আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

শাহবাগ ডেকেছিলো বলেই

ড. কাবেরী গায়েন  

শাহবাগ ডেকেছিলো বলেই বাংলাদেশের মানুষ কোটিকণ্ঠে ৪২ বছর ধরে বুকের মধ্যে লালন করা আকাঙ্ক্ষাকে মুক্ত বাতাসে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলো, ‘যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই’। শাহবাগ ডেকেছিলো বলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে এদেশের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন প্রকাশিত হতে পেরেছে, ‘বুকের ভেতর জ্বলছে আগুন, সারা বাংলায় ছড়িয়ে দাও’।

শাহবাগ ডেকেছিলো বলেই পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রশ্নে জাতির অনুভব কাঠামোর মধ্যে যে দ্বিধা আর সংশয় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিলো, যে কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েও বিশ্বাস করা যায়নি যে সম্ভব হতে পারে কোনদিন, সেই সংশয়ের কুহেলিকা ছিন্ন হয়েছে। যা কিছু রাজনৈতিক দলের প্রতিহিংসাপ্রসূত কার্যক্রম বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে একাত্তরের ঘাতক আর দালালেরা, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ প্রমাণ করে দিয়েছে প্রতিহিংসা থেকে নয় বরং এ জাতি তাদের পিতৃহন্তারকদের বিচার করে শুদ্ধ হতে চায়।     

শাহবাগ ডাক দিয়েছিলো অনায়াসে। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। অনলাইন ব্লগার অ্যাক্টিভিস্টরা শাহবাগে জড়ো হয়েছিলেন কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে। কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার আগের দিন ‘মিরপুরের কসাই’ নামে পরিচিত একাত্তরের কুখ্যাত রাজাকার কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে গণহত্যা, অগ্নি-সংযোগ ও লুট-তরাজের সকল অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। এদেশের মানুষের সামষ্টিক স্মৃতি, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাহিত হয়েছে, ঠিকই জানে যুদ্ধাপরাধীদের হত্যার দাবি উঠেছিলো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই, কামরুল হাসানের “এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে” পোস্টারটিতে। প্রচার করেছিলো  মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী  সরকার।  শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের দাবি তাই মুক্তিযুদ্ধেরই দাবি।  

মুক্তিযুদ্ধের এই দাবিকে ইতিহাসের সঠিক মূহুর্তে শাহবাগ ফের জনপরিসরে নিয়ে আসতে পেরেছিলো বলেই মানুষ দাঁড়িয়েছিলো পাশে। হাজার হাজার মানুষ। লাখ লাখ মানুষ। সারা দেশের মানুষ। দেশ ছাড়িয়ে পৃথিবী, যেখানে যে বাঙালি ছিলেন,  ছিলেন যেখানে যে বাংলাদেশের জল-হাওয়ায় অনুগত্যে বেড়ে ওঠা মানুষ, চাকমা-মারমা-গারো-সাঁওতাল, সকলেই দাঁড়িয়েছিলেন। দাঁড়িয়েছিলেন শিশু, বৃদ্ধ, তরুণ, নারী-পুরুষ, শিক্ষার্থী, ভিক্ষুক, পরিপাটি শিক্ষক আর উসকো চুলের পাগলী মেয়েটি। দাবানলের মতো চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, ক•বাজারসহ সারাদেশে সব জাগরণমঞ্চ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছিলো জনসমুদ্র। দেশপ্রেম আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে নিয়ে সারা বিশ্বের সব বাঙালিই কোন না কোনভাবে হয়ে উঠেছিলেন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী। সারা পৃথিবীর জাগরণ মঞ্চের মানুষ গাইলেন এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের তিমির হননের গানটি। যেনো বা সদ্য প্রয়াত পীট সিগারের গাওয়া গান, ‘এই বুকের গভীরে, আমরা জেনেছি, যে আমরা করবো জয় একদিন’। শাহবাগ যেনো হঠাৎই বাংলাদেশকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তার গৌরবের ইতিহাসের। যেনো বা খানিকটা ‘লিবারেশন থিওলজি’র মতো। তবে এখানে বাহন ধর্ম নয় বরং জাতি-সত্ত্বার অনিবার্য উপাদানগুলো, যা ধর্মনিরপেক্ষ।

