আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

মুক্তিযুদ্ধে তিব্বতি যোদ্ধাদের ভুলে যাওয়া বীরত্বের ইতিহাস

রাজেশ পাল  

বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব পার্বত্য অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের শেষের তিন মাস এক ভয়ংকর মরণজয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বি.এল.এফ পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার শেখ ফজলুল হক মণির একান্ত উদ্যোগে তিব্বতের নির্বাসিত আধ্যাত্মিক নেতা দালাইলামার অনুসারিদের পাহাড়ি দুর্গম এলাকার গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এক ডিভিশন চৌকস যোদ্ধা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অংশ নেয়। এরা মূলত: তিব্বত মুক্তি সংগ্রামের পিৎজা বাহিনী নামে খ্যাত। যাদের সামগ্রিক নেতৃত্বে ছিলেন ভারতের অন্যতম গেরিলা যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল সুজন সিং ওভান  এবং পাহাড়ি গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত একঝাক চৌকস সামরিক অফিসার। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ যাদেরকে গুর্খা সৈন্য সমন্বয়ে মাউন্ট ডিভিশন বলে মনে করেছে। এরা পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি কলাম করে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান অভিমুখে অভিযান শুরু করে প্রথম সপ্তাহে। উদ্দেশ্য ৭১ এর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশের বৃহত্তম সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রাম দখল করে মুক্তাঞ্চল গঠন করা।

চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে রাজাকার বাহিনী।পাকিস্তানের এই অকৃত্রিম বন্ধু সর্বতোভাবে সহায়তা করেন পাকবাহিনীকে।তারই আমন্ত্রণে ও ছত্রছায়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে পাকবাহিনী।এদের সাথে যোগ দেয় মিজোরামের বিদ্রোহী মিজোরা।মিজোরা তখন আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত।ফলে শত্রুর শত্রুকে বন্ধু বিবেচনায় তারা পাকিস্তানের পক্ষ নেয় আর সরাসরি তাদের পক্ষে লড়াইয়ে অংশ নিতে আসে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে তখন অবস্থান করছিল স্বতন্ত্র (ইন্ডিপেন্ডেন্ট) ৯৭ ব্রিগেড এবং পাকিস্তানী এলিট ফোর্স স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের থার্ড কমান্ডো ইউনিট। আর তাদের সহযোগী হিসেবে ছিলো ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের (ইপক্যাফ) চাকমা সদস্যরা এবং একটি মিজো ব্রিগেড। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করার অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার (অব:) জহিরুল আলম খান। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে কুমিল্লায় অবস্থানরত টু এসএসজি কমান্ডো ইউনিটের নেতৃত্ব ছিলো তার হাতেই। এপ্রিলের শুরুতে কাপ্তাই ড্যামের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নিয়ে রাঙামাটি যান তিনি। রাঙামাটি পৌঁছেই চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের আনুগত্য আদায় করেন জহির। একইসময় সীমান্তের ওপারের মিজোরাম থেকে লালডেঙ্গার অনুগত বিদ্রোহী মিজোরা যোগাযোগ করে তার সঙ্গে। ৩ হাজার সাধারণ মিজোর জন্য প্রতিদিন একটন এবং যোদ্ধাদের জন্য মাথা পিছু এক পাউন্ড চালের বিনিময়ে তাদের সঙ্গে সহায়তার চুক্তিতে আসেন জহির। ৬০০ সশস্ত্র যোদ্ধার তিনটি ব্যাটেলিয়ন যোগ দেয় পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে। মহালছড়ি, মানিকছড়ি ও ফটিকছড়ি এলাকায় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা দমন এবং সীমান্তরক্ষার জন্য এসএসজি কমান্ডোদের সঙ্গে এসব মিজো ব্যাটেলিয়নকে কাজে লাগান জহির।

