আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

কেন জার্মানি এলাম?

মাহমুদুল হক মুন্সী  

মানুষ নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দেয় অনেক কারণে। কেউ পড়াশোনার জন্য, কেউ চাকুরির জন্য, কেউ ব্যবসার জন্য, কেউ অন্য মানুষের প্রতি ভালোবাসায় আর কেউ উন্নত জীবনের লোভে। আমার জন্য উক্ত কোন কারণই কাজ করেনি। আমাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে বেঁচে থাকার জন্য।

আমি কখনো ভাবিনি আমাকে আমার মাতৃভূমি ছাড়তে হবে। আমার ছোট খালামনি ছোটবেলায় যখন আমাকে মুখে তুলে খাওয়াতো, বলতো তাঁর আমেরিকায় বিয়ে হবে এবং বিয়ের পর আমাকে আমেরিকায় নিয়ে যাবে। সত্যি সত্যি তাঁর কানাডা প্রবাসীর সাথে বিয়ে হয়ে গেলো। আমি এস এস সি পাস করার পর উনি দেশে এলে আমাকে বলেন ওনার কাছে যাবার জন্য। আমি তখন ব্যান্ডের গানে অদ্ভুতভাবে মগ্ন। দিন রাত হেঁড়ে গলা ছেড়ে দিয়ে জেমসের গান গাই আর স্বপ্ন দেখি একদিন আমার একটা ব্যান্ড থাকবে আর আমি সেটার ভোকাল হবো। আমি বললাম না, আমি গান গাইবো। খালামনি অবাক হয়ে বললেন ওখানেও তুমি গান গাইতে পারবা। কানাডা আরো উন্নত জায়গা গান গাইবার জন্য। আমি জিজ্ঞাসা করলাম আমি কি বাংলায় গান গাইতে পারবো?

খালামনি হাল ছেড়ে দিলেন। এইচ এস সি পাস করবার পর খালামনি আবার দেশে এসেছিলেন, উনি আবার আমাকে বললেন কানাডা যাবার কথা। আমি বললাম পড়াশোনাটা শেষ করি, তারপর নাহয় যাওয়া যাবে। আমার আসলে যাবার কোন ইচ্ছে ছিলো না। এই বাংলার মাটি-আকাশ-জল-বাতাস ছেড়ে আমি কোথায় যাবো? এরপর আরো একবার উনি বলেছিলেন ফোনে, আমি কোনরকমে পাশ কাটিয়েছি।

আমি স্বপ্ন দেখতাম। স্বপ্ন দেখতাম একটি উজ্জ্বল আগামীর। একটি সুস্থ সুন্দর দেশের। মানুষের জন্য কাজ করবার চেষ্টা করতাম। কোথাও বন্যা হলে, কোথাও ঝড়ে জেলেদের বাড়িঘর ভেঙ্গে গেলে, কোথাও ভূমিধ্বস হলে ছুটে যেতাম মানুষের সাহায্য নিয়ে। নিজের বা পরিবারের ততটা আর্থিক সক্ষমতা ছিলোনা, তাই চেষ্টা করতাম গায়ে খেটে পুষিয়ে দেবার। কেউ অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে, আমি সেটা পারছিনা, কিন্তু আমার তো পরিশ্রম করবার মতো শক্তি আছে, আমি সেটাই করিনা কেন? নিজের জেলার মানুষের জন্য একটি সংগঠন গড়ে চেষ্টা করছিলাম কোন উপকার করা যায় কিনা। শীতকালে শীতবস্ত্র বিতরণ, গরমে শিশুদের ভেতর আম, লিচু বিতরণ, আর্থিকভাবে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবার ব্যবস্থা করা। এগুলি আমার ঢোল পেটাবার জন্য বলছি না। এগুলি করতাম একটাই উদ্দেশ্য নিয়ে, আমার দেশটা বা আমার সমাজটাকে যেন নিজের অবস্থান থেকে নিজের সক্ষমতা দিয়ে একটু সাহায্য করতে পারি। একটা ব্যাপারে বিশ্বাস করি আমি, আমরা প্রত্যেকে আমাদের নিজের অবস্থান থেকে যদি কিছু করার চেষ্টা করি, সমাজ পরিবর্তন হতে বাধ্য। আমার দেশটার আরো উন্নতি হতে বাধ্য।