জাগরণমঞ্চ প্রথমেই মুক্তিযুদ্ধের বেহাত ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করেছে। সামরিক শাসকদের কারখানায় রচিত যে ইতিহাস পড়ে আমরা বেড়ে উঠেছি, কমবেশি তার ন্যারেটিভ হলো ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা নিরস্ত্র বাঙালির উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। ফলে কিছু বীর সৈনিক ও মুক্তিপাগল সাধারণ মানুষ আত্মরক্ষার তাগিদে পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে এবং নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এই ডিসকোর্সে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের নামকরণ করা হয় স্বাধীনতা-যুদ্ধ। আপাতদৃষ্টিতে, কী এমন পার্থক্য? একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় এই বিকৃত ন্যারেটিভে রয়েছে গভীর রাজনৈতিক চক্রান্ত। মুক্তিযুদ্ধকে স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে চালিয়ে দিতে পারলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পশ্চিম-পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসনবিরোধী যে ২৪ বছরের সংগ্রাম যার অর্জন হিসাবে ভাষা-আন্দোলন, শিক্ষা-আন্দোলন, ৬- দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, যার প্রত্যেকটি যুক্ত হয়েছে পরের আন্দোলনের সাথে এবং ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট করে তুলেছে বাংলাদেশ নামের এক জাতিরাষ্ট্রের অবয়ব- সেই সবকিছুকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়া যায়। উপনিবেশ থেকে মুক্ত হবার স্পিরিটের বিপরীতে গোটা বিষয়টি হয়ে ওঠে আক্রমণকারী ‘হানাদার’(দুষ্কৃতিকারী)-দের কবল থেকে ‘স্বাধীন’ হওয়া, এর বাইরে কিছু নয়। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ চ্যালেঞ্জ করেছে সেই ইতিহাস বিকৃতির।

জাতীয় ইতিহাস নির্মাণের রূপ-কাঠামোটি যা মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য করেছিলো ১৯৭১ সালে, জাগরণ মঞ্চ সেই কাঠামোর প্রতিটি স্তম্ভকে ফের আলোতে এনেছে। শাহবাগ মনে করিয়ে দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো একটি শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের চিন্তাকে পরিণতি দেবার জন্য। একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার তাগিদে। ‘একটি ফুলকে বাঁচানো’র মতো মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল মুক্তিযুদ্ধ। শাহবাগ যেনো হঠাৎই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নামের বিমূর্ত ধারণার মূর্ত আকাঙ্ক্ষাগুলোর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে দেশকে, যা বাংলাদেশ বারে বারেই ভুলে গেছে কিংবা বিচ্যুত হয়েছে সামরিক শাসন আর সামরিক ছাউনি থেকে জন্ম নেয়া রাজনৈতিক দলগুলোর আধিপত্যে। এদেশের রাজনীতির সাংস্কৃতিক নয়া যুগের ডাকটি দিয়েছে শাহবাগ।  
 
কাজটি করতে গিয়ে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবির পাশাপাশি এই দেশের জন্মকালীন কিছু প্রতীককে ফিরিয়ে এনেছে। রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’ আর যুদ্ধের প্রস্তুতিকালীন শ্লোগানগুলো ফের মানুষের  মুখে তুলে দিয়েছে। স্বার্থান্বেষী রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকসমূহের সাথে একটি দলকে জুড়ে দিয়ে বিতর্কিত করে ফেলেছিলো। এই রাজনীতির বলি হবার ভয়ে এমনকি অনেক মুক্তিযোদ্ধা পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসের এক বিরাট সময় জুড়ে বিরত থেকেছেন ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণে। ক্ষেত্রবিশেষে অধিকতর দায়িত্বশীল এবং মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে তাঁদের কণ্ঠে। তাই  ‘পদ্মা, মেঘনা, যমুনা- তোমার আমার ঠিকানা‘র পাশাপাশি উচ্চারিত হয়েছে, ‘তুমি কে, আমি কে? বাঙালি, চাকমা’, ‘তুমি কে, আমি কে? বাঙালি, সাঁওতাল’। জাতি-সত্ত্বার প্রশ্নটি মীমাংসা করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বাংলাদেশে ধর্মের প্রশ্নটিও মোকাবেলা করতে চেয়েছে শাহবাগ। ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খৃষ্টান, বাংলার মুসলমান- আমরা সবাই বাঙালি’, মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সাধারণ মানুষের মুখে তুলে দিয়েছে। বলতে গেলে একাত্তরকে তুলে এনেছে ফের। নতুনতর প্রজন্মকে পরিচিত করিয়েছে একটি একটি করে মুক্তিযুদ্ধের চিহ্নসমূহের সাথে।  

