প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৪৮ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে অধিবেশনের সকল কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপন করেন। তিনি পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যাই বেশি এবং তারা বাঙালি, সেহেতু অবশ্যই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সকল কার্যাবলীর জন্য ব্যবহার করা উচিত এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। কিন্তু লিয়াকত আলী খান সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের ভিত্তিতে এই দাবী নাকচ করে দেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ সালাম বরকত রফিক জব্বারের রক্তের পথ ধরে অর্জিত হয়েছে বাংলা ভাষার অধিকার। কিন্তু এর পিছনে যে দীর্ঘ ইতিহাস আছে তা নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানে না। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন প্রস্তাব উত্থাপন করেন, পাকিস্তান গণপরিষদের কাছে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদ সুপারিশ করছে যে, বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা করা হোক।
২১ ফেব্রুয়ারির গুলি চালানোর পর ব্যবস্থাপক পরিষদে প্রথম আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও তার পরেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন যে, গুলিতে ছাত্রহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে পরিষদের কাজে অংশগ্রহণ করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিরোধী দলের মুলতবি প্রস্তাব অগ্রাহ্য হলে তারা পরিষদ ছেড়ে চলে যান।
আমরা অনেকেই এই তথ্যটা জানিনা পাকিস্তানের সংবিধানের ২১৪(১) অধ্যায়ে বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে। তাঁর ও আগে ১৯৫৫ সালের ৩রা ডিসেম্বর ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলা একাডেমি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, গবেষণা ও প্রচারের লক্ষ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) এই একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর স্বাধীনতার পর থেকে শুরু হয়ে চলছে ২১ শে বইমেলা। মুক্ত চিন্তা বিকাশ ও প্রগতিশীল মানুষদের সীমানা পেরিয়ে একুশের বইমেলা একটি ঐতিহ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। পৃথিবীর বহু উন্নত দেশে ও শুধুমাত্র বই নিয়ে এমন মাসব্যাপী মেলা আয়োজনের কোন তথ্য খুঁজে পাইনি। কিন্তু সেই বইমেলা যখন আক্রান্ত হয়, লেখক আক্রান্ত হয়, প্রকাশক আক্রান্ত হয় ধর্মান্ধদের চাপাতির রক্তে রঞ্জিত হয় বইমেলার প্রান্তর কিন্তু আমরা নীরবে মেনে নেই হত্যাকাণ্ডকে। তখন প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক।
এবারের ২০১৬ সালের বইমেলার প্রস্তুতি পর্বেই বাংলা একাডেমির পরিচালক জানিয়ে দিয়েছিলেন উস্কানিমূলক কোনো লেখা যেন কোনো প্রকাশক না ছাপায়। যদি কেউ দায়িত্ব নিয়ে কারো উস্কানিমূলক লেখা ছাপায় তাহলে রোদেলা প্রকাশনীর মত ভাগ্য বরণ করতে হবে তাদের। কারণ গত বছর অনুবাদ বই নবী মোহাম্মদের ২৩ বছর প্রকাশনার জন্য বই মেলায় রোদেলা প্রকাশনীকে মেলায় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
এরপর বইমেলা শুরু হবার পর সোমবার ৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে বাংলা একাডেমির ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভবনের সভাকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বলেন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলে অমর একুশে গ্রন্থমেলার দায়িত্ব তাদের হাতে ছেড়ে দেয়া হবে।প্রকাশকগণ বইমেলার দায়িত্ব নিলে বাংলা একাডেমির লোকজন গবেষণায় মন দিতে পারবেন বলেও মনে করেন একাডেমির মহাপরিচালক। কারণ মুক্তচিন্তা, গবেষণা করা শুধু মাত্র বাংলা একাডেমির সোল এজেন্ট। বাংলা একাডেমির বাইরে যারা গবেষণা করবেন লেখালেখি করবেন তাঁদের নিয়ে বাংলা একাডেমির কোন দায় নেই। সেই দিক থেকে মহাপরিচালকের কথার যুক্তি আছে বলা যায়।
