা-সহ এনে রাখেন। দীর্ঘদিন সেবা-শুশ্রূষা ও চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করেন। পরে পূর্ণিমাকে বিএ পর্যন্ত পড়িয়ে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় নির্মূল কমিটি থেকে।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য খালেদা জিয়ার সরকার শাহরিয়ার কবির ও মুনতাসীর মামুনকে জেলে প্রেরণ করে। তাদের ওপর অনেক নির্যাতন হয় এবং মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। পূর্ণিমাকে সাহায্য করার জন্য উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
ডিসেম্বর ২০০৮-এর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি যাতে জয়লাভ করে সে জন্য ফেব্রুয়ারি মাস থেকে নির্মূল কমিটির নেতাকর্মীরা রাজধানী ঢাকাসহ প্রধান প্রধান বিভাগীয় শহর, জেলা, উপজেলা ও থানা পর্যায়ে সমাবেশ, আলোচনা সভা, মানববন্ধন ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং প্রতিপক্ষের বিভিন্ন মিথ্যা প্রচারণাকে ভণ্ডুল করে দিয়েছেন। অপপ্রচারের যথাযথ ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তাতে করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অঙ্গীকারবদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।
২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকালে জামায়াত-বিএনপির মূল লক্ষ্যই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়কে অত্যাচার করে দেশ থেকে তাড়ানো। অভয়নগরে ১২২টি বাড়ি ওরা পুড়িয়েছে। যশোরের মালোপাড়া, ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলা, দিনাজপুরের করনাই গ্রাম, যশোরের মনিরামপুরের ঋষিপল্লী, গাইবান্ধার বেড়াডাঙ্গা এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুরের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ঘরবাড়ি-দোকানে অগি্নসংযোগসহ লুট, ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতন করেছে, যা ১৯৭১-এর অত্যাচারকেও ছাড়িয়ে গেছে। এসব স্থানে নির্মূল কমিটির নেতাকর্মীরা নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে সাহায্য সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন, তাদের যন্ত্রণা ও ভোগান্তির তথ্য লিপিবদ্ধ করে এনেছেন। এসব নিয়ে শ্বেতপত্রও প্রকাশ করা হয়েছে।
নির্মূল কমিটির সদস্য তারাই যাদের দায়বদ্ধতা কোনো ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়। আমাদের লক্ষ্য একটাই ১৯৭১-এ যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি তারই শতভাগ বাস্তবায়ন। পরাজিত শত্রু ও তাদের পদলেহীরা দেশটাকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বানাবে, মুক্তিযুদ্ধে সব অর্জন ভূলুণ্ঠিত করবে, তা আমরা হতে দেব না বলেই নির্মূল কমিটি করেছি। যতদিন পর্যন্ত না সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করবে এবং এ ভূখণ্ড থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের সব দল ও মতের সর্বাংশে অবলুপ্তি ঘটবে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের যাত্রা অব্যাহত থাকবে। শহীদজননী জাহানারা ইমাম আমাদের ওপর এ পবিত্র দায়িত্ব অর্পণ করে গেছেন। আমরা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে জীবনপণ লড়াই করে যাব 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'র ২৪তম প্রতিষ্ঠা দিবসে শহীদজননীর কাছে এ আমাদের ইস্পাতদৃঢ় অঙ্গীকার।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য