১৯৫৯ সালে তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাইলামা নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে সদলবলে ভারতে আশ্রয় নেন। নিজ দেশের স্বাধীনতার জন্য উদগ্রীব এই তিব্বতিদের নিয়ে গঠন করা হয় SFF. ১৯৬২ সালের ১৪ নভেম্বর এই বিশেষ বাহিনীটির জন্ম। সে বছরই চীন ও ভারতের মধ্যে এক সীমান্তযুদ্ধ হয়। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা'র (রিসার্চ এন্ড এনালিসিস উইং) সেদেশে আশ্রয় নেওয়া তিব্বতিদের নিয়ে গঠন করে এই প্যারামিলিটারি ইউনিটটি। সিআইএর সরাসরি তত্বাবধানে ও আর্থিক সহায়তা নিয়ে এসএফএফ চীনা সীমান্তে তাদের তৎপরতা চালাতে থাকে। দেরাদুনের অদূরে তিব্বতি উদ্বাস্তুদের শহর চাক্রাতায় গড়ে ওঠে এর সদর দপ্তর। সীমান্ত প্রহরার পাশাপাশি তিব্বত থেকে ‘বিশেষ লোকজন’ ভারতে নিরাপদে নিয়ে আসা, গোয়েন্দা তৎপরতা এবং কম্যুনিস্ট চীনের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত চালানোর মিশনগুলোতেও তারা ছিলো বেশ সফল। র’এর প্রধান আরএন কাও এবং মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান ছিলেন এসএসএফের দায়িত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ কমান্ডের অধীনে নয় এসএফএফ, যার আরেকটি নাম হচ্ছে এস্টাবলিশমেন্ট টুয়েন্টিটু (উবানের সম্মানে, তিনি ব্রিটিশ ভারতে ২২ মাউন্টেন ব্রিগেডের কিংবদন্তী)। তাদের প্যারাট্রুপিং থেকে শুরু করে কঠোর কমান্ডো ট্রেনিং দেওয়া হয়। হিমালয়ের ওই উচ্চতায়, হিমাংকের নীচে তাপমাত্রায় এবং জঙ্গলের শিকড়পাতা খেয়ে লড়ার শিক্ষায় শিক্ষিত তারা। সুবাদেই গারুদ ও প্যারা কমান্ডোর মতো হাতে গোনা কয়েকটি স্পেশাল ফোর্সের মধ্যে কার্যকারিতা ও দক্ষতায় উপর দিকেই এদের অবস্থান। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এসএফএফ-এর অস্তিত্ব স্বীকার করে না! এর সদস্য নারী ও পুরুষরা অবসরের পর গোপন যাপনে চলে যান। প্রকাশ্যে থাকেন শুধুমাত্র দালাইলামার দেহরক্ষীর দায়িত্বে থাকারাই।

১৯৭১ সালে মেজর জেনারেল উবান যখন মুক্তিবাহিনী (পরে মুজিব বাহিনীর) বিশেষ প্রশিক্ষক হয়ে আসেন, তখন তার উপর একটি কঠিন দায়িত্ব বর্তায়। ‘অপারেশন ঈগল’ কোডনেমের এই মিশনটি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামকে শত্রুমুক্ত করা যাতে ভারতীয় বাহিনীর জন্য চট্টগ্রাম অভিমুখে যাত্রা সহজ হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে তখন অবস্থান করছিল স্বতন্ত্র (ইন্ডিপেন্ডেন্ট) ৯৭ ব্রিগেড এবং পাকিস্তানী এলিট ফোর্স স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের থার্ড কমান্ডো ইউনিট। আর তাদের সহযোগী হিসেবে ছিলো ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের (ইপক্যাফ) চাকমা সদস্যরা এবং একটি মিজো ব্রিগেড। নভেম্বরে লড়াইয়ে নামে এসএফএফ। (special frontier force )। এই SFF অবশ্য কখনো তাদের জাতশত্রু চীনের রেড আর্মির বিরুদ্ধে কোনো অপারেশনে জড়ায় নি। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এই বাহিনীকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ইস্টার্ণ ফ্রন্টে অত্যন্ত সফলভাবে ব্যবহার করা হয়। অক্টোবরের শেষে এবং নভেম্বরের শুরুর দিকে ফোর্সের ৩,০০০ সদস্যের এক বিগ্রেডকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিজোরামে পাঠানো হয় টাস্কফোর্স হিসেবে। পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসরমান ভারতীয় বাহিনীকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে এবং তৎকালীন ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ অনুরোধেই মূলতঃ SFF-কে নিয়ে আসা হয় সেখানে।মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ করে ‘অপারেশন মাউন্টেইন ঈগল’-এ তাদের সম্পৃক্ত করার জন্য রীতিমতো আবেদন করে একটি চিঠি লিখেছিলেন তখনকার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তাতে বলা হয় :

