আজ মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

প্রজন্মের জাগরণ ইতিহাসের ধারাবাহিকতা

কবির য়াহমদ  

২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধিদের বিচার কাজ শুরু করবে বলে ঘোষণা দেয়। দলটির এই ঘোষণা প্রবল জনপ্রিয়তা পায় এবং একে কেন্দ্র করে তারা নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করে। এই নির্বাচনী অঙ্গীকার ব্যাপক জনসমর্থন পাওয়ার প্রধান কারণ হলো দেশব্যাপী যুদ্ধাপরাধি রাজাকারদের প্রতি গণমানুষের প্রবল ঘৃণা এবং কলংকমুক্তির অভিপ্রায়। তাছাড়া স্বঘোষিত রাজাকারেরা মন্ত্রিত্ব লাভ করে বাংলাদেশের পতাকা তাদের গাড়িতে উড়িয়েছিল সর্বশেষ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। জামায়াতের নেতারা বিশেষ করে রাজাকার মতিউর রহমান নিজামী এবং রাজাকার আলী আহসান মুজাহিদ মন্ত্রি হলেও তাদের শাসনামলের পাঁচ বছরের মধ্যে একবারের জন্যে হলেও স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের বীরসেনানিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যায় নি যা ছিল মন্ত্রিদের একটা অলিখিত রেওয়াজ। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পরেও তারা একাত্তরের কৃতকর্মের জন্যে ক্ষমা চায় নি উপরন্তু বিভিন্নভাবে একাত্তরে বাঙালি নিধনকল্পে তাদের কার্যক্রমগুলোর পক্ষে সাফাই গাইছিল বিভিন্নভাবে।


যুদ্ধাপরাধিদের বিচারকাজ শুরু করার ব্যাপারটি ছিল আওয়ামীলীগ সরকারের বাধ্যবাধকতা কারণ সেটা ছিল তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি। ক্ষমতারোহনের এক বছরের মাথায় ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদুস সামাদ চৌধুরী কয়েস যুদ্ধাপরাধিদের বিচারের দাবি সম্বলিত এক বেসরকারি প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রীসহ সিনিয়র সাংসদরা সমর্থন জানালে স্পীকার তা অনুমোদন দেওয়া হবে কিনা এই প্রশ্ন ভোট নেন। মৌখিক ভোটে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় এবং আরও বিস্তৃতভাবে পর্যালোচনার জন্যে সংসদীয় স্থায়ি কমিটিতে পাঠানো হয়। একই বছরের মার্চ মাসের পঁচিশ তারিখে সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী অভিযুক্তদের তদন্ত এবং বিচারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২১ মে সরকার বিশেষজ্ঞদের মতামত চেয়ে ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টটি আইন কমিশনে পাঠায়। এর প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে আইন কমিশন দেশের বিশেষজ্ঞ আইনজীবী, বিচারপতি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং আরও কয়েকজন আইনজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে ১৯৭৩ সালে প্রণীত ট্রাইব্যুনালের কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে সংশোধন আনার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেয়। ৯ জুলাই ২০০৯ কমিশনের সুপারিশ বিবেচনা করে ১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনকে যুগোপযোগী করার জন্য ট্রাইব্যুনালের কিছু সংশোধনী জাতীয় সংসদে মৌখিক ভোটে পাশ হয়। স্বাধিনতার ৩৯ বছর পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়। ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় যুদ্ধাপরাধিদের বিচার কাজ এবং আওয়ামীলীগ সরকার তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যায়। এর একদিন পর ট্রাইব্যুনালের প্রথম শুনানির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে তার কার্যক্রম শুরু করে। ঢাকার পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হকের নেতৃত্বে অপর দুই সদস্য বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর ও বিচারক এ কে এম জহির আহমেদ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে শুনানি পরিচালনা করেন।

২০১০ থেকে ২০১২ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ছিল একটি, ২৩ মার্চ ২০১২ রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের অনুমোদনের মাধ্যমে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর ধারা ৬-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে এ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে বলে আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. মজিবর রহমান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়। দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন প্রথম ট্রাইব্যুনালের বিচারক প্যানেলের জ্যেষ্ঠ সদস্য হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর। তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই বিচারক হলেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ শাহীনুর ইসলাম। বিচারপতি ফজলে কবীরের স্থলে প্রথম ট্রাইব্যুনালে সদস্য করা হয় হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি আনোয়ারুল হককে।

