আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

‘ভাবা’ এবং ‘দেখা’ বিষয়ে The School of Great No’র কিছু কথা

গোঁসাই পাহ্‌লভী  

মানুষ আকাশ পাতাল ভাবে। কিন্তু আকাশ বা পাতালটা দেখে কয়জনে? ভাবনার সাথে বস্তুটাকে মিলিয়ে ‘দেখা’ খুব শক্ত কাজ। কারণ, চোখ মেলে আকাশ দেখতে গেলে, পাতাল দেখতে গেলে মানুষ খুব অনিরাপদ বোধ করে। এ কারণে, মানুষ খুব অন্তর্মুখী হয়।

চোখ খুলে আমরা যা দেখি, সেখানে আকাশ পাতাল দেখা যায় না। আকাশ দেখা কিংবা পাতাল দেখা বড় শক্ত কাজ। তাহলে ভাবা কি সহজ কাজ,দেখার থেকে? এটা ঠিক দুটো ক্রিয়ার ভেতর তুলনা করা নয়, মানুষের সামর্থ্য নিয়ে বরং প্রশ্ন করা। আমরা প্রায় ক্ষেত্রেই দেখি এমন কথা অনেকেই বলেন যে, বাস্তবটা বোঝো আগে। এর মানে বাস্তবতা খুব রূঢ়। মানুষের অনীহা আছে এতে। এই ধরনের বাস্তবতায় মানুষের অনীহা কেন? কারণ, বাস্তবতা বা মানুষ যা দেখে সেটা একটা অর্গানাইজড বিষয়। সেই সংগঠিত ঘটনার দুটো দিক।

একদিকে মানুষই ঘটনার কর্তা অন্য দিকে রয়েছে প্রকৃতির স্বতঃস্ফূর্ততা। যে অংশে মানুষই কর্তা, মানুষ সেখানে বা সেই বাস্তবতা দেখা মাত্রই অনিরাপদ মনে করে। ঘটনার অংশী হয়ে দায় নিতে ভয় পায়। ফলে ভাবনায় সে বাস্তবতার ঐসব বিষয়গুলোকে যতো সহজে অতিক্রম করতে পারে, চোখ খুলে সেটা কিছুটা হলেও অসম্ভব হয়। ‘তাহলে ভাবনায় আকাশ পাতাল দেখা’র আকাশ পাতালের সাথে কখনোই কি মিলিবে না?
 
‘আকাশ পাতাল ভাবা’ আর ‘আকাশ পাতাল দেখা’র ভেতরে ক্রিয়াগত পার্থক্যটা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। ‘ভাবা’ আর ‘দেখা’ এই দুটি ভিন্ন চরিত্রের ক্রিয়া। ‘টু থিংক to think’ এবং ‘টু সি’ to see এইভাবে ইংরেজিতে ব্যবহৃত।বাঙলায় ‘ভাবা’ এবং ‘দেখা’ দুটি ভিন্ন ক্রিয়াপদ। পদ দু’টির উৎপত্তি মানে ধাতুতেও পার্থক্য রয়েছে। ইংরেজিতেও ‘টু সি’ এবং ‘টু থিংক’ এর উৎপত্তিগত ধাতু ভিন্ন। বাঙলায় ‘দেখা’ ক্রিয়াপদটি ‘দর্শন’ পদের সমার্থক। উভয়ের উৎপত্তিগত রুটসও অভিন্ন। অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে ‘টু সি’ এবং ‘ফিলসফি’ এই দুটো পদই বাঙলায় শুধু ‘দেখা’ দিয়ে বুঝানো হয়। ইংরেজিতে ‘দেখা’র সাথে ‘ফিলসফি’র ঐ অর্থে প্রত্যক্ষ কোনও সম্পর্ক নাই।
 
