আজ তিন বানরের কথা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। এই তিন বানরের ছবি এবং তার নেপথ্য কথা প্রায়ই পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে দেখা যায়। সুতরাং সে কাহিনীতে আর যাব না। তবে এই তিন বানরের ছবির কথা আমার পাঠকদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। তিনটি পাশাপাশি বসা বানর। একটি ঠোঁটে আঙুল চাপা দিয়ে রয়েছে। অর্থাৎ সে কথা বলবে না। দ্বিতীয়টি কানে আঙুল ঢুকিয়ে বসে আছে। সে কোনো কথা শুনবে না। তৃতীয়টি হাতের তালুতে চোখ ঢেকে বসে আছে। অর্থাৎ সে কোনো কিছুই দেখবে না।
এই তিন বানরের ছবি দিয়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজের পণ্ডিতকুল ও বুদ্ধিজীবীদের ঠাট্টা করে লন্ডনের একটি দৈনিকে একটি কার্টুন ছাপা হয়েছিল। বহুল আলোচিত কার্টুন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে ইউরোপে- বিশেষ করে জার্মানি, ইতালি ও স্পেনে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সেও ছড়িয়ে পড়ে তার সর্বনাশা প্রভাব। কিন্তু পণ্ডিতকুল ও বুদ্ধিজীবীদের বেশির ভাগই তখন এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অসচেতন।
এই বুদ্ধিজীবীরা তখন নাৎসিবাদের অভ্যুত্থানের দিকে তিন বানরের মতো চোখ-কান-মুখ বন্ধ রেখে 'কমিউনিজম গণতন্ত্র ধ্বংস করার জন্য ছুটে আসছে'- এই প্রচারণা চালাতে বিভোর। তাদের একটিমাত্র স্লোগান 'Dead is better than Red.' (লাল বা কমিউনিস্ট হওয়ার চেয়ে মৃত্যু ভালো)। জানা যায়, ফ্রান্সে এই বুদ্ধিজীবী-ককাসের নেতা ছিলেন রিবেনট্রপ (তখনকার একজন ফরাসি প্রধানমন্ত্রী রিবেনট্রপ নন)। জার্মান আগ্রাসনের মুখে ফ্রান্সের পরাজয় এবং নাৎসিদের কোলাবরেটর ভিসি সরকার প্যারিসে ক্ষমতায় বসার পর এই রিবেনট্রপ ও তাঁর সহমতের বুদ্ধিজীবীদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
অতিবুদ্ধিমান বুদ্ধিজীবীদের এ অবস্থা ইউরোপের বহু দেশে হয়েছে। বানর-সংক্রান্ত একজন বিশেষজ্ঞ ফব্স্ সাহেবের মতে, জীবজগতে মনুষ্য সমাজের বাইরে বানর হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। মানুষকে বাদ দিলে এই প্রাণিজগতের বুদ্ধিজীবী হচ্ছে বানর। কিন্তু তাদের মধ্যে একটা অংশকে দেখা যায় অতিচালাকির জন্য সব সময় ধ্বংস হতে। এর একটি উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, আমেরিকার বনাঞ্চলে সময় সময় যে অগ্নিঝড় শুরু হয় এবং মাসের পর মাস ধরে চলে, তার বিবরণ থেকে। এই অগ্নিঝড় শুরু হওয়ার প্রাক্কালে প্রাণিকুল তা টের পায় এবং নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য তৎপর হয়।
এই প্রলয়ংকর আগুন যখন একটার পর একটা জঙ্গল গ্রাস করতে থাকে তখন বেশির ভাগ পশু-পাখিকেই দেখা যায় নিজেদের বাঁচানোর চেয়েও সন্তান-সন্ততিকে বাঁচানোর জন্য উদগ্রীব। সিংহকে পর্যন্ত দেখা গেছে সিংহীকে পিঠে তুলে বাচ্চাগুলোকে দাঁতে কামড়ে ঝুলিয়ে অগ্নিবলয় থেকে পালাচ্ছে। একমাত্র এক শ্রেণির বানরকেই দেখা যায়, তারা শুধু নিজেদের বাঁচাতেই ব্যস্ত। বহু উঁচু গাছের মগডালে উঠে গিয়ে (এ জন্যই তাদের আরেক নাম শাখামৃগ) তারা ভাবে আগুনের গ্রাস থেকে বাঁচবে। তারা বাঁচে না। আগুনের লেলিহান শিখা বহু ঊর্ধ্বে উঠে বানরসহ গাছের মগডালকেও ভস্মীভূত করে।
বাংলাদেশের ভালোমন্দ সব বুদ্ধিজীবীর কাছে ক্ষমা চেয়ে এই কথাটা লিখছি যে স্বাধীনতার পর আমাদের দেশেও একটি নব্য বুদ্ধিজীবী শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছে এবং তাদের মধ্যে একটি সুধীসমাজ মাথা উঁচু করেছে, যাদের ভূমিকা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালের অঙ্ফোর্ড ও ক্যামব্রিজের এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীর মতো। যাঁরা নাৎসিবাদের মতো ভয়ংকর মানবতাবিরোধী শক্তির অভ্যুত্থানের দিকে চোখ-কান মুদে রেখে কমিউনিজমের কবলে গণতন্ত্রের মৃত্যু আশঙ্কায় শোরগোল তুলে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করেছিলেন এবং ইউরোপ ও গণতন্ত্রকে নাৎসিবাদের পদানত হতে সাহায্য জুগিয়েছিলেন। ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীরা এখন এই ভ্রান্তি এবং সেদিন তাঁদের শাখামৃগসুলভ ভূমিকার কথা স্বীকার করেন।