মানবতাবিরোধী অপরাধ (Crimes against Humanity), শান্তিবিরোধী অপরাধ (Crimes against Peace), গণহত্যা (Genocide), যুদ্ধাপরাধ (War Crimes), ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনবিরোধী কাজ এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যে কোন অপরাধকে আওতাভুক্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ নামে যে আইনের মাধ্যমে মানবতাবিরোধি অপরাধের যে বিচারকার্য শুরু হয় তা মূলত  হল ১৯৭৩ সালে পাশ হওয়া একটি আইন যার অধীনে বাংলাদেশের গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধসহ আন্তর্জাতিক আইনের অন্তর্ভূক্ত সকল সশস্ত্রবাহিনী, প্রতিরক্ষা ও এর সহায়ক কোন বাহিনীর সদস্যকে আটক ও ফৌজদারি আইনের অধীনে দণ্ডদান করতে পারে। আইসিটি আইনটি একপাক্ষিক করা হয়নি। আইনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধিদের আইনী সহযোগিতার পথ প্রশস্থ করা হয় ফলে একে কেউ ক্যাঙ্গারু কোর্ট কিংবা জুডিশিয়াল কিলিং জাতীয় অপবাদ দেওয়ার পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়। ফলে অবিসংবাদিতভাবে এই আইনটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মানস¤পন্ন করার যাবতীয় প্রচেষ্টা চালানো হয়। আওয়ামীলীগ সরকারের তৎকালীন আইনমন্ত্রি ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ নিজে সবগুলো প্রক্রিয়ার জড়িত ছিলেন এবং  সারাবিশ্বে স্বীকৃত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যার বিচারের জন্যে গঠিত নুরেমবার্গ ট্রায়ালের সাথে স¤পর্কিত অধ্যাপক ইয়েশেখের কাছ থেকে পরামর্শ গঠনের জন্যে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো হয় ব্যারিস্টার সোহরাব আলীকে। ফলে সব পর্যায়ে এই আইনের মাধ্যমে মানবতাবিরোধি অপরাধের বিচারের জন্যে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে সব ধরণের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে সরকার। যার ফলও পেয়েছে তারা, সারা দেশে প্রবল জনপ্রিয় হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তবে এর ব্যতিক্রম যে ছিল না তা নয়। একাত্তরের গণহত্যার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত জামায়াতে ইসলামি কর্তৃক এই আইন এবং বিচার প্রক্রিয়া নানাভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। দেশে জামায়াতের সাথে রাজনৈতিক জোট গড়ার কারণে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধিন বিএনপি জামায়াতের সাথে গলা মিলিয়েছে এবং পেট্টোডলারের প্রভাবে তার সাথে গলা মিলিয়েছে সুবিধাবাদী গোষ্ঠীও।

২৫ মার্চ ২০১০ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর ২১ জানুয়ারি ২০১৩ তে প্রথম রায় ঘোষিত হয়। রায়ে মানবতাবিরোধি অপরাধে জড়িত থাকার আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এই মামলাটি বাচ্চু রাজাকারের অনুপস্থিতিতে স¤পাদিত হয় এবং গ্রেফতারের আগেই সে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি  ২০১৩ দ্বিতীয় রায় ঘোষিত হয় এবং রাজাকার কাদের মোল্লা যে একাত্তরে মিরপুরের কসাই নামে পরিচিত ছিল তার বিরুদ্ধে আনীত কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যা, আলুব্দি গ্রামে ৩৪৪ জন মানুষ হত্যাসহ মোট ৬টি অপরাধের ৫টি প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। রায়ের পর আদালতে দাঁড়িয়ে রাজাকার কাদের মোল্লা 'ভি (ভিক্টরি) চিহ্ন' দেখায় যাতে ফুঁসে ওঠে সারা দেশ। রায়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে মানুষজন ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। শাহবাগে ব্লগার এবং অনলাইন এক্টিভিস্টরা গোল হয়ে হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করলে এক সময় সাধারণ মানুষজনও এসে যোগ দেয় বিক্ষোভে। সময়ের সাথে সাথে মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে, বন্ধ হয়ে যায় শাহবাগের চৌমুখি রাস্তা, সারা দেশের মানুষজনও একইভাবে তাদের নিজেদের মত করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে যারা দেশ জেনে যায় বন্ধ হয়ে গেছে শাহবাগ, স্থবির হয়ে যাচ্ছে ঢাকা, ফলে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। রাত বাড়ে কিন্তু মানুষজন ঘরে ফেরে না, স্লোগানে-স্লোগানে মুখর হয় রাজধানী ঢাকা। অগণন মানুষের কন্ঠে ছড়িয়ে পড়ে একই স্লোগান-দাবি, কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই।