আমার শক্তির জায়গাটুকু ছিলো লেখালেখি। আমি লিখে লিখে অনেক কিছু করবার চেষ্টা করেছি, করে ফেলেছিও কিছু কিছু যা কোনদিন ভাবিনি আমার পক্ষে সম্ভব। ব্লগে যখন লেখালেখি শুরু করি, তখন একদিন দেখি একজন বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অনেক খারাপ কথা লিখে একটা পোস্ট দিয়েছে। আমি বঙ্গবন্ধুকে খুব ভালোবাসতাম, শ্রদ্ধা করতাম। আমি খুব ক্ষেপে গিয়ে এক ঘণ্টায় সেই লেখার বিরুদ্ধে ৩ টা লেখা লিখে ফেলেছিলাম। তখন থেকে আমার রাজনৈতিক লেখালেখির শুরু। আমি প্রচুর বই পড়তাম। আমার বাসায় প্রায় হাজার পাঁচেক বই এর একটি লাইব্রেরী ছিলো। সেটার বাইরেও বন্ধুদের কাছ থেকে ও স্কুল কলেজের লাইব্রেরী থেকে অসংখ্য বই আমার পড়া ছিলো। সে সূত্র ধরে কিছু লেখালেখি ও একটিভলি ব্লগে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের ব্লগারের বিরোধিতা করায় আমি এক গোষ্ঠীর ব্লগারদের কাছে শত্রু হিসেবে পরিগণিত হতে থাকি।

তখন ব্লগে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি ও বিপক্ষ শক্তি প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করতো।  আমাদের সহব্লগারদের নিয়ে একটা গ্রুপ তৈরি করা হলো এই প্রভাব বিস্তারের খেলায় নিজেদের শক্তিশালী করবার জন্য। ব্লগের মেধাবী কিছু লেখকের সহায়তা ও উৎসাহ পেয়ে আমরা সংখ্যায় বাড়তে থাকলাম। অবিশ্বাস আমার ভেতরে বর্তমান ছিলো স্কুলের গণ্ডি পেরুনোর পর থেকেই। কলেজে কখনো কখনো প্রকাশ করে ফেলতাম, ব্লগে এসে সেটা প্রকাশ করবার আরো ভালো মাধ্যম পেয়ে বিকশিত হলো। প্রচুর লেখা পড়তাম। মনে আছে, ব্লগে প্রথম এক মাসে প্রায় হাজার তিনেক ব্লগ পোস্ট পড়বার কথা। কিভাবে ধর্ম আমাদের জাতিকে নিপীড়ন করেছে, কিভাবে সেই ধর্মের দোহাই দিয়ে আমার ভাষাকে বদলে দেবার ষড়যন্ত্র হয়েছিলো আর কিভাবে সেই ধর্মের নামেই পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ গণহত্যাটি হয়েছিলো এই জনপদে… এসব জানতে পেরে আমার ধর্মের প্রতি অবিশ্বাস রূপ নেয় ক্রোধে।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লেখালেখির পাশাপাশি তাই জড়িয়ে যাই ব্লগে ‘কুখ্যাত নাস্তিক’ বলে পরিচিত মানুষগুলোর সাথে। অন্য একটি ফোরামে লেখালেখির সুবাদে পরিচিত হই আসিফ মহিউদ্দীনের সাথে। মনে আছে এক আড্ডায় তাকে অনুরোধ করেছিলাম সামহোয়ার ইন ব্লগে এসে লেখালেখি করবার জন্য। এর মাঝে ব্লগের সবার মাঝে পরিচিত মুখ হয়ে উঠি আজমেরী নামের একটি মেয়েকে, যে কিনা আমার বন্ধুর ছোটবোন ছিলো, কিডনি অপারেশনের জন্য প্রায় লাখ চারেক টাকা তুলে দিয়ে। এরপর ব্লগ ভিত্তিক বিভিন্ন একটিভিজমের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ি। ব্লগার দিনমজুরের মুক্তির ডাক দিয়ে আন্দোলন করা, ব্লগ আড্ডার আয়োজন বা চট্টগ্রামে ভূমিধ্বসে মানুষের জন্য সাহায্য তোলা কিংবা ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনের গ্রেফতারের প্রতিবাদে আন্দোলন করা, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পাকিস্তানে যাবে না এরকম অনেকগুলি ইভেন্ট যার কিছু কিছু মনেও নেই। শত্রু বাড়তে থাকে। মোবাইল নাম্বার ওপেন ছিলো ব্লগে তাই কল করে হুমকি ধমকি দিতো কিছু মানুষ। ব্লগে পোস্ট দেয়া হতো সরকার চেঞ্জ হলে কোন দশজন ব্লগারের লাশ পড়বে। আমার নাম থাকতো সেসব লিস্টে। আমরা পাত্তা দিতাম না। কারণ ব্লগের লেখালেখির কারণে ব্লগার খুন হবে এটা ছিলো এক ধরনের হাস্যকর চিন্তা তখন।