বর্তমান বাংলাদেশে যে নব্য বুদ্ধিজীবী শ্রেণি গড়ে উঠেছে, তাদের মধ্য থেকে একটি সুবিধাভোগী এলিট ক্লাস বা সুধীসমাজও তৈরি হয়েছে। কিন্তু তাদের একটা অংশের কার্যকলাপ দেখলে তিন বানরের ছবির কথা যে আমার মনে পড়ে, এ কথা অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গে হলেও স্বীকার করব। দেশে বিরোধীদলীয় রাজনীতির নামে চলছে নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারার সন্ত্রাস। দেশময় চলছে হিংস্র মৌলবাদের অভ্যুত্থানের আস্ফালন। সিরিয়া-ইরাকের ভয়ংকর আইসিস-সন্ত্রাসের সঙ্গে তার সংযুক্তি ঘটার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই নিবন্ধ লেখার সময়েও খবর পেয়েছি আইসিসের সঙ্গে যুক্ত চারজন সন্ত্রাসীকে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
দেশের এই ভয়ংকর বিপদের সময় আমাদের সুধীসমাজ সম্পূর্ণ নীরব। তারা ঠোঁটে হাত, কানে আঙুল এবং চোখ ঢাকা অবস্থায় বসে আছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালের অঙ্ফোর্ড ও ক্যামব্রিজের বুদ্ধিজীবীদের মতো তাদের মুখে একটাই রব, হাসিনা সরকারের কার্যকলাপে দেশে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়েছে। গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য মৌলবাদ ও সন্ত্রাসের সমর্থক দলগুলোর সঙ্গে সরকারকে অবিলম্বে আলোচনায় বসতে হবে। আলোচনার অর্থ, ওই দলগুলোর অবাস্তব ও অগণতান্ত্রিক দাবির সঙ্গে আপস করা- অর্থাৎ সন্ত্রাসের কাছে আত্মসমর্পণ করা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজের এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী স্লোগান তুলেছিলেন, 'ডেড ইজ বেটার দ্যান রেড।' আর আমাদের সুধীসমাজ হয়তো ভাবে, হাসিনা সরকারের কানা-খোঁড়া গণতন্ত্রের চেয়ে বিএনপি-জামায়াতের অর্ধতালেবান, ফ্যাসিবাদী শাসন উত্তম।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে সন্ত্রাস চলছে, সরকার অবিলম্বে তা যদি কঠোর হাতে দমন না করে এবং একটি সুধীসমাজের পরামর্শে আপস, আলোচনা ও সন্ত্রাসীদের প্রতি এপিজমেন্টের নীতি গ্রহণ করে, তার পরিণতি হবে গণতান্ত্রিক সরকারের পরাজয় এবং সন্ত্রাসী ইসলামিক স্টেট (আইসিস) আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশে ভয়ংকর মৌলবাদী উত্থান; যে উত্থান মার্কিন মেরিন সেনা, ড্রোন হামলা ডেকে এনেও দমন করা যাবে না।
এই ভয়ংকর আশঙ্কার দিকে চোখ মুদে রেখে দেশের একটি সুধীসমাজ কিভাবে হাসিনা সরকারের দ্বারা গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার ধুয়া তুলে জনগণকে তাদের আসল বিপদ সম্পর্কে বিভ্রান্ত ও অসতর্ক করে রাখতে পারে, তা ভেবে বিস্মিত হতে হয়। হাসিনা সরকারকে আজ না হয় কাল একটি সাধারণ নির্বাচনের সম্মুখীন হতেই হবে। জনগণ না চাইলে তাদের ক্ষমতা থেকেও বিদায় নিতে হবে। কিন্তু মধ্যযুগীয় হিংস্র মৌলবাদ যদি গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে একবার ক্ষমতা দখল করতে পারে, তাহলে একটি দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সফল হওয়া ছাড়া তাদের কবল থেকে জনগণ কি আর মুক্ত হতে পারবে? আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া কোথাও তারা মুক্ত হয়েছে? মাঝখান থেকে একদিকে চলছে মার্কিন ড্রোন হামলা, অন্যদিকে জিহাদিস্টদের বর্বরতা। আমাদের সুধীসমাজ কি এই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায় বাংলাদেশে?