একটু পিছনে ফিরে দেখলে - ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে বইমেলার ঠিক বাইরে টিএসসির কাছে চাপাতি দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছিল। কোনক্রমে তিনি সে যাত্রা বেচে গেলেও, স্বাভাবিক জীবনে ফেরা হয়নি তার, এর ৬ মাস পর জার্মানিতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। যদিও সে মৃত্যু নিয়ে ও অনেকের সন্দেহ রয়ে গেছে।
গত বছর ২০১৫ সালে বইমেলার ২৬তম দিনে মেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসি এলাকায় খুন হন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক অভিজিৎ রায় । ঘাতকের চাপাতির কোপে হাতের আঙুল হারান সঙ্গে থাকা স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা।এর আট মাসের মাথায় একই বছরের ৩১ অক্টোবর অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশকারী জাগৃতি ও শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে হামলা হয়। লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর কার্যালয়ের হামলায় অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল, ব্লগার তারেক রহিম ও রণদীপম বসু গুরুতর আহত হন। একই কায়দার হামলায় শাহবাগে নিজ কার্যালয়ে নিহত হন জাগৃতির কর্ণধার দীপন। তার অপরাধ অভিজিতের জনপ্রিয় বই ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ ছেপেছিলেন তিনি।
জানি, এদের নিরাপত্তা দেয়ার কাজ বাংলা একাডেমির না। রাষ্ট্র, পুলিশ এইসব দেখভাল করবেন। কিন্তু বাংলা একাডেমি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত থেকে শুরু করে অভিজিৎ রায়, নিহত হন জাগৃতির কর্ণধার দীপন ডঃ হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে তাঁদের মেলায় স্মরণ করার কাজটুকু বাংলা একাডেমি করতে পারত নিশ্চয়। কিন্তু কোন প্রয়োজনীয়তা মনে করেনি ।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জীবনের শেষ কথাগুলো একবার পাঠকের উদ্দেশ্যে পেশ করার লোভ সামলাতে পারিনি। তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের ডেকে বলেছিলেন "তোমাদের কিছু কথা বলা দরকার। আমার বেঁচে থাকার খুবই প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের জন্য, কিন্তু মনে হচ্ছে তা আর সম্ভব হচ্ছে না। আমার বন্ধু কন্যার (ইন্দিরা গান্ধী) সাথে এই মুহূর্তে দেখা হওয়াটা খুবই প্রয়োজন ছিল- কিন্তু এখন যদি আমি এখান থেকে চলে যাই তাহলে মিলিটারিরা আমাকে খুঁজে না পেলে আশপাশের সব লোককে মেরে ফেলবে, আগুন দিয়ে সব জ্বালিয়ে দেবে। আমাকে না পেলে নিরপরাধ মানুষগুলির প্রাণ যাবে। সেটা তো হতে পারে না। আই অ্যাম ট্রাপড।' সেদিন তিনি আরো বলেছিলেন, 'আমাকে নিতে এসে মিলিটারিরা দুটো জিনিস করতে পারে, তারা আমাকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে গিয়ে আমাকে দিয়ে বিবৃতি দেওয়ানোর চেষ্টা করাতে পারে- আর তাই যদি করে তাহলে তাদের আমি একটা কথাই বলবো-To stop kill these unarmed people, তখন তারা আমার ওপর অত্যাচার করবে এবং মেরে ফেলবে ওখানেই। আরেকটা ব্যাপার হতে পারে- মিলিটারিরা আমাকে এখানেই গুলি করে মারতে পারে।'
সেদিন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উপস্থিত পরিবারের সবাইকে বলেছিলেন, 'আমার অনুরোধ, তোমরা আমার মৃতদেহ বারান্দায় ফেলে রেখো যাতে সবাই আমার মৃতদেহ দেখে মনে সাহস পায়, বিদ্রোহ করবার জন্য।' সাথে এটাও বললেন, 'দেখো, ওরা আমাকে দুদিনের মধ্যে এসে নিয়ে যাবে।' নাতনি আরমাকে কাছে নিয়ে বললেন, 'পৃথিবীতে আর কেউ আমার জন্য কাঁদলেও তুই কাঁদবি না, তুই কাঁদলে আমি খুব কষ্ট পাব।"
১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ রাতে ছোট ছেলে দিলীপ দত্ত সহ রাতের আঁধারে পাকিস্তানী হায়েনার দল তুলে নিয়ে গিয়েছিল বৃদ্ধ ধীরেন্দ্র নাথ দত্তকে, আর ফিরে আসা হয়নি। ( তথ্য সূত্র অনলাইন)। সেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে কি মনে রেখেছে বাংলা একাডেমি? নতুন প্রজন্ম কি জানে বাংলা ভাষার জন্য এই মহান ব্যক্তির অবদানের কথা।