এখন এই যে আমরা দেখতে পেলাম যে, ‘দেখা’ আর ‘দর্শন’ অভিন্ন, সেটা তাত্ত্বিকভাবে দেখানো গেলেও বাংলায় দেখা থেকে দর্শনকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘দর্শন বিভাগ’ লেখা হয়, ‘দেখা বিভাগ’ লেখা হয় না। কেন লেখা হয় না, কি কারণে লেখা হয় না এ বিষয়ে একটা সাইকোলজিক্যাল পাঠ করবার চেষ্টা আছে আমাদের। এখন ‘দেখা’ এবং ‘ভাবা’ এই দুটোর ব্যবহার আমাদের এখানে কেমন সে দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক।
 
সংস্কৃতে দর্শন আর লোকভাষায় দেখা।
 
বাঙলায় ‘দেখা’ শব্দটা একভাবে ব্যবহার হওয়ার থেকে দ্বৈতক্রিয়ায় ব্যবহার হয় বেশি। যেমন ধরেন ‘কাজটা করে দেখ’,‘খেয়ে দেখ’,‘ভেবে দেখ’,‘বলে দেখ’। আপাত অর্থে এগুলো নিজস্ব অর্থের সাম্পর্কিকতা হারিয়ে ভিন্ন একটি অর্থ প্রকাশ করে। যেমন ‘কাজটা করে দেখ’ উচ্চারণের পার্থক্যের উপরে ভিত্তি করে এর একটা অর্থ হতে পারে, ‘সাহস থাকলে’। অর্থাৎ ‘সাহস থাকলে কাজটা করে দেখতো’ এভাবেও হ’তে পারে। কিন্তু এই করে দেখার সাহস তো শুধু সাহসের মধ্যে দিয়ে পূর্ণভাবে উঠে আসে না। উভয়ের ভিন্ন ক্রিয়া হলেও এই যে পাশাপাশি সম্পৃক্ত হওয়া, এর কারণটা যথাযথভাবে জানতে পারলে বাঙলার ভাষা বিজ্ঞান সহ এখানকার শত্রুমিত্র-ভাব বিশদভাবে উপলব্ধি করা যাবে। ভাষাকে মাধ্যম করে উপলব্ধিগত ভাবই মানুষের ভেতর প্রবল। ফলে ভাষার চরিত্র বোঝাটাই প্রাথমিক জ্ঞানের পর্যায়।

করে দেখার মধ্য দিয়ে বাঙালি যে বৈদিক ধ্যানধারণার থেকে ভিন্ন চরিত্রের সেদিকটা নজরে আসবে। ‘দেখা’ হচ্ছে এখানকার চিন্তাভাবনায় চূড়ান্ত বিষয়। আপনি যে কর্মই করেন না কেন ‘দেখা’র জন্যেই আপনি সেটা করছেন। সে কারণে ‘ভেবে দেখছেন’, ‘শুয়ে দেখছেন’, ‘কেঁদে দেখছেন’, ‘বলে দেখছেন’, এভাবে ভিন্ন ভিন্ন ক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে কেবল দেখেই যাচ্ছেন। এই ‘দেখা’ কেবল মন্ত্রগুণে নয়, এই দেখা অধিকতর তন্ত্র নির্ভর। চোখ কান নাক অর্থাৎ ঘ্রাণ এবং কর্মান্দ্রীয়গুলো তরণ করে দেখা। তাহলে বাঙালির তন্ত্র বা দেহের ইনফিনিট সাজেশন হচ্ছে ‘দেখা’। এখানে ‘দেহ’ এবং ‘মাইন্ড’ এই দুই সত্তার নিত্যলীলা। এ লীলায় হারজিৎ নেই। একটা প্রতিযোগিতামূলক প্রতিযোগী। ফলে সাম্যের মধ্যে বহমানতা।
 