সেই হাস্যকর চিন্তাটাই সত্যি হয়ে দেখা দেয় ২০১৩-র ১৪ই ফেব্রুয়ারি। আমার খুব কাছের একজন মানুষ, একজন ব্লগার থাবাবাবা কে হত্যা করা হয় কুপিয়ে তাঁর বাসার সামনে। গণজাগরণ মঞ্চের প্রথম সারির একজন হওয়ার কারণে ফেসবুক, মোবাইলে তখন হুমকি ছিলো নিত্যদিনের উপসঙ্গ। এই হত্যার পর সে হুমকি আরো বেড়ে যায়। কিন্তু গা করতাম না কারণ তখন সরকারের পুলিশি নিরাপত্তা সার্বক্ষণিক ছিলো মঞ্চের সংগঠক হিসেবে। অবস্থা নাজুক হয় হেফাজত ঢাকায় সমাবেশের ঘোষণা দেয়ার পর থেকে। কোন কোন ছাত্রসংগঠনের নেতারা আমাদের মঞ্চে দাঁড়াতে দিতে চাইতেন না ব্লগার বলে। গালাগালি করা হতো। মনে আছে রায়েরবাজার সমাবেশের দিন আমাকে বলা হয় “লাথি মেরে সব ব্লগারদের মঞ্চ থেকে ফেলে দেবো, শালা নাস্তিক!”

আন্দোলনের স্বার্থে শুনেও না শোনার ভান করে সরে গেছি। এর মাঝে আমার পরিচিত ও কাছের চারজন ব্লগারকে গ্রেফতার করে সরকার। এই চারজনের ভেতর একজন আমার ব্যাপারে কিছু নাস্তিকতার প্রমাণাদি হস্তান্তর করে ডিবি পুলিশের কাছে। আমি তাকে দোষ দেই না, সে ভীত হয়ে এই কাজটি করেছিলো। তারপর শুরু হয় জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যাচার। আমাকে বলে আমাদের হাতে সব আছে, আপনাকেও গ্রেফতার করা হবে। এর মাঝে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে পৌঁছে দেয়া হয় ৮৪ ব্লগারের লিস্ট, যার ভেতর আমার নাম উল্লেখ করা ছিলো। এর মাঝে একবার শাহবাগ থেকে টিএসসির দিকে যাবার পথে ভিড়ের ভেতর গান পাউডার মেরে আমার গায়ের চাদরে আগুন ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করে, সাথে থাকা সহযোদ্ধারা সাথে সাথে সেটা নিভিয়ে ফেলে। কিন্তু ধরতে পারেনি ভিড়ের কারণে অপরাধীকে।