“We cannot compel you to fight a war for us,” Gandhi wrote, “but the fact is that General A A K Niazi [the Pakistan Army commander in East Pakistan] is treating the people of East Pakistan very badly. India has to do something about it. In a way, it is similar to the way the Chinese are treating the Tibetans in Tibet, we are facing a similar situation. It would be appreciated if you could help us fight the war for liberating the people of Bangladesh. (আমাদের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য আমরা আপনাদের বাধ্য করতে পারি না। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের ওপর জেনারেল নিয়াজী ভীষণ অত্যাচার চালাচ্ছেন। ভারতের জন্য এ ব্যাপারে কিছু করা জরুরী হয়ে পড়েছে। একদিক থেকে তিব্বতে তিব্বতীদের ওপর চীনাদের জুলুমের সঙ্গে ঘটনাটার মিল আছে, আমরা একই পরিস্থিতির মুখোমুখি। আমরা খুশী হবো বাংলাদেশের জনগণকে স্বাধীন করার এই লড়াইয়ে আপনাদের যদি পাশে পাই)।

এই বাহিনীর গঠন সম্পর্কে অমি রহমান পিয়াল লিখেছেন “ইন্দো-চীন যুদ্ধের পর এবং ১৯৬২ সালের শেষের দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর 'রিসার্চ এন্ড এ্যানালাইসিস উইং' (RAW)-এর জোর প্রচেষ্টা ও লবীর কারণে তৎকালীন নেহেরু সরকারের নির্দেশে গঠন করা হয় এলিট কমান্ডো ইউনিট যার প্রাথমিক গোড়াপত্তন হয়েছিল তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা'র সাথে সে দেশে পালিয়ে আসা যোদ্ধাদেরকে নিয়ে। চুসি গ্যাংদ্রাগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে খামপাসদের রিক্রুটের ভেতর দিয়ে এই নয়া ইউনিটের জন্ম। নেতারা ওই উন্নয়নমুখি প্রস্তাবে খুব দ্রুতই সাড়া দেন এবং সম্মতি জ্ঞাপন করেন এবং পরবর্তীতে ইউনিটের কার্যক্রম ও সাজ-সরঞ্জাম দেখে এও আশা প্রকাশ করেন যে, ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে তিব্বতের স্বাধীনতা যুদ্ধে অর্থাৎ নিজের কাজেই লাগানো যাবে। এব্যাপারে 'ইন্ডিয়ান এক্সটারনাল ইন্টেলিজেন্ট সার্ভিস'(RAW), 'সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (CIA)', এবং 'চুসি গ্যাংদ্রাগ'-এর মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। তিব্বতের তিনজন টপ লিডারের মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত ও ভারতে প্রবাসী দু'জন যথাক্রমে জেনারেল গনপো তাশি ও জাগো নামগিয়াল দর্জি যারা আগে থেকেই ভারতে মুসতাংভিত্তিক একটি গেরিলা বাহিনীর সদস্য সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত ছিলেন, এরাই পরে চুসি গ্যাংদ্রাগ-এর পক্ষে বাহিনীর সর্বময় দায়দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৫,০০০ সদস্য বিশিষ্ট এই পাহাড়ী গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ দেয়া হয় দেহরাদুন-এ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও RAW-এর সরাসরি অপারেশনাল কমান্ডের অধীনে গঠিত হয় এই 'স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স' (SFF), চীনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হুমকি মোকাবেলার কাজে এটি প্রথম সমবেত গোপন ইন্টেলিজেন্স ও কমান্ডো হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই বাহিনীর প্রাথমিক প্রশিক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন CIA-এর প্যারামিলিটারি অফিসাররা এবং ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (IB)-এর নিজস্ব স্পেশাল অপারেশন্স ইউনিট - স্পেশাল সার্ভিস ব্যুরো (SSB)। দু'বছরের প্রশিক্ষণ শেষে এই SFF বাহিনীকে পরিপুর্ণ প্রশিক্ষিত এয়ারবোর্ণ বাহিনী হিসেবে নিবেদিত মাউন্টেইন ও জাঙ্গল ওয়ারফেয়ার ইউনিট হিসেবে প্রতিস্থাপন করা হয়। SFF-এর আরো বেশি সুখ্যাতি ছড়ায় যখন এর প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব পড়ে "এস্টাবিলিশমেন্ট ২২" এর ওপর, কেননা এর ইন্সপেক্টর জেনারেল ছিলেন মেজর জেনারেল সুজন সিং, ব্রিটিশ আর্মির লিজেন্ডারি ফিগার মিলিটারি ক্রস প্রাপ্ত, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে ২২তম মাউন্টেইন রেজিমেন্ট'র কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন, আরো ছিলেন আফ্রিকায় লং রেঞ্জ ডিজার্ট স্কোয়াড্রনেরও সেনাপতি”।