‘ভেবে দেখা’ বা এই ধরনের দ্বৈত ক্রিয়ার একটা সাম্পর্কীক অর্থায়ন দেখা যাক। ভাব শব্দটা ভব শব্দ থেকে আসছে। যার অর্থ ‘হওয়া’। তাহলে ভেবে দেখার অর্থ ‘হয়ে দেখা’। যেমন ছাত্র নয়, শিক্ষক হয়ে দেখা। দাস নয়, প্রভু হয়ে। এইসব হওয়ার মধ্যে দিয়ে কি দেখা যায়? রাজা হওয়ার মধ্যে দিয়ে একটা পার্টিকুলার জিনিস আমরা দেখতে পাই। অথবা কবি হওয়ার মধ্যে দিয়ে একটা পার্টিকুলার সত্তা। তাহলে ‘হয়ে দেখার’ মধ্যে দিয়ে মূলত আমরা একটা পার্টিকুলার কিছু দেখছি। বিশেষ কিছু যে সম্পূর্ণভাবে আলাদা? এ প্রশ্নে আমরা পার্টিকুলার কে ঠিক বিপরীত দিকে দাঁড় করিয়ে ভাবার বিষয়ে ভিন্নতা আনতে চাচ্ছি। যেমন দেখুন, পার্টিকুলারকে সামান্যের সাথে সাম্পর্কীক করে দেখা যাচ্ছে। যেমন রাজা মন্ত্রী উজির প্রজার সাথে একটা সম্পর্কিত সুতায় বাঁধা। সেটাকে নিয়মও বলা হয়। এভাবেই ‘দেখা’ একদিকে পার্টিকুলার অন্যদিকে ‘একক’। অর্থাৎ সবাই মিলে এক। যেমন হৃদয় দিয়ে দেখা। এর অর্থ হচ্ছে হৃদয় হয়ে যাওয়া। দেখারও নানান রকমের অর্থ হয়। বাঙালি শাস্ত্রের থেকে তন্ত্র দিয়েই বেশি দেখতে চেয়েছে। দেহের ওপরে আস্থা রাখাই শ্রেষ্ঠ এবাদত জ্ঞান করেছে।
 
কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘দেখা বিভাগ’ না লিখে ‘দর্শন বিভাগ’ লেখা হয়? প্রশ্নটা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কি বাঙালির না অন্য কারোর। যদি বাঙালি ছাত্ররা সেখানে পড়াশুনা করে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙলা থাকলে সেখানে বাঙালির বাঙলা ব্যবহার হবে না, যে ভাষা বাঙালিরা ব্যবহার করে না সেই ভাষা ব্যবহৃত হবে সে প্রশ্ন করা যায়। আমরা শুরুতেই দেখিয়েছি যে, ‘দর্শন’ বলতে যা বুঝায় ‘দেখা’ দিয়ে বাঙালিরা একই জিনিস বুঝে। অধিকন্তু দেখা দিয়ে দর্শনেরও অধিক কিছু বুঝায়। যেমন ‘দর্শন করা’ দিয়ে ‘করা’ হচ্ছে বাক্যের ইনফিনিট সাজেশন। যেখানে দর্শন করা ক্রিয়াপদের ধাপ হিসাবেই ব্যবহৃত। কিন্তু ‘দেখা’ বা ‘দর্শন’ বাক্যের অন্তে ব্যবহারের দরুন ‘দেখা’ই সেখানের ‘ভাবা’র ইনফিনিট সাজেশন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাঙালির এই ‘দেখা করা’ (অর্থাৎ প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে) না নিয়ে পরোক্ষ জ্ঞান দর্শন হিসাবে গ্রহণ করেছে। এর ফলে বাঙালির দেখাকে দর্শনবাচ্য জ্ঞান করা হয় নাই। অথবা কলোনিয়াল শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তকরা বাঙালির ‘দেখা’ জ্ঞানটাকে বোঝেনি। সেটা না হয় কলোনিয়াল সময়ের ঘটনা, এরপরেও কি বাঙলাদেশ স্বাধীন হয় নাই?

গোঁসাই পাহ্‌লভী, ভাস্কর, লেখক।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