ফেসবুকে একটা লেখা লিখতে পারতাম না, জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা অফিস থেকে কল চলে আসতো। বলতো এইটা ঠিক লিখেছেন, ঐটা ঠিক লেখেননি, মুছে ফেলুন। এর ভেতর কয়েকশ লিস্ট প্রচারিত হয় নামী অনামী খ্যাত-অখ্যাত পত্রিকাগুলিতে, যার বেশিরভাগই ভুয়া। আমাদের কয়েকজন সহযোদ্ধা নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করবার জন্য নিজের নাম আরো প্রাসঙ্গিক বিশ-ত্রিশটা নামের সাথে ঢুকিয়ে দিয়ে পত্রিকাগুলিতে পাঠাতো। একবার একজন সহযোদ্ধা ধরাও খেয়ে গেছিলো, তাকে তেমন কিছু বলিনি আমরা।
 
আমার জন্য সবচেয়ে ভীতিকর দিনটি ছিলো ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁও রোডমার্চের দিনটি। বাস বগুড়ার শেরপুর পৌঁছানোর একটু আগে আমাদের সিট লক্ষ্য করে বোম ছুঁড়ে মারে। বোমটি লাগে আমি যেখানে বসে ছিলাম সেই জানালার ঠিক নিচে বাসের গায়ে। বাসের গায়ে প্রায় গর্ত হয়ে যায়। শেরপুর পার হবার পর চারপাশ থেকে আক্ষরিক অর্থেই বৃষ্টির মতো বোম ছুড়ে মারা হচ্ছিলো ও গুলি করা হচ্ছিলো। সামনের বাসটিতে পেট্রল বোমা ছুড়ে মেরেছিলো, কোন একটা কারণে আগুন ধরেনি। আগুন ধরলে বাসের একজনও মনে হয় বাঁচতো না।

এর মাঝে আমাকে উপস্থিত করা হয় এমন একটি মিটিং এ যে মিটিং থেকে পরিকল্পনা হচ্ছিলো কিভাবে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যায়। সেখানে বসেই আমি সিদ্ধান্ত নেই আমি আদার ব্যাপারী আদার দোকানে ফেরত যাই। সশস্ত্র বাহিনীর যার যার নাম শুনেছিলাম সেই মিটিং এ বসে তারপর আমার ভেতর ভয় ঢুকে যায় আমি যদি এই ষড়যন্ত্রের সাথে থাকতে না চাই, তাহলে হয়তো পরিবার সহ আমাকে গুম করে ফেলা হবে। আমার মা অসুস্থ, আমার শরীর খারাপ এরকম বিভিন্ন অজুহাতে আমি আস্তে ধীরে সরে আসি সেই অবস্থান থেকে। দেশ ছাড়ার আগেরদিন পর্যন্ত আমার ভয় ছিলো হয়তো আমাকে খুন করে ফেলে রেখে জামায়াত শিবির বা আনসারুল্লাহর নামে একটা প্রেস রিলিজ দেয়া হবে। এবং সেটা করবে আমাদের পক্ষেরই মানুষেরা।
হুমকি ধমকি আরো তীব্র হয় গোলাম আজমের লাশে জুতা মারার পর। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসতে পেরেছিলাম সেদিন আমার সহযোদ্ধাদের ও পুলিশের কারণে। জুতা মারার পর হাঁটতে হাঁটতে ফিরে আসছি যখন পেছন থেকে দৌড়ে এসে জামাত-শিবির লাথি মারে আমাকে, ছিটকে গিয়ে পুলিশে গায়ের ওপর পড়ি। তখন ধরেই নিয়েছি মারা যাচ্ছি আমি। কারণ তখন ওখানে জামাত-শিবিরের কর্মী কয়েক হাজার। মরে যাবার আগে কয়েকটারে নিয়ে মরার ইচ্ছে থাকায় ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম, পেছন থেকে শাওন আপা, রুসমত ভাই ও কানিজ আপা টেনে হিঁচড়ে না নিয়ে আসলে এবছর পঁচিশে অক্টোবর আমার স্মরণে শোকসভা করতে হইতো।

