আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

জাফর ইকবাল স্যার, দুঃখিত; আপনি অন্যায় করেছেন!

দেবজ্যোতি দেবু  

প্রিয় জাফর ইকবাল স্যার,
আপনি যখন দেশ নিয়ে লিখেন তখন আমরা আপনার লিখার প্রতিটি অক্ষরে দেশের জন্য ভালোবাসা খুঁজে পাই। আপনি যখন জামাতের বিরুদ্ধে লিখেন তখন আমরা একজন দেশপ্রেমিকের শক্ত অবস্থান দেখতে পাই। আপনি যখন মৌলবাদের বিরুদ্ধে লিখেন তখন আমরা সুস্থ মানসিকতার প্রগতিশীল মানুষের দেখা পাই। আপনি যখন তরুণদের উদ্দীপ্ত করতে কিছু লিখেন তখন আমরা আমাদের চোখের সামনে একমাত্র কাণ্ডারিকে খুঁজে পাই। কিন্তু আপনার এসকল লিখায় কিছু মানুষের অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তারা এসব লিখাকে অশ্লীল বলে আখ্যায়িত করে। তারা এসব লিখা বর্জন করার আহ্বান করে। তারা আপনাকে নাস্তিক বলে আপনার মাথার দাম নির্ধারণ করে দেয়। তখন ওদের এই দাবি শুনে কি আমরা আপনার বইকে অশ্লীল বলে ছুঁড়ে ফেলে দিব?

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখতে গিয়ে আপনি যখন বলেন, “যারা  কখনো নিজের মাতৃভূমির জন্য ভালবাসাটুকু অনুভব করেনি তাদের মত দুর্ভাগা আর  কেউ নেই” তখন কারো কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগে অবশ্যই। তাহলে আমরা কি সে অনুভূতির সম্মান জানাতে গিয়ে আপনার লিখাকে অস্বীকার করবো? আপনার লিখায় যখন আমরা ৭১-এর নির্মমতার ছবি দেখি, যখন দেখি কিভাবে দাড়ি টুপি পড়া লোকেরা বাংলাদেশী মেয়েদের পাকি আর্মির গাড়িতে তুলে দিয়েছিল! কিভাবে গুলি করে, জবাই করে আমাদের মানুষদের হত্যা করেছিল! কিভাবে ধর্মের নামে এই দেশের লোকদের হত্যা করেছিল! তখন আমরা ঐসব দাড়ি টুপি-ওয়ালাদের ঘৃণা করি! কিন্তু এই ঘৃণাতেও কিছু লোকের অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তারা ঐসব লিখা বর্জন করতে বলে। তারা আপনাকে গালি দেয়, নাস্তিক বলে। তাহলে কি আমরা ওদের কথায় আপনার লিখাকেও বর্জন করবো?

মৌলবাদের বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে আপনি যখন জামায়াতের দিকে ঈশারা করেন, যখন আপনি সরাসরি বলেন জামাতই মৌলবাদের মূল উৎস, তখন আমরা সেই কথা মেনে নিলেও জামায়াতিরা আপনাকে হুমকি দেয়। জামাত তথা মৌলবাদীদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে, তারা আপনার গর্দান নিতে চায়। তখন কি আমরা ওদের কথা মেনে নিয়ে আপনাকে নাস্তিক বলে দূরে ঠেলে দিব? আমরা কি আপনার লিখা বর্জন করবো?

আপনি যখন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের পাশাপাশি জামায়াতের রাজনীতি বন্ধের দাবি জানান, তখন মৌলবাদী অপশক্তির চক্ষুশূল হোন আপনি। ওরা আপনার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়ায়, “আপনি সাঈদী’র বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন নি কারণ সাঈদী নির্দোষ”! আপনি আপনার পিতার হত্যার বিচার চান না বলে সাক্ষ্য দিতে যান নি বলেও তারাও প্রচার করে। তখন আপনার সাক্ষী হতে না যাওয়ার যুক্তি আমাদের আশ্বস্ত করে। আমরা জানতে পারি আপনি সাঈদীকে বাঁচাতে নয় বরং সাঈদীর বিচার যেন বাঁধাগ্রস্ত না হয় সেজন্য আপনি সাক্ষ্য দিতে যান নি। আপনার সেই মন্তব্যেও তারা আহত হয়। তাহলে কি আমরা আপনার সেই মন্তব্যকেও ভিত্তিহীন বলে বর্জন করবো?

আপনি যখন শাহবাগ আন্দোলনে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান, তখন আমাদের মনের জোর বাড়লেও জামায়াত, মৌলবাদী, যুদ্ধাপরাধী অপশক্তির অনুভূতিতে আঘাত লাগে। তারা আপনাকে নাস্তিকদের পথপ্রদর্শক বলে গালি দেয়। আপনি শাহবাগ আন্দোলনের বিরোধীতাকারী সুশীলদের বিরুদ্ধে কলম ধরায় তাদের অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয়া অর্ধশত কথিত বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে আপনি কথা বলেছেন বলে তাদেরও অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। আপনার বিবৃতি তাদের কাছেও অশ্লীল মনে হয়েছিল। তাহলে কি আমরা আপনার সেইসব মন্তব্যও বর্জন করবো?