এই ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন ব্রিটিশ আর্মিতে বীরত্বের খেতাব প্রাপ্ত মেজর জেনারেল সুজন সিং। যার পদমর্যাদা ছিলো inspector general. ব্রিটিশ আর্মির লিজেন্ডারি ফিগার মিলিটারি ক্রস প্রাপ্ত, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে ২২তম মাউন্টেইন রেজিমেন্ট'র কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন, আরো ছিলেন আফ্রিকায় লং রেঞ্জ ডিজার্ট স্কোয়াড্রনেরও সেনাপতি। এই বিশেষ বাহিনীর ৫০০০ সদস্য ভারতের দেরাদুনে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হন।

সেই সময়ে ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যের বিদ্রোহী মিজোবাহিনীকে পাকিস্তান পূর্ণ সহায়তা করছিল। মূলত তাদের দমনের লক্ষ্য নিয়েই এই বিশেষ বাহিনীর সৃষ্টি।৭১এর মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে এই বাহিনীর ৩০০০ সদস্য মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর পাশাপাশি সম্মুখ সমরে অংশ নেন। জন্ম নেয় এক দুঃসাহসিক অভিযানের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।নাম দেয়া হয় OPERATION MOUNTAIN EAGLE.

সীমান্তে প্রায় ৩ সপ্তাহের তীব্র লড়াই শেষে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে তারা পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করে এবং বেশ কয়েকটি বীরত্বপূর্ণ অপারেশনে অংশ নেন।অক্টোবরের শেষদিকে মিজোরাম সীমান্তের ডিমাগিরিতে জড়ো করা হয় তিন হাজার এসএফএফ কমান্ডোকে। ১৯টি নৌকায় করে শুরু হয় বৈরী দেশে অনুপ্রবেশের এই অভিযান। দীপন (তিব্বতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) গিয়াতসু ধন্দুপের নেতৃত্বে ৬টি ব্যাটেলিয়ন তিনটি কলামে প্রবেশ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে। পাকিস্তান বাহিনীর ৯৭ ব্রিগেড ও দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়ন মার খেয়ে বার্মা পালিয়ে যেতে চাইলে এরা বীরত্বের সাথে তাদের প্রতিহত করে।

সুজন সিং চেয়েছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম বিজয় কেতন তারাই ওড়াবেন। কিন্তু পর্যাপ্ত এয়ার ও আর্টিলারি সাপোর্টের অভাবে তা আর সম্ভব হয়নি। ৯৭ স্বাধীন বিগ্রেডের একটি বৃহৎ অংশকে যেখানে যে অবস্থায় ছিল সেখানে সেভাবেই আটকে রাখে, দুর্ধর্ষ ২য় ব্যাটালিয়ন মায়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সবগুলো ডিফেন্স লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তিব্বতীয় সেনাবাহিনীর বিচারে তাদের প্রথম বিগ্রেডিয়ার জেনারেল বা First Dapon সেই যুদ্ধ SFF Task Force-এর অংশ হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্র সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সাথে তাদের চেহারা ও দৈহিক গঠনের মিল থাকায় তারা বেশ সুবিধাজনক অবস্থানেই ছিলেন। আর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতেন বুলগেরিয়ার তৈরি ak 47 এসাল্ট রাইফেল, গ্লক সেমিঅটোমেটিক পিস্তল, হান্টিং নাইফ। ফলে বোঝার উপায় ছিলো না তারা আসলে কোন দেশের যোদ্ধা।সাফল্যের ধারা ধরে রাখতে পরে অবশ্য চারটি এমআই ফোর হেলিকপ্টার বরাদ্দ পায় তারা। দুর্গম জঙ্গল আর পাহাড়ে একের পর এক পাকিস্তানী চৌকি দখলে আনে তিব্বতিরা বুনো হুঙ্কারে। ক্লাসিক গেরিলা পদ্ধতিতে শত্রুর চোখে ধুলো দিয়ে তার পেছনে গিয়ে আক্রমণ করতো এসএফএফ। তবে শুরুটা তাদের শোকাহত ছিল। কমান্ডার দীপন ধন্দুপ যুদ্ধের শুরুতেই নিহত হন শত্রুর গুলিতে।কাপ্তাই বাঁধ ধ্বংস, পার্বত্য চট্টগ্রামকে মিজোদের তৎপরতা থেকে মুক্ত এবং চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির সেই মিশন সফলভাবেই সারে এসএফএফ। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানীরা যখন আত্মসমর্পণ করছে তখন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিলো তিব্বতি এই পাহাড়ি যোদ্ধারা। এর আগে দোহাজারী ব্রিজ ধ্বংস ও দখল করে বার্মায় পাকিস্তানীদের পালানোর পথ বন্ধ করে দেয় তারা। শত্রুমুক্ত চট্টগ্রামে প্রটোকল ভেঙ্গেই কুচকাওয়াজ করে এসএফএফ। এরপর তাদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এর আগে ১৮ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামে তারা বন্দী করে ১ হাজার মিজো সেনা।

এদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর ৫৬ জন সদস্য শহীদ হন। আহত হন ১৯০ জন। স্বাধীনতার পরে ভারত সরকার তাদের ৫৮০ জনকে আর্থিক পুরষ্কারে ভূষিত করেন। কিন্তু কোন প্রকার বীরত্বের খেতাব প্রদান করেন নি। কেননা operation mountain eagle ছিলো একটি covert অপারেশন। এ ধরনের গোপন সামরিক অভিযান গুলোর সফলতা বা ব্যর্থতা প্রকাশ্যে আনার নিয়ম নেই।এমনকি উবান তার ‘ফ্যান্টমস অব চিটাগাং’ বইয়েও তেমন করে উল্লেখ করেননি।

কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একবার সেইসব কমান্ডো নেতাদের ডেকে নেন এবং এবং যুদ্ধজয়ে তাদেরকে ধন্যবাদ জানান - যা ছিল নিতান্তই বিষয়ভিত্তিক বা শ্রেণীভুক্ত, কাগজপত্রে যার কোনো উল্লেখ নেই । বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর বা তৎপরবর্তী আর কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দলই সেই তিব্বতীয় অতিথি সেনাদলের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও প্রাণবিসর্জনের বিপরীতে বিন্দুমাত্র সহমর্মিতাও প্রকাশ করেনি। এব্যাপারে একটি তিব্বতীয় ওয়েবসাইট www.tibetwrites.org লিখেছে, "The new country’s founder, Sheikh Mujibur Rahman, personally called the SFF leaders to thank them for their part in that creation. But this had been a classified mission – one that, officially, still does not exist. As such, none of the SFF fighters have ever been decorated, nor have their contributions ever been officially recognized."  এদেশের পক্ষ থেকেও তাদের কোনরূপ স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি।

বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধে অনেক বিসর্জনের ভেতর দিয়ে সেসব গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস অদ্যাবধি অকথিতই রয়ে গেছে। আমাদের জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবার মতন বিজয়দীপ্ত গৌরবের পাশাপাশি এই বেদনাদায়ক উদাসীনতা চিরকালের জন্য এক বিরাট অকৃতঘ্নতার নিদর্শন হয়ে থাকবে।স্বাধীনতার ৪ দশক পেরিয়ে গেছে , একের পর এক যুদ্ধাপরাধীদের অপকর্মের শাস্তি হচ্ছে। এদের কথা মনে রেখেছেন কয়জন?সেদিনের এই দুঃসময়ের বন্ধুদের জন্য অন্তত একটি স্মৃতি সৌধ কি আমরা তৈরী করতে পারিনা?

তথ্যসূত্র :
১. অমি রহমান পিয়ালের ব্লগ
২. The CIAs secret war in Tibet উদ্বাস্তু তিব্বতীদের ফোরাম.
৩. ব্রিগেডিয়ার (অব:) জহিরুল আলম খানের সাক্ষাতকার.
৪. মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী, সংকোলন, গুরুচণ্ডালি ডটকম।

রাজেশ পাল, আইনজীবী, ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কর্মী

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