প্রায় প্রতিদিন ফোনে হুমকি দিতো, ফেসবুকের আদার বক্স ভরে গেছিলো গালি ও খুন করে ফেলার হুমকির স্রোতে। একটা জিডি করেছিলাম তখন স্থানীয় থানায়। সেই জিডির কোন তদন্ত আজ পর্যন্ত হয়নি।

অভিজিৎদাকে মেরে ফেলার পর খুব রাগ হয়েছিলো। অনেকে আমাকে বলেছিলো চলেন ওদের খুন করি। চাইলে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড টিম তৈরি করা ব্যাপার ছিলো না। কিন্তু ভাবতাম কাকে হত্যা করবো? আমি তো নিশ্চিত নই কে আমার ভাইদের হত্যা করছে। সেসময় ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা আপা আমাকে নক করে বলেন আপনি দেশের বাইরে চলে আসেন। আমি রাজি হইনি। আমি বলেছি আপা আমি কোথাও এসাইলাম নিবো না। সাময়িক এক বা দুইমাসের জন্য যদি অবস্থা খুব খারাপ হয় তাহলে বাইরে যেতে পারি। কিন্তু চিরতরে আমি দেশ ছাড়বো না। আপা খুব ক্ষেপে গেছিলেন। তবু বলেছিলেন, কখনো যদি চলে আসতে চান বাঁধন, আমাকে জানাবেন।

ওয়াশিকুর বাবুকে খুন করার পর অক্ষম ক্রোধে কেঁদেছি। আমার মনে আছে তামান্না সেতু আপু আমারে ফোন করে বললেন বাবুর লাশটা ঢাকা মেডিকেলের মর্গে পড়ে আছে, কেউ নেই ওখানে, তুই একটু যাবি? আমি উনাকে বললাম আমি কাউকে পাঠাচ্ছি। কাকে যেন ফোন করে যেতে বলে আমি ঘরে বসে থরথর করে কাঁপছিলাম রাগে। অনন্ত বিজয় হত্যার পর আমি বাইরে যাওয়া প্রায় একদম বন্ধ করে দেই। প্রান্ত ভাই দয়া করে উনার অফিসে কাজ করানোর নাম করে মাসে মাসে টাকা দিচ্ছিলেন। আমার অফিসে যাওয়া লাগবে কিনা জিজ্ঞাসা করতে উনি বলেছিলেন ধরেন বঙ্গবন্ধুর কি রেগুলার অফিস করতেন? আমি উনার উপর খুব বিরক্ত হয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর কথা ওভাবে তোলায়। উনার সাথে রাগারাগি করে সে চাকরিটাও যায় আমার।

এদিকে আমার বৌ যেখানে চাকরি করে সেখানে প্রজেক্ট শেষ হচ্ছে পরের মাসে। আমি বেরুতে পারছিনা খুন হয়ে যাওয়ার ভয়ে। এরে কল দিয়ে ওরে কল দিয়ে বৌর জন্য একটা চাকরির কথা বলি, সবাই ঘোরায়। অসহায় বন্দী জীবনের ডিপ্রেশনে খাওয়া বেড়ে যায়। যাদের কাছে টাকা পাই, তারা টাকা ফেরত দেয় না। পুলিশ গভীর রাতে এসে ডেকে তোলে বেঁচে আছি কিনা দেখার জন্য। অসহায় অবস্থায় প্রান্ত ভাইরে আবার বলি আমার বৌর জন্য একটা চাকরী দেখে দেন, নইলে আমাকে ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। উনি প্রথমে একটা ব্যাংকের কথা বললেও পরে দেখি অন্য একটা অফিসের নাম করে নিজের অফিসেই একটা চাকরি দিছেন।