গণমানুষের ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। শুধু ঢাকা নয় সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশালসহ দেশের আনাচেকানাচে শাহবাগের অনুরূপ প্রতিবাদে-স্লোগানে রাজাকারদের ফাঁসির দাবি জানাতে থাকে সাধারণ মানুষ। স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সমাবেশ হয় শাহবাগে ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখ। একইভাবে সারাদেশেও বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশে রাজাকারদের ফাঁসির দাবি এবং কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় ছাড়া ঘরে ফিরে না যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করে সর্বস্তরের মানুষ। সাধারণ মানুষদের এই কাতারে এসে মিলিত হয় বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টদের মাধ্যমে প্রতিবাদের সূচনা হলেও মানুষদের এই অংশগ্রহণ ছিল অভূতপূর্ব। এমন আন্দোলন এর আগে কেউ দেখেনি, এমন স্লোগান আর প্রতিবাদের ধরণ কেউ দেখেনি আগে। মিডীয়াকর্মিরা শাহবাগে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সরাসরি সম্প্রচারিত হতে থাকে প্রতিবাদী গান-স্লোগান আর দাবি আদায়ের বক্তব্য।

সরকারী দল আওয়ামীলীগের কেন্দ্রিয় নেতা, মন্ত্রিরা শাহবাগে আসেন। যাদের অনেকেই উপস্থিত প্রতিবাদকারীর ক্ষোভের মুখে পড়েন। রাজাকার কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে জমায়েত হলেও একই সময়ে এই আন্দোলন ছিল রীতিমত সরকারবিরোধি। ফলে স্বাভাবিক ক্ষোভের শিকার হন আওয়ামীলীগের নেতা-মন্ত্রিরা। একই সময়ে প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো বিশেষ করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রমৈত্রী, জাসদ ছাত্রলীগসহ অন্যান্য সংগঠনগুলো শাহবাগে এসে সংহতি জানায়। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল শাহবাগে সংহতি জানাবে বলে মিডিয়ায় সংবাদ প্রচার হলেও তারা সেখানে যায় নি কারণ তাদের গণসংগঠন বিএনপির সাথে জামায়াতের ছিল রাজনৈতিক জোট। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া ছাত্রদলের পক্ষে সম্ভব হয়নি বলে তারা সাংগঠনিকভাবে শাহবাগে গিয়ে রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে সংহতি জানাতে পারেনি। তবে ব্যক্তি পর্যায়ের অনেক ছাত্রদল নেতাকর্মি শাহবাগের প্রতিবাদকারীর সাথে মিশে ছিল সাধারণভাবেই।

শাহবাগ শুরুর দিকে শোনা যাচ্ছিল বিএনপি সংহতি জানাতে পারে শাহবাগের আন্দোলনকারীদের সাথে। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্ব জামায়াতের প্রতি এতটা নির্ভরশীল ছিল যে তারা পারেনি তাদের গণমানুষের ভাষা বুঝতে, অনুধাবণ করতে পারেনি দীর্ঘ ৪৩ বছরের গ্লানি আর অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার উপায়। ইত্যবসরে মাহমুদুর রহমানের স¤পাদিত দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা ৯ ফেব্রুয়ারি লাল অক্ষরে শিরোনাম করে 'শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনী' বলে। একই সাথে তারা আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্লগারদের নাস্তিক ও ইসলামবিরোধি আখ্যা দিয়ে দেশে ধর্মীয় দাঙ্গা সৃষ্টির পাঁয়তারা চালায়। ধর্ম ব্যবসার এই নতুন কৌশলে খুব সহজেই বিভক্ত হয়ে পড়ে সমাজ। এক শ্রেণির ধর্মান্ধ মোল্লাদের মাধ্যমে ফের আলোচনায় আসে হেফাজতে ইসলাম। তারা শাহবাগের প্রতিবাদকারীদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে মানুষের ধর্মানুভূতিতে উস্কানি দেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করে আমাদের দেশ পত্রিকা এবং জামায়াতে ইসলামির আর্থিক সহযোগিতায়। বিএনপিও নেতিবাচক বক্তব্য দেয় শাহবাগের আন্দোলনকারিদের বিরুদ্ধে।