মহাপরিচালকের কাছে সবিনয়ে খুব জানতে ইচ্ছে করছে, বাংলাদেশের মাদ্রাসা গুলোতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে যে সব মিথ্যাচার ও ভুল তথ্য শিখানো হয়, জিহাদি শিক্ষা দেয়া হয় তার কি কোন খবর রাখেন মাননীয় মহাপরিচালক? আইসিটি এক্টের ৫৭ ধারা পরিবর্তন করে ধর্মানুভূতিকে আঘাতের জন্যে আরো কঠোর শাস্তির বিধান! কিংবা আওয়ামী ওলামা লীগের ১০ দফা দাবীর মধ্যে পাঠ্যপুস্তকে কট্টর ইসলাম বিরোধী হিন্দু ও নাস্তিক লেখকদের লেখাকে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করে বলা হয় সরকারের নতুন শিক্ষানীতিতে চারুকলার নামে নৃত্য-যাত্রা-সিনেমা-হিন্দুদের ব্রতচারী শিক্ষা চালু করা হয়েছে। যার দ্বারা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অশ্লীলতা ও বেহায়াপনায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
একই সঙ্গে প্রচলিত শিক্ষানীতি বাতিলের দাবি জানিয়ে তাঁরা বলে ‘ইসলাম ধর্মের প্রতি যাদের আস্থা নেই এমন সব বামপন্থী ও হিন্দু ব্যক্তিদের দিয়ে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। অথচ এসব ব্যক্তিদের প্রণীত শিক্ষানীতি মুসলমানদের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।’পাঠ্যপুস্তকে প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষার নামে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রকাশ্যে যৌনতা শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। গোটা বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যভিচার শেখানো হচ্ছে। অশ্লীলতাকে উস্কে দিচ্ছে। এদের উস্কানির খবর কি জানেন বাংলা একাডেমি?
১৯ মার্চ ১৯৪৮-এ ঢাকায় এসে পৌঁছান পাকিস্তানের স্থপতি ও গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) এক গণ-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ও সেখানে তিনি ভাষণ দেন। দ্ব্যর্থহীন চিত্তে ঘোষণা করেন - "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়" তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, "জনগণের মধ্যে যারা ষড়যন্ত্রকারী রয়েছে, তারা পাকিস্তানের শত্রু এবং তাদের কখনোই ক্ষমা করা হবে না"। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়েও তিনি একই ধরণের বক্তব্য রাখেন। তিনি উল্লেখ করেন এ আন্দোলন সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ এবং অভিযোগ করেন কিছু লোক এর মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে চাইছে। যখন তিনি উর্দুর ব্যাপারে তাঁর অবস্থানের কথা পুনরুল্লেখ করেন, উপস্থিত ছাত্ররা সমস্বরে না, না বলে চিৎকার করে ওঠে। জিন্নাহ তখন প্রতিবাদী ছাত্র জনতাকে বলেছিলেন "চুপ করে বৈঠে যাও খামোশ সে শোনো।"
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের বক্তব্যও যেন সেই সুর। তবে উসকানির সংজ্ঞা কিভাবে নির্ধারণ করবেন সেটা লেখক প্রকাশকদের বই মেলার আগে দিয়ে দেয়া উচিৎ ছিল। অথবা আগামী বই মেলা থেকে শুধুমাত্র ধর্মগ্রন্থ ছাড়া অন্য কোন গ্রন্থের অনুমতি না দিলেই সব ঝামেলার সমাধান হয়ে যায়। ফ্যাশন হাউজ গুলো ২১ নিয়ে বাণিজ্য করুক, আমরা পাঞ্জাবী পায়জামা, শাল শাড়ি গহনা পরে মেলায় ঘুরব খুশি খুশি মুখে সেলফি তুলব। তাহলে বাংলা একাডেমি গবেষণায় মন দিতে পারবেন।
বইমেলা আসে বইমেলা যায় আমাদের কবি, লেখকদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠে ২১শের মাস ব্যাপী বইমেলা। হাজার হাজার বইপ্রেমী মানুষ আসেন মেলায়। প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। টেলিভিশন ক্যামেরায় দেশের সুশীল বুদ্ধিজীবীদের বচন সুধা পান করে আমরা ধন্য হই। বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, মুক্তচিন্তা, মননশীলতার নানা বাণী শুনি আমরা। আশাবাদী হই, সুন্দর প্রগতিশীল একটি বাংলাদেশের। আমরা বই পড়ি জ্ঞান আহরণ করি, কিন্তু প্রতিবাদ করিনা।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য