এর মাঝে নিলয় নীল খুন হয়ে যায়।  এর আগের হত্যাকাণ্ডগুলি রাস্তায় হলেও এবার ঘরে ঢুকে মেরে ফেলা হয়। আমি তখন কয়েকজন ছোটভাইকে ডেকে এক ধরনের প্রতিরোধ কমিটি করার কথা ভাবি। এর মাঝে আমাকে এক সাংবাদিক বড় ভাই, যিনি জাহানারা ইমামের সময়ে আন্দোলনে ছিলেন, ডেকে অনুসরণকারীদেরকে অনুসরণ ও নিষ্ক্রিয় করার কথা বলেন। প্রস্তাবটা আমার পছন্দ হয়। আমি বেশ কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করে পরিকল্পনাটি বলি। তারা সবাই রাজি হয়। দুইটি মিটিং ও করা হয়। এর ৩/৪ দিনের মধ্যেই আমাকে ফলো করা শুরু হয়।

আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই। আমার মনে আছে নিলয়কে হত্যার মাস দুয়েক আগে ফলো করা হয়েছিলো। এদিকে আমি শিওর না আমার উদ্যোগের কারণে কোন লিকেজের মাধ্যমে এই কথা ওদের কানে পৌঁছানোর জন্যই কি এই ফলো করা শুরু কিনা। সেজন্য ঐ একই উদ্যোগ নিজের জন্য খাটাতে পারছিনা। এদিকে পুলিশকেও বিশ্বাস করিনা। কারণ পুলিশের কোন আগ্রহ নেই আবার পুলিশের কান বেয়ে ওদের কানে পৌঁছে যাবে কিনা কথা তাও জানিনা। গলির মুখে সার্বক্ষণিক মৃত্যুদূত। সামনের চায়ের দোকানে গেলেও সাথে পাঁচ- ছয়জন বন্ধু নিয়ে যাই। একবার ভয় পেয়ে বন্ধুরা নিজেরাই আমাকে ঘরে পাঠিয়ে দেয়। কারণ যেখানে কোন গাড়ি দাঁড়ায় না, সেখানে হুট করে প্রাইভেট কার থেকে কয়েকজন নেমে আমাকে খেয়াল করছিলো, তাদের সবার প্যান্ট ছিলো টাখনুর উপরে ও একজনের হাতে ব্যাগ ছিলো।

আমি স্নিগ্ধা আপাকে বলি আপা আমার খুব দ্রুত দেশের বাইরে যেতে হবে। এবং সেটা আজকে হলে আজকেই। আপা আমাকে বেশ কিছু মেইল এড্রেস দেন আর কিছু ফর্ম দেন ফিলাপ করার জন্য। নিজে তাড়া দিয়ে দিয়ে আমাকে মেইল করাইছেন প্রত্যেকটা জায়গায়। আমি যখন প্রায় হতাশ ও ভয়ে আতংকে কুঁকড়ে আছি, তখন আশেপাশের কোন একটা দেশে (সঙ্গত কারণে নাম বলছি না) সপ্তাহ-খানেকের জন্য যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। সেখানে যাবার পর যে অর্গানাইজেশনের সহযোগিতায় গেছিলাম তাঁরা বললো তোমার ঝুঁকি বেশি, এখানে ব্লগার আছে আরো বেশ কয়েকজন, তোমার এখানে থাকা ঠিক হবে না। আমার আসিফ মহিউদ্দীনের সাথে সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিলো না। আপা অনুরোধ করায় তাঁর সাথে যোগাযোগ করেও কথা বললাম বাইরে অন্য কোন দেশে যাওয়ার ব্যাপারে ও লজিস্টিকস সাপোর্ট কোন সংগঠন থেকে নেয়া যায় কিনা সে ব্যাপারে। উনিও হেল্প করলেন যথাসাধ্য। ফান্ডের ব্যাপারে একটা সংগঠনে নিজের রেফারেন্সে সরাসরি কথাও বলেছেন। কিন্তু কোন ইন্টারন্যাশনাল সংগঠন তেমন ভাবে রেসপন্স করছিলো না। আমি তারপর তসলিমা নাসরিন আপারে বললাম। উনি দু জায়গায় উনারে রেফারেন্সে কথা বলতে বললেন। এর কয়েকদিনের ভেতরেই পজিটিভ রেসপন্স আসলো।