আপনার মৌলবাদ বিরোধী মন্তব্যে সরকার দলীয় কিছু মানুষ আহত হয়। তারা আপনার মন্তব্যকে গর্হিত অপরাধ দাবি করে আপনাকে প্রকাশ্যে চাবুক মারার ইচ্ছা প্রকাশ করে। আপনার মন্তব্যকে অপরাধ বিবেচনা করে তাদের ইচ্ছাকে কি আমরা সাধুবাদ জানাবো স্যার?

এইবার আসি প্রথাবিরোধী লেখক ‘হুমায়ুন আজাদ’ স্যার প্রসঙ্গে। স্যারকে যখন মৌলবাদীরা হত্যা করেছিল তখন অনেক লেখক বুদ্ধিজীবীর মত হুমায়ুন আহমেদও মৌলবাদীদের পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন। ধর্মকে আঘাত দিয়ে লিখলে যে কেউ যে কাউকে হত্যা করতে পারে। এজন্য মৌলবাদী হতে হয় না। এমন চিন্তা যে হুমায়ুন আহমেদ পোষণ করেছিলেন, আপনি তাঁর ভাই জেনেও আমরা আপনাকে এমন চিন্তা চেতনার বাইরে কল্পনা করেছি সব সময়। কারণ আপনি সব সময়ই মৌলবাদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। কিন্তু আজ যখন ‘ইসলাম বিতর্ক’ বইটিকে আপনার কাছে অশ্লীল মনে হলো, তখন আমরা কি এটা মনে করতে পারি না যে হুমায়ুন আজাদের কথিত ধর্মবিরোধী সকল বই আপনার কাছেও অশ্লীল মনে হয়েছে? তাহলে কি আমরা মৌলবাদীদের কথা মানতে গিয়ে সেইসব বইও বর্জন করবো?

মুক্তমনা লেখক, ব্লগারদের মৌলবাদীরা নাস্তিক বলে। তারা বলে ব্লগার মানেই নাস্তিক এবং নাস্তিক হত্যা করা ইমানী দায়িত্ব! তাই তারা একের পর এক ব্লগার, লেখক, প্রকাশককে হত্যা করছে। এই হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ, তারা দাবি করে তাদের বিরোধীতাকারী সকল লেখকই ধর্মবিরোধী অশ্লীল লিখা লিখে! ওরা আপনার লিখাকে অশ্লীল দাবি করে আপনাকেও নাস্তিক বলে এবং আপনার মাথার দামও তারা নির্ধারণ করে দিয়েছে। আপনাকে হত্যা করতে পারলে তারা বেহেস্তে যাবে বলেও ঘোষণা দিয়েছে। এখন তাদের দাবি অনুযায়ী আমরা কি আপনার লিখাকেও অশ্লীল বলে বর্জন করবো?

আপনি ভুল করছেন বা করেছেন সেই কথাটি আমি বলতে যাবো না। কারণ ভুল-শুদ্ধ বিচার করার মত পর্যাপ্ত জ্ঞান আপনার অবশ্যই আছে। আমি শুধু এইটুকু বলবো, স্যার আপনি অন্যায় করেছেন। আপনি নিজে একজন লেখক হয়ে আরেকজন লেখকের সৃষ্টিকে অশ্লীল বলে দাবি করেছেন! আপনি সেই লিখা নিজে না পড়ে অন্যের কথার উপর ভিত্তি করে এই ‘অশ্লীল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন! আপনি অন্যায় করেছেন। মৌলবাদীদের সুরে সুর মিলিয়ে একজন লেখকের সৃষ্টিকে অশ্লীল বলে গালি দিয়ে আপনি অন্যায় করেছেন। এই বই পড়তে নিষেধ করে আপনি আমাদের ব্যক্তিসত্তাকে আঘাত করে অন্যায় করেছেন। অশ্লীল এবং রুচিহীন বই কোনগুলো সেটা আমরা জানি। আমাদের এই বোধটুকুকে খাটো করে দেখে আপনি অন্যায় করেছেন।

প্রথাবিরোধী লেখক, মুক্তমনা লেখকদের মৌলবাদীরা ঘৃণা করে। মৌলবাদীরা সেই সব লেখকদের হত্যা করতে চায়। আজ আপনিও এমন একজন লেখকের লিখা বইকে অশ্লীল বলে দাবি করে সেই সব হত্যাকাণ্ডকে পরোক্ষভাবে জায়েজ করে দিয়েছেন। আপনি এই বই বর্জন করার কথা বলে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন এরা অন্যায় করছে। আপনি এমন লেখকদের চাপাতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে অন্যায় করেছেন।

যে সময়টাতে আপনার উচিৎ ছিল মৌলবাদীদের হুংকারে গ্রেফতার হওয়া লেখক-প্রকাশকদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের মুক্তি দাবি করা, সেই সময়টাকে আপনি তাঁদের সৃষ্টিকে অশ্লীল দাবি করে সরে গিয়ে অন্যায় করেছেন। মানুষ যত বড় হয় তার কথার ওজনও তত বেশি হয়। তাই আপনার কথার ওজনও অবশ্যই অনেক বেশি। আপনি খুব ভাল করেই জানেন আপনার এমন মন্তব্যে একজন লেখক কতোটা অসহায় হয়ে পড়বে। আপনার এই মন্তব্য মৌলবাদীদের