বিএনপি ও জামায়াতের সন্ত্রাসের তীব্র প্রতিবাদ জানানোর বদলে সুধীসমাজের মুখপত্র একটি ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন সন্ত্রাসের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে ভবিষ্যতের নির্বাচনের রূপরেখা নিয়ে আলোচনায় বসার জন্য। যেন আলোচনায় বসলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সন্ত্রাস থেমে যাবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে একই পরামর্শ দিয়েছিল ব্রিটেনের একটি সুধীসমাজ তাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেনকে।
হিটলারের তখন আগ্রাসী চেহারা। অস্ট্রিয়া দখল করে বসে আছেন। তা উপেক্ষা করে সুধীসমাজ পরামর্শ দিল চেম্বারলেন জার্মানিতে গিয়ে মিউনিখে হিটলারের সঙ্গে আলোচনা-বৈঠকে বসলেই হিটলারের আগ্রাসন বন্ধ হয়ে যাবে। চেম্বারলেন মিউনিখে গেলেন। শান্তিচুক্তি হলো, তার কিছুদিনের মধ্যেই হিটলার শান্তিচুক্তি অগ্রাহ্য করে পোল্যান্ড আক্রমণ করে বসলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছিল।
বাংলাদেশেও যত দিন বিএনপি সন্ত্রাস বর্জন ও জামায়াতের সংস্রব বর্জন করবে না তত দিন আলোচনায় বসে কোনো লাভ হবে না। যেকোনো আলোচনা ও আপস মিউনিখ চুক্তির পরিণতি বহন করবে। বিএনপির আসল লক্ষ্য শান্তিপূর্ণ পন্থায় গণতান্ত্রিক আন্দোলন দ্বারা সরকারের বিরোধিতা করা নয়। তাদের লক্ষ্য সংঘাত ও সংঘর্ষের পথে এই সরকারের উচ্ছেদ ঘটানো। তাদের দোসর জামায়াতের লক্ষ্য কি দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা, না জিহাদি সন্ত্রাস?
বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলেও যত দিন প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন, তাঁরা দেশের বড় বড় সমস্যায় কেবল সরকারকে দোষারোপ না করে নিজেরা পথে নেমেছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় দেখা গেছে সভা, সেমিনার ডেকে আপ্তবাক্য উচ্চারণের চেয়ে বুদ্ধিজীবীরা রাজপথে নেমেছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঠেকাতে নিজেরা আত্মদান করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদারদের রোখার ব্যাপারেও কি বুদ্ধিজীবীরা ঘরে বসে কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের উপদেশ দিয়েছেন, না নিজেরাও সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন? দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় ভূমিকা না থাকলে হানাদাররা জামায়াতিদের সহায়তায় ২৬ মার্চ ও ১৪ ডিসেম্বর (১৯৭১) বুদ্ধিজীবী হত্যার তাণ্ডব চালাত না।
বাংলাদেশের আজকের বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ একাত্তরের সেই দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের উত্তরাধিকার বহন করে না। তারা নব্য বুদ্ধিজীবী, সুধীসমাজের ছাপ মেরে গায়ে নতুন উত্তরীয় ধারণ করেছেন। কিন্তু ভেতরের সুযোগসন্ধানী শাখামৃগ স্বভাবটি প্রায়ই প্রকট হয়ে ওঠে। তাঁরা ভাবেন, সমাজ সংক্রান্তিতে সুযোগ-সুবিধার চোরাবালিতে মুখ বুজে তাঁরা সম্ভবত বেঁচে যাবেন। তাঁদের উদ্দেশেই কবি সম্ভবত লিখে গেছেন :
'থাকতে কি চাও নির্বিরোধ
রক্তেই হবে সে ঋণ শোধ।'
লন্ডন, সোমবার, ১৯ জানুয়ারি ২০১৫
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য