আমি তখন আরেক দেশে। এর ভেতরেই জার্মানির একটা বিখ্যাত সংগঠন আমাকে মেইল দিয়েছে আমি তাদের ওখানে স্কলারশিপের জন্য এপ্লাই করেছি, তারা আমাকে স্কলারশিপ দিতে চায়, আমি যেতে আগ্রহী কিনা। আমি সাথে সাথে স্নিগ্ধা আপাকে কল দিলাম। কারণ আপাই আমাকে বলেছিলো সেখানে এপ্লাই করবার জন্য। আমরা সবাই খুব খুশি, আবার ভয়ও লাগছে, কারণ জার্মানি যেতে হলে আমাকে আবার দেশে ফিরে ভিসা এপ্লাই করতে হবে। এর ভেতর যদি বাইচান্স কিছু হয়ে যায়?

আমি ভিসার ডেট পেয়েছি ২০ দিন পর। এর ভেতর বাড়ি গিয়ে বসে আছি। বিয়ে করেছি কাজী অফিসে, কোন ছবি নেই, ছবির জন্য এখন আবার বিয়ের আয়োজন করা লাগবে। কাউকে কিচ্ছু বলছি না। জানে শুধু আমার আব্বু আম্মু আর আমার শ্বশুর। এদিকে শ্বশুর বাড়ির এলাকা হইলো জামাতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলামের এলাকা। যাওয়ার আগে ডিবিতে ফোন দিয়ে হেল্প চাইলাম। কিছু কথা শুনাইলেও হেল্প করেছে তারা। এক গাড়ি পুলিশ পাঠিয়ে দিয়েছিলো শ্বশুরবাড়ি। গেছি এক রাস্তা দিয়ে, ফিরেছি আরেক রাস্তা দিয়ে। যে মাইক্রোতে উঠেছিলাম, রাস্তায় পাম্পে দাঁড়িয়ে মাইক্রো চেঞ্জ করে নিয়েছি। রাস্তায় মাইক্রো নষ্ট হলো, বাসায় ফিরলাম গভীর রাতে।  পরদিন খবর এলো দীপনদাকে খুন করা হয়েছে, টুটুল ভাই, রণদীপমদা ও তারেক রহিমকে কুপিয়ে ও গুলি করে রেখে গেছে।

তিনদিন পর জার্মান এ্যামবেসি থেকে মেইল এসেছে থার্ড সেক্রেটারি নিজে আমার সাথে দেখা করবেন ও ভিসার কাগজপত্র গ্রহণ করবেন, ডিউ ডেটের আগেই। দেশের বাড়ি থেকে মেইল পাওয়ার সাথে সাথে ঢাকা। পরদিন এ্যামবেসীতে গেলে ভদ্রলোক আমাকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও যাবতীয় কাগজ পত্র নিলেন। উনি বললেন সম্ভব হলে আমরা এক ঘণ্টার ভেতরই আপনাকে ভিসা দিতাম, কিন্তু আজ বৃহস্পতিবার, সময়ও চারটা। আমি কোন কথা দিতে পারছি না। তবে ভিসা হয়ে গেলে আমি নিজেই আপনাকে মেসেজ দিবো মোবাইলে। আপনার রিস্ক নিয়ে আসার দরকার নেই। প্লেনে উঠতে যাবার সময় শুধু এ্যামবেসীর গেটে গাড়ি দাঁড় করিয়ে পাসপোর্ট দুইটা এনভেলাপে থাকবে, নিয়ে সোজা এয়ারপোর্টে যাবেন। উনি এটাও জিজ্ঞাসা করলেন এয়ারপোর্টে যাবার মতো সেফ ভেহিকেল আছে কিনা। আমি ভদ্রলোকের ব্যবহারে খুবই চমৎকৃত।