রাজাকার কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পরেও যখন যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়া হয় তখন দাবি ওঠে আপীলের। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল আইনে রাষ্ট্রপক্ষের আপীলের সুযোগ না থাকার বিষয়টি সামনে আসে। ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ জানানো হয় সব পক্ষের আপিলের সমান বিধান রেখে আইন সংশোধন হচ্ছে সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে আপিলের নিষ্পত্তি হবে। তন্মধ্যে ৩০ দিনের মধ্যে আপীলের সুযোগ এবং পরের ৬০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি হবে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে সব পক্ষের আপিলের সমান সুবিধা রেখে ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনীর খসড়া অনুমোদন করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষ অথবা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির জন্য সুপ্রিমকোর্টে আপিলের সমান সুযোগের বিধান রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর সংশোধন বিল সংসদ অধিবেশনে উত্থাপন করা হয়। কাদের মোল্লা এবং কামরুজ্জামানের জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যপদ গঠনতন্ত্রের ১২ ও ১৩ (ক) এবং ১৪ ধারা অনুযায়ী বাতিল করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর সংশোধনী প্রস্তাব জাতীয় সংসদে পাস হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস (সংশোধন) বিলে স্বাক্ষর করে দেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরের ফলে বিলটি আইনে পরিণত হয়। ফলে গণজাগরণ মঞ্চের একটি দাবির প্রাথমিক বিজয় হয় এবং রাষ্ট্রপক্ষ আপীলের সমান সুযোগ পায়। যার ধারাবাহিকতায় আপীলের চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ আসে এবং ১২ ডিসেম্বর ২০১৩ রাতে তা কার্যকর হয়। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোন যুদ্ধাপরাধির শাস্তি কার্যকর হয়।

এর আগে ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর মিরপুরের পলাশনগরে ব্লগার 'থাবা বাবা' (প্রকৌশলী আহমেদ রাজীব হায়দার) কে গলাকেটে হত্যা করে মৌলবাদী গোষ্ঠী। দশদিনের শাহবাগ আন্দোলনের প্রতিবাদকারীরা যখন রাষ্ট্রের আইনের সংশোধনী আনার ঘোষণার পর ঘরে ফিরে যাচ্ছিল 'থাবা বাবা'র হত্যাকাণ্ডে আবারও শাহবাগে ২৪ ঘণ্টা অবস্থানের ঘোষণা দেন ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের ইমরান এইচ সরকার। প্রথম বারের মতো মিডিয়ায় শাহবাগের আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মুখ খুলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি রাজাকারদের পক্ষাবলম্বন করে বলেন, তরুণ প্রজন্ম আজ বিভ্রান্ত!

গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, জাতীয় সংসদে এক ভাষণে বলেছিলেন, 'আমার মনও শাহবাগের আন্দোলনে ছুটে যেতে চায়।' একই দিন ঢাকায় বিএনপির এক সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে সাদেক হোসেন খোকা বলেন, 'শাহবাগে তরুণ প্রজন্ম বিভিন্ন দাবি তুলেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল (বিএনপি) হিসেবে আমরা তাদের আবেগের প্রতি সম্মান করি। পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধের বিচারের সঙ্গে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিটিও সম্পৃক্ত করার জন্য আহ্বান জানাই। বিএনপি বুদ্ধিজীবিরা রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের সমালোচনা করে বলা শুরু করে এই তারুণ্য কেন শেয়ার বাজার, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির স্বপক্ষে কথা বলছে না। তখন শাহবাগের মঞ্চ থেকে বলা হয় তারা অংক পরীক্ষার সময় অংক এবং বাংলা পরীক্ষার সময় বাংলা পরীক্ষা দিতে বসেছেন। সুতরাং রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা এই দাবির পাশাপাশি অন্য কোন দাবিতে জড়াবে না। মঞ্চের তাৎক্ষণিক এই বক্তব্য সারাদেশে বিশেষ করে যারা রাজাকারদের সর্বোচ্চ শাস্তি চান তাদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিল। যদিও পরবর্তিতে গণজাগরণ মঞ্চ এই ঘোষণায় অটল থাকতে পারেনি। মঞ্চের মূখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বক্তব্য এবং কর্মসূচি দিয়েছেন যা প্রকৃতপক্ষে রাজাকারদের ফাঁসির দাবির সাথে সম্পর্কিত নয়।