গণ-জাগরণ মঞ্চের বড় অর্জন নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণের গুণগত ও পরিমাণগত মাত্রা। শত শত নারী এই মঞ্চে কাজ করেছেন। লাকী আক্তারসহ অনেক নারী আন্দোলনকারীর নামে ধারাবাহিকভাবে অপপ্রচার করা হয়েছে, কিন্তু তাঁদের অংশগ্রহণ যেমন স্তব্ধ করা যায়নি তেমনি নারী-সংক্রান্ত একটি দুর্ঘটনার খবরও জানা যায়নি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দেশটিকে প্রকৃত অর্থেই জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার করে তোলার প্রত্যয়টি স্পষ্ট ছিলো। শুধু সংখ্যার বিচারে নয়, নারীর অংশগ্রহণের গুণগত মাত্রাও অতীতের যে কোন রাজনৈতিক আন্দোলনের চেয়ে ভিন্ন। নারীর অংশগ্রহণ এখানে পুরুষের সহযোগী হিসাবে ছিলো না, ছিলো না পুরুষের প্রেরণাদাতা হিসাবে। বরং অনায়াস সহজতায় রাত-দিন নারীরা কাজ করেছেন, অন্যদিকে গৃহিণী নারীরাও তাঁদের শিশু-কিশোরী মেয়েদের হাতে ধরে নিয়ে এসেছেন শাহবাগে। এইসব নারীদের কোন রাজনৈতিক সমাবেশে অংশগ্রহণ করার কথা বোধহয় চিন্তাও করা যায়নি। কিন্তু শাহবাগে সব অসম্ভব সম্ভব হয়েছিলো। আরেকটি গুণগত উত্তরণ হতে দেখেছি, যেসব মেয়েরা শ্লোগান দিয়ে শুরু করেছিলেন জাগরণ মঞ্চে তাঁদের অংশগ্রহণ, সেইসব মেয়েরাই রাজনৈতিক-দলবিহীন রাজনীতির পরিক্রমায় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে অংশ নেবার মতো তৈরি হয়েছেন এক বছরে।  

৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরে যখন প্রথম গণজাগরণ মঞ্চে যাই, তখনই প্রথম টানা শুনেছিলাম লাকী আক্তারের অনলবর্ষী শ্লোগান। সেইসব শ্লোগান সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে। গত বছর নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে একটি নাগরিক প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে গিয়েছিলাম পাবনার সাঁথিয়ায়, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের খবর পেয়ে। লাকী আক্তারও ছিলেন প্রতিনিধিদলে। যেখানেই গিয়েছি, লাকীকে দেখার জন্য মানুষ ভিড় করেছে। মনে পড়ছে, বনগ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলায় বিধ্বস্ত এক বাড়ির প্রবীণ সদস্য ফোন দিয়ে তাঁর স্ত্রী-কন্যাকে বলছেন, ‘শ্লোগানকন্যা লাকি আসিছে, তোমরা নামো’। রাজনীতিতে নারীর এই সমানাধিকারের রাজনীতি এস্টাব্লিশমেন্টকে কতটা ক্ষুব্ধ করেছে সেটি বোঝা যায়, পাকিস্তান হাই-কমিশন অভিমুখীন মিছিলে শাম্মীর উপর নৃশংস হামলায়। কিংবা বিপরীতভাবে, হয়তোবা জাগরণমঞ্চে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ভীত হয়েই হেফাজতের তেরো দফায় নারীর বিরুদ্ধে বেহায়াপনার অভিযোগে তার স্বাধীন চলাচলে অবরোধ আরোপ করা হয়েছে। এযাবতকালে নারী অনেকবারই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে,কিন্তু কখনোই বীর আখ্যা পায়নি। যুদ্ধে নারী সচরাচর জয়ী হয় না কারণ যুদ্ধ ডিসকোর্সটিই নারী অবমাননাকারী। শাহবাগ আন্দোলনে নারী বীর হয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নারীর এই মর্যাদাবান অংশগ্রহণ নতুন যুগের সূচনা, সন্দেহ নেই।