আমার মনে একটি অপরাধবোধ আছে। যে যুদ্ধটা আমরা করছিলাম, সে যুদ্ধটা ছেড়ে চলে আসার অপরাধবোধ। কিন্তু এ কেমন যুদ্ধ? ছায়ার সাথে মানুষ কিভাবে যুদ্ধ করে? যদি সরাসরি কোন যুদ্ধ লাগে আমার বাংলাদেশে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষগুলির সাথে বিপক্ষের মানুষের, প্রগতিশীলতার সাথে অন্ধত্ববাদের, আমাকে অস্ত্র হাতে সবার সামনে দেখবেন। কিন্তু অন্ধকারে পেছন থেকে ছুরি খাবার মধ্যে কোন মহত্ব নেই। যারা চাইছিলেন আমি দেশে থেকে যেন মারা যাই, তাঁদের বলতে চাই, আপনাদের চাওয়াটা পূরণ হবে না। আমি বেঁচে থাকবো, আমার করার আছে অনেক কিছু। সব শেষ না করে মরে গেলে তো হবেনা।

তারমানে কি আমার জীবনের প্রতি বা বেঁচে থাকার প্রতি খুব লোভ বা আগ্রহ? নাহ্, তাহলে বার বার মৃত্যুর মুখোমুখি হতাম না। আমার হাতের ওপর যেদিন বোমা ফেটেছিল সেদিন মারা যেতে পারতাম, যেদিন গান পাউডার ছিটিয়ে গায়ে আগুন ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলো সেদিন মারা যেতে পারতাম, বোমাটা বাসের গায়ে না লেগে আমার গায়ে লাগলে মারা যেতে পারতাম। গোলাম আযমের লাশে যখন জুতাটা ছুড়ে মারছিলাম, তখনো জানতাম নিজের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করছি। যেদিন মরে যাবো সেদিন তো মরবোই, তার আগে বেঁচে থেকে যদি জামায়াত-শিবির-মৌলবাদীদের ভিত্তিমূলে আঘাত করে যেতে পারি, তাতেই আমার বেঁচে থাকার সার্থকতা, তাতেই এ জীবন ধন্য!

আমরা ব্লগার, আমাদের তো রাস্তায় নামার কথা ছিলোনা। কথা ছিলো আমরা লিখবো, আমাদের লেখার ধারে সমাজ থেকে ঝরে পড়বে চর্বি, ক্লেদ। সময়ের প্রয়োজনে রাস্তায় নেমেছিলাম, দরকার হলে আবার নামবো। কিন্তু আমাদের মূল কাজ যেটি, তাকে তো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের আরো বেশি করে লিখতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের দায়িত্ব আরেকটু বেশি। আমার যে বন্ধুটিকে খুন করা হয়েছে আমার ঘাড়ে তাঁর লেখাটি লিখবার দায় আছে। আগে যদি আমি তাঁর মতো করে নাও লিখে থাকি, এখন আমার দায় তার মতো করে লেখার। ওরা চায় আমাদের কীবোর্ড থেমে যাক। আমরা যেন গুটিয়ে যাই সময়ের শামুকে। কিন্তু এখনই আমাদের বেশি করে লিখবার সময়। নিজের লেখাটিও লিখতে হবে, আমার মৃত বন্ধুর লেখাটিও লিখতে হবে। নইলে জয় হবে অন্ধকারের, জয় হবে মৌলবাদের, হিংস্র ধর্মের।

পুনশ্চঃ নিজ দেশে থেকে কোথাও এসাইলামের জন্য আবেদন করা যায় বলে আমার জানা নেই। যারা এই কথাগুলি বলে, তারা মিথ্যেবাদী।
।। মাহমুদুল হক মুন্সী'র ব্যক্তিগত ব্লগ "স্বপ্নকথক" ।।

মাহমুদুল হক মুন্সী, ব্লগার, অনলাইন এক্টিভিস্ট ও সংগঠক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