সরকার যখন আপীলের সমান সুযোগ রেখে আইনের সংশোধন করেছে তখন কী গণজাগরণ মঞ্চ বন্ধ করে দেওয়া উচিত কীনা- এমন প্রশ্ন উঠে আসছিল। কিন্তু যখন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার থাবা বাবাকে হত্যা করা হয় এবং রাজাকারদের ফাঁসির দাবি জানানো ব্লগারদের নাস্তিক ও ধর্মবিরোধী আখ্যা দেওয়া হয় তখন পেছনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না মঞ্চের পক্ষে। তার ওপর ধর্মান্ধ জামায়াত-হেফাজত কর্তৃক ২২ ফেব্রুয়ারি সারাদেশের শহিদ মিনার এবং গণজাগরণ মঞ্চে যখন হালমা চালানো হয়, শহীদ মিনারে ভাঙচুর, জাতীয় পতাকায় আগুন দেওয়া হয় তখন আর পেছনে ফেরার সুযোগ ছিল না। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে প্রগতির ধারাকে সমুন্নত এবং রাজাকারদের পক্ষে পরিস্কারভাবে একটা পক্ষ মাঠে নামার কারণ তারুণ্য ঘরে ফেরেনি। তখন রাজাকারদের ফাঁসির দাবি জোরালো রাখতে তাদের মাঠে থাকাটা জরুরিই ছিল এবং তারুণ্য সময়ের সে আহ্বানকে বুকে ধারণ করে স্লোগানে-স্লোগানে জানিয়ে গেছে তাদের দাবি। ফলে একে একে আসতে থাকে রাজাকারদের ফাঁসির রায়। রাজাকার দেলাওয়ার হুসেইন সাইদির ফাঁসির রায় আসে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। সাইদির রায়কে কেন্দ্র করে জামায়াতে ইসলামি সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তিন দিনের নাশকতায় তারা হত্যা করে সত্তরোর্ধ মানুষ। গণজাগরণ মঞ্চ তখন জামায়াতকে রুখে দিতে মাঠে নামেনি কারণ অহিংসভাবে দাবি আদায় ছিল তাদের লক্ষ্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যেহেতু পুলিশ-র‌্যাবসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য বাহিনীগুলোর সেখানে তারুণ্য প্রতিরোধে নামলে নাশকতা এবং খুন, পালটা খুনের ঘটনায় সারাদেশে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। গণজাগরণ মঞ্চ কিংবা তারুণ্যের এই পরিমিতিবোধ জনসাধারনের কাছে একদিকে যেমন প্রশংসিত হয়েছে অন্যদিকে দেশ বেঁচে গেছে অনাকাক্সিক্ষত দীর্ঘ নাশকতা থেকে।

গণজাগরণ কিংবা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গণআন্দোলনের চেতনা থেকে উৎসারিত। রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন একদিনের অর্জন নয়। শহীদ জননীর দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে ব্লগারেরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের লেখনির মাধ্যমে অনলাইন মাধ্যমে নিজেদেরকে সংগঠিত করেছিলেন।  অনলাইনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী একটা প্রজন্ম গড়ে ওঠেছিল যারা একাত্তরের গণহত্যার পরিকল্পনাকারী রাজাকারদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামকে অব্যাহত রেখেছিল। এই প্রজন্মের সবাই যে অনলাইনে গবেষণা কিংবা লেখালেখি করেছিল তা নয়, তাদের লেখনির মাধ্যমে এক শ্রেণির মানুষ নিজেদের আÍপরিচয়ের সন্ধানে ছিল। যাদের অনেকেই হয়ত দেখেনি জাহানারা ইমামের সে আন্দোলনের দিনগুলো ও ইতিহাস কিংবা বুকে ধারণ করে ছিল সে চেতনা।

সব কালে, সব সময়ে বাংলাদেশমুখি মানুষের সংখ্যা ছিল অগণন। মানুষ যখনই সুযোগ পেয়েছে, ডাক পেয়েছে তখনই সাড়া দিয়ে রাজাকারদের প্রতি জানিয়ে গেছে তাদের প্রবল ঘৃণা। সাংগঠনিক ভিত্তি হোক আর ব্যক্তি পর্যায়েই হোক প্রবল ঘৃণাকে আগলে রেখে অপেক্ষায় ছিল প্রতিবাদি ডাকের। রাজাকারেরা দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার পরেও তাদের কৃতকর্ম ভুলে যায় নি দেশের মানুষ। রাজাকারদের পূণর্বাসন প্রক্রিয়াকে দাঁতে দাঁত চেপে হয়ত সহ্য করা হয়েছে কিন্তু আখেরে এই প্রতিক্রিয়া হয়েছে কার্যকরভাবে অবিনাশি।

একাত্তরের গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের প্রধানতম সাইনবোর্ড গোলাম আযম বাংলাদেশে আসে মেজর জিয়ার শাসনামলে। পাকিস্তানি এই নাগরিক তার অসুস্থ মাতাকে দেখতে আসার নামে বাংলাদেশে আসে। প্রতিবাদ করার জন্যে খুব বেশী লোক পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কাজী নূর-উজ্জামানসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তার এই আগমনের জোরালো প্রতিবাদ করেন। ফলে মাওলানা মান্নানের ইনকিলাব নামক পত্রিকা এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ইসলামবিরোধী বলে আখ্যা দিয়েছিল। ধর্মান্ধ এই গোষ্ঠীদের কাছে গোলাম আযম মানে ইসলামের প্রতিশব্দ। একাত্তরের গণহত্যার মুল পরিকল্পনাকারী হিসেবের বাইরেও এই গোলাম আযম গং মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য মুসলিম দেশে মক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পর অপপ্রচার চালিয়েছিল বাংলাদেশে ইসলাম বিনষ্ট হয়েছে বলে। ফলে ওআইসি এবং বেশ কিছু ইসলামি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অনেক দেরি করেছিল।

১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের সর্বশেষ সাংবিধানিক পেরেক ঠুকে দেন  জেনারেল এরশাদ। কলমের খোঁচায় দেশের ওপর লেগে যায় ধর্মীয় লেবাস। গড়ে ওঠে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী জোট। নেতৃত্বে ছিলেন- আহমদ শরীফ, শাহরিয়ার কবির, সিরাজুল ইসলাম, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। কিন্তু তারা নির্বিঘ্নে তাদের প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে পারেন নি। সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু আর সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন। রাজাকার মান্নানের ইনকিলাব পত্রিকা তাদের বিপক্ষে নেমে পড়ে সম্মুখ সমরে। ফলে হেন কোন অভিধা বাকি থাকেনি তাদের জন্যে। তবু আশার কথা তারা প্রতিবাদে মুখর ছিলেন এবং লৌকিক কোন অর্জন ঘরে তুলতে না পারলেও চেতনার বীজকে প্রোথিত করেছিলেন সবার মাঝে। যা এক দাবানল হিসেবে পরিগণিত হয়। ১৯৯২ সালে যখন জামায়াতে ইসলামি তাদের ভারপ্রাপ্ত আমীরের পদ থেকে রাজাকার আব্বাস আলী খানকে সরিয়ে দিয়ে গোলাম আজমকে "আমীর" ঘোষণা করলো তখন চেতনার স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে। সামনে চলে আসে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয় গণআদালত।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর যখন পাকিস্তানি নাগরিক ও যুদ্ধাপরাধি গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামি তাদের দলের আমীর ঘোষণা করে। একটা দলের প্রধান কে হবে সেটা তাদের নিজস্ব বিষয় থাকলেও যখনই একজন পাকিস্তানি নাগরিক এবং শীর্ষ যুদ্ধাপরাধিকে বাংলাদেশের একটা রাজনৈতিক দলের প্রধান করা হয় তখনই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সুধী সমাজ। জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করে ১৯ জানুয়ারি ১৯৯২, ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি' গঠিত হয়। কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ 'গণআদালত' এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আযমের ঐতিহাসিক প্রতীকী বিচার অনুষ্ঠান করে। গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দশটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। এডভোকেট গাজিউল হক, ড. আহমদ শরীফ, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সুফিয়া কামাল, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, শওকত ওসমান, লে. কর্নেল (অব.) কাজী নুরুজ্জামান, লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী ব্যারিস্টার শওকত আলী খান এবং জাহানারা ইমাম নিয়ে ১২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের রায়ে গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। গণআদালতের চেয়ারম্যান হিসেবে রায় ঘোষণা করে শহীদ জননি জাহানারা ইমাম এবং একই সাথে তিনি গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবিও জানান।

গণআদালতে যখন গোলাম আযমের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষিত হলো তখনই জামায়াতবান্ধব বিএনপি সরকার গণআদালতের সাথে সংশ্লিষ্ট ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে অজামিনযোগ্য মামলা দায়ের করে। পরবর্তী সময়ে হাইকোর্ট ২৪ বিশিষ্ট ব্যক্তির জামিন মঞ্জুর করেন। এরপর লাখো জনতার পদযাত্রার মাধ্যমে জাহানারা ইমাম ১৯৯২ সালের ১২ এপ্রিল গণআদালতের রায় কার্যকর করার দাবিসংবলিত স্মারকলিপি নিয়ে জাতীয় সংসদের স্পীকার, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে পেশ করেন। ১০০ জন সংসদ সদস্য গণআদালতের রায়ের পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেন। রায় বাস্তবায়নের দাবি জানানো ১০০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ৮৮জনই ছিলেন আওয়ামীলীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য।

গণআদালতে রায় ঘোষণা, স্মারকলিপি দিয়েই তিনি থেমে থাকেন নি, আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেশব্যাপী গণস্বাক্ষর, গণসমাবেশ, মানববন্ধন, সংসদ যাত্রা, অবস্থান ধর্মঘট, মহাসমাবেশ ইত্যাদি কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। জামায়াতপ্রেমে হাবুডুবু খাওয়া বিএনপি সরকার ১৯৯৩ সালের ২৮ মার্চ নির্মূল কমিটির সমাবেশে পুলিশ হামলা চালায় । পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন জাহানারা ইমাম। সারাদেশ থেকে এই আন্দোলন দেশের বাইরেও ছড়িয়ে যায়। বিশ্বের দেশে দেশে বাংলাভাষী বাংলাদেশি আছেন সেখানেও গঠিত হয় কমিটি।

২৬ মার্চ ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা দিবসে গণআদালত বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণতদন্ত কমিটি ঘোষিত হয় এবং আরও আট শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মোঃ কামারুজ্জামান, আবদুল আলীম, দেলাওয়ার হোসেইন সাইদি, মওলানা আবদুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ এবং আবদুল কাদের মোল্লা।

গণতদন্ত কমিটি ঘোষিত হওয়ার ঠিক এক বছর পর ১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে গণআদালতের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে গণতদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান কবি বেগম সুফিয়া কামাল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনে জনসমাবেশে জাহানারা ইমামের হাতে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট হস্তান্তর করেন যেখানে সন্নিবেশিত ছিল রাজাকারদের আখ্যান এবং অপরাধের পুর্বাপর। গণতদন্ত কমিশনের সদস্যরা ছিলেন শওকত ওসমান, কে এম সোবহান, সালাহ উদ্দিন ইউসুফ, অনুপম সেন, দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, খান সারওয়ার মুরশিদ, কবি শামসুর রাহমান, শফিক আহমেদ, আবদুল খালেক এবং সদরুদ্দিন। একই সমাবেশে আরও আট যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম চালানোর ঘোষণা দেয়া হয়। এ সময়ে খুব দ্রুত শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকলে ১৯৯৪ সালের ২ এপ্রিল চিকিতসার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হয় জাহানারা ইমামকে। সে সময়ে তিনি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। ২৬ জুন সবাইকে ছেড়ে চলে যান জাহানারা ইমাম।

শহীদ জননী জানাহানার ইমাম মারা যাওয়ার আগে দেশবাসীর উদ্দেশে এক আবেগঘন এবং দিকনির্দেশনাপূর্ণ চিঠি লিখে গেছেন। যে চিঠিতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের ভার দেশবাসীর ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে চেয়েছিলেন। তাঁর অসুস্থতা এবং মৃত্যুর মাত্র দিন তিনেক আগে বাংলাদেশে গোলাম আযম নাগরিকত্ব লাভ করে। দীর্ঘ তিন বছরের আন্দোলনের পরিসমাপ্তি হয় দুঃখজনকভাবে।  মারা যাওয়ার আগে জাহানারা ইমাম এই আন্দোলনের দায়িত্ব জনসাধারণের ওপর ন্যস্ত করে দিয়ে এক আবেগঘন ও দিকিনির্দেশনামূলক চিঠি লিখেন। চিঠিতে তিনি লিখেন-

সহযোদ্ধা দেশবাসীগণ,
আপনারা গত তিন বছর একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরোদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এই লড়াইয়ে আপনারা দেশবাসী অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আন্দোলনের শুরুতে আমি আপনাদের সঙ্গে ছিলাম। আমাদের অঙ্গীকার ছিল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ রাজপথ ছেড়ে যাবো না। মরণব্যাধি ক্যান্সার আমাকে শেষ মরণ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাই নি। মৃত্যুর পথে বাধা দেবার ক্ষমতা কারো নেই। তাই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং অঙ্গীকার পালনের কথা আরেকবার আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনারা আপনাদের অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণ করবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আপনারা আমার সন্তান-সন্ততিরা - আপনাদের উত্তরসূরিরা সোনার বাংলায় থাকবেন।

এই আন্দোলনকে এখনো অনেক দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, নারী, ছাত্র ও যুবশক্তি, নারীসমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। তবু আমি জানি জনগণের মতো বিশ্বস্ত আর কেউ নয়। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। তাই গোলাম আযম ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের দায়িত্বভার আমি আপনাদের, বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করলাম। অবশ্যই, জয় আমাদের হবেই। - জাহানারা ইমাম

জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন হারিয়ে যায়। সাইনবোর্ড সর্বস্ব হয়ে পড়ে তারা। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তৃতা আর বিবৃতি দেওয়া পর্যন্তই চলতে থাকে কার্যক্রম। এর পেছনে মূল কারণ ছিল নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউ অবশিষ্ট ছিল না, বৈরি সরকার এবং পরবর্তিতে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসলেও যুদ্ধাপরাধিদের বিচারের দাবি উচ্চে তুলে ধরার মতো কেউ ছিল না।

অনেককেই বলতে শোনা যায়, বাঙালির জাগরণকালের সময় পার্থক্য দু'দশক। দুই দশক সময়কাল পর পর তারা জেগে ওঠে তুমুল বিক্রমে, ঘরে তোলে সাফল্য। বায়ান্ন, একাত্তর, নব্বই, দুই হাজার তেরো-জাগরণের বছরওয়ারি কিয়দংশ হিসাব। বায়ান্নতে বাংলাকে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন, উনসত্তর-একাত্তরে গণঅভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআন্দোলনের পর রাজাকারদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবিতে রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। 

প্রজন্মের দেশ কাঁপানো গণজাগরণ আন্দোলন শুরু হয়নি কোনও রাজনৈতিক নেতানেত্রীর হাত ধরে। কিন্তু এর মধ্যে রয়েছে এক প্রবল রাজনৈতিক চেতনা, যা ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধকে। প্রচলিত ধারার রাজনীতি সংশ্লিষ্টতাবিযুক্ত মানুষের দেশপ্রেম, রাজনৈতিক চিন্তা দিয়ে এ আন্দোলন হুট করে রাস্তায় নেমে আসেনি। এর আগে বছরের পর বছর সাইবারবিশ্বে এ নিয়ে তুমুল আন্দোলন চলছে। অনলাইন, বিশেষ করে ব্লগে এ নিয়ে অনেক আগে থেকেই লেখালেখি হয়েছে, হয়েছে গবেষণা। এই লেখালেখি-গবেষণা করছে তারা, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি; কিন্তু অন্তরে ধারণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন, যার বীজ বপন করেছিলেন শহিদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর গণআদালতের মাধ্যমে।

ইতিহাসের ধারাবাহিকতার এই আন্দোলনে বাংলাদেশের মাঝে রাজাকারদের ঘৃণা করার একটা মানসিকতা গড়ে উঠেছে। মানুষ সাহস করে বলতে পারছে রাজাকারদের ফাঁসি চাই। এটা বিশাল অর্জন। এই অর্জনের পথ ধরে একদিন বাংলাদেশ রাজাকারমুক্ত হবে, হবেই!

কবির য়াহমদ, প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর; ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