তবে শাহবাগ আন্দোলনের অনবদ্যতা তার আন্দোলন-কৌশলে। অনেকেই একে তুলনা করেছেন প্যারী কমিউনের বিদ্রোহের সাথে, কেউবা তিয়ান আন মেন বা তাহরির স্কোয়ারের সাথে। একটু খেয়াল করলে বোঝা যাবে এইসব আন্দোলন হয়েছে কোন না কোন এস্টাব্লিশমেন্টের বিপরীতে। উদ্দেশ্য তাৎক্ষণিক অর্জন। আন্দোলনে যাঁরা মারা গেছেন তাঁদের বাদ দিলে আন্দোলনকারীরা দাবি আদায় করে ফিরে গেছেন যে যাঁর কাজে। কিন্তু শাহবাগ আন্দোলনের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা একেবারেই আলাদা। এই বৈশিষ্ট্যগুলো ইতিহাসের দায় থেকেই লিখে রাখা দরকার।  

প্রথমত, কিছু মানুষ হঠাৎ জড়ো হয়ে ডাক দিয়েছিলেন কেবল কোন এস্টাব্লিশমেন্টকে হঠানোর জন্য নয়। কিংবা কিছু তাৎক্ষণিক অর্জনের জন্যও নয়। বরং এই আন্দোলনে তাৎক্ষণিক লক্ষ্য অর্জনের পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদি সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের ডাকও ছিলো। জাগরণ মঞ্চের ছয় দফা দাবির তাৎক্ষণিক লক্ষ্য যদি হয় কাদের মোল্লাসহ যুদ্ধাপরাধীদের  ফাঁসির দাবি, তো দীর্ঘস্থায়ী চূড়ান্ত লক্ষ্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে চিরতরে এদেশ থেকে উৎখাতের ডাক। শাহবাগের তরুণরা নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি করার অধিকার বহাল রেখে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দুরাশা মাত্র। তাঁরা ডাক দিয়েছেন যুদ্ধাপরাধী দল হিসাবে জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার এবং আরো সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছেন এসব রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় যে অর্থনীতি সেই অর্থনীতির যোগান বন্ধ করার। আবার তাদের তাগিদ, গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিলোপ নয় বরং রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে নিয়ে আসার। বলতেই হয় তরুণদের এই আন্দোলন যথেষ্ট প্রজ্ঞাবান এবং সুদূরপ্রসারী।  

দ্বিতীয়ত, প্রচলিত রাজনীতির কাঠামো এখানে নেই। একারণেই ‘আরব বসন্ত’ বা তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনের সাথে অনেকেই মিল খুঁজে পান। কিন্তু শাহবাগে যাঁরা যোগ দিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের অনেকেরই কোন না কোন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা যদিও এই আন্দোলনে কাজে লেগেছে কিন্তু প্রত্যেকেই নিজ নিজ সংগঠনের কাঠামোকে পেছনে ফেলে এসেছেন। কাঠামো থেকে কাঠামোহীনতায় রূপান্তরিত হওয়া অথচ সংঘবদ্ধ থাকার দীর্ঘস্থায়ী নজির পৃথিবীর খুব কম আন্দোলনেই আছে।   

তৃতীয় এবং সবচেয়ে অনবদ্য বৈশিষ্ট্য হলো শাহবাগের অহিংস আন্দোলনের ধারা।  বারে বারে অপপ্রচার আর সহিংসতার শিকার হয়েও এই মাটির সহিষ্ণু আচরণকেই আন্দোলনের উপায় হিসাবে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত জারি রেখেছে শাহবাগ। কোন ঘটনাকে বুঝতে হয় একই সময়ে জারি থাকা বিপরীত ঘটনার প্রেক্ষিতে। যখন জামাত-হেফাজত আগুন দিচ্ছে শহীদ মিনারে-ট্রেনে, উপড়ে নিচ্ছে ট্রেন লাইন এমনকি খুন করছে ব্লগারদের, শাহবাগ তখনো অহিংস কর্মসূচী থেকে বিচ্যুত হয়নি। আগুন আর আলোকশিখার পার্থক্য স্পষ্ট করেছে শাহবাগ। সহিংস শক্তি আগুন দিয়েছে, শাহবাগ লাখো মোমের শিখায় তুলে ধরছে এদেশের ইতিহাস। শাহবাগের অহিংস আন্দোলনের পাশে জামাত-হেফাজতের বিধ্বংসী রাজনীতিটি অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে প্রকটভাবে উন্মোচিত হয়েছে।

বছরব্যাপী সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের অর্জন কী? সহজ চোখে গত এক বছরে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের অর্জন অপরিসীম। যুদ্ধাপরাধের বিচারকে এখন ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়া দাবিতে পরিণত করতে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে এই মঞ্চ, প্রচলিত রাজনীতি যেখানে ব্যর্থ হয়েছে। পরিষ্কারভাবে তারা ঘোষণা করতে পেরেছে, এই দেশের রাজনীতিতে কোন যুদ্ধাপরাধী দল অংশ নিতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আনুগত্য এদেশে রাজনীতি করার ন্যূনতম যোগ্যতা বলে বিবেচিত হবে।। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাই বাতিল হয়েছে জামাতের নির্বাচনে অংশ নেবার যোগ্যতা। এই কথাগুলো বলে ফেলা বা করে ফেলা এখন যতো সহজ, গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হবার আগে মোটেই সহজ ছিলো না। এই অর্জনকে আবার মাপতে হবে সময়ের নিক্তিতে। আজ যে শিশুটি শুনেছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, রাজাকারের ঠাঁই নাই’, দশ বছর পরে হয়তো তার প্রভাব বোঝা যাবে। নগদ প্রাপ্তি হলো, গণজাগরণ মঞ্চের কারণেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আপীল করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সেই পথেই ফের কাদের মোল্লার প্রথম রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপীল করে জিতেছে, কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। এই আন্দোলনের ফলেই জামাতকে যুদ্ধাপরাধী দল হিসাবে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। গোলাম আজমের বিচারে যা খুব কার্যকর হয়েছে।  যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতের বিচার-প্রশ্নটি সামনে এসেছে।

প্রপাগন্ডা কম হয়নি জাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে। ‘আস্তিক-নাস্তিক’ বিতর্কে জড়িয়ে ফেলা হয়েছিলো। প্রতিপক্ষ সফলও হয়েছিলো অনেকটা। ব্লগার রাজীবের খুন এবং পরে জাগরণ মঞ্চের কর্মী সমর্থকদের ওপর চড়াও হওয়াকে বৈধতা দিতে চেয়েছে প্রতিপক্ষ এই নাস্তিকতা ইস্যু তুলে। এমনকি সরকারের বিরাগভাজনও হয়েছেন জাগরণমঞ্চের নেতাকর্মীরা। একথা সত্যি জাগরণ মঞ্চের প্রাথমিক উত্তেজনা শেষ হয়েছে। জাগরণ মঞ্চ এখন বাড়তি উচ্ছ্বাসের জোয়ার কাটিয়ে বাস্তবের মাটিতে স্থিত হচ্ছে। তাদের লক্ষ্যও এখন অনেকটাই বাস্তবতার জমিনে প্রোথিত। সেই লাখো মানুষের জোয়ার স্তিমিত হয়েছে, বিভাজন ঘটেছে নানা মতের সাথে পথের। এটিই স্বাভাবিক। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও নানা আদর্শের মাঝে সংঘর্ষ ছিলো। তবে সার্বিকভাবে দেশের মানুষ এইসব চুলচেরা বিশ্লেষণ নিয়ে মাথা ঘামায় না বলেই মনে হয়, বরং তারা শাহবাগকে দেখে মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রতীক হিসাবে, যারা হারিয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে জনপরিসরে ফেরত এনেছে। এক বছরে সকল বাধা-বিপত্তিকে কাটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহনকারী তারুণ্য ফের তাদের অনন্যতা স্থাপন করেছে নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পাশে তাদের উপস্থিতির মাধ্যমে। তারাই যে সবচেয়ে আস্থার জায়গা এখন দেশবাসীর, সেটিও প্রমাণিত হয়েছে যশোরের অভয় নগর, মণিরামপুর এবং দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও-এ তাদের সমাবেশে এবং পথে পথে তাদের পথসভায় লাখো মানুষের উপস্থিতিতে। কোন রাজনীতিবিদের পক্ষেই এমন জনসমাবেশ ঘটানো নিকট অতীতে সম্ভব হয়নি। বোঝা যায়, তারুণ্যের এই শক্তির উপর জনগণ তাদের আস্থা স্থাপন করেছেন এবং এভাবেই তাঁরা আস্থা জ্ঞাপন করেছেন মুক্তিযুদ্ধে।

ইতিহাস সাক্ষী, বাংলাদেশের তারুণ্য যুদ্ধে বরাবর বিজয়ী হয়েছে। যেমন বিজয়ী হয়েছে ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০-এ। তবে সেইসব যুদ্ধের সাথে আজকের তরুণদের যুদ্ধের পার্থক্য হলো, এবারের যুদ্ধ কেবল চিহ্নিত শক্তির বিরুদ্ধে নয়, নয় একক কোন মতাদর্শের বিরুদ্ধে। বরং নানা পর্যায়ের নানা আপোষ এবং দেশীয়-আন্তর্জাতিক নানা হুমকির বিপরীতে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে উদ্ভাসিত করার যুদ্ধ। সারা পৃথিবীই বড় বেশি খারাপ সময় পার করছে। একদিকে সারা পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধাপরাধীদের জন্য ‘মানবতাবাদী’দের মায়াকান্না, অন্যদিকে সমরসজ্জার জন্য শক্তিমানের বরাদ্দ বৃদ্ধি। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে গর্ত থেকে বের করে খুন করা সহি, অপরাধ হলো ৩০ লাখ মানুষকে হত্যাকারী পাকিস্তানী বাহিনীর দোসরকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া। তবে এই যুদ্ধেও শাহবাগ জিতবে কারণ এই দেশের জন্মকালীন আকাঙ্ক্ষার কাছেই কেবল তাদের অনুগত্য। অনুগত্য তাদের একটি ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার। আর তাই শাপলা চত্বরে যে উপায়হীন কিশোর-তরুণদের আমরা দেখেছি, তাদের ভাবনাও এই তরুণরা রাখবেন তাদের বিবেচনায়, শুরু হওয়া নতুন যুগের মানবিকতায় এই দাবি থেকেই যায়। তবে এমন দাবিও যে করা যায়, সেও তো শাহবাগ ডাক দিয়েছিলো বলেই।

‘ঝড়ে, জলে, রৌদ্রে যে ফুল ফুটবে, তার মালিরা তৈরি হয়েছে
বন্যায়, মন্বন্তরে যে আশ্বাস দেবে, সেই মানুষেরা তৈরি হয়েছে
নেহাত অ-কবির বুকেও কবিতা লিখবার দারুণ তৃষ্ণা জাগাবে যে মানুষ,  
তারা এসেছে আমার ব্যর্থ কবিতাকে সম্পূর্ণতা দেবে বলে।
মানুষের বাংলাদেশ জাগছে।  
আমাকেও সাথে নিও ও ভাই, ও বোন! হে বন্ধু!’ (‘শাহবাগ ২০১৩’, কাবেরী গায়েন) 

ড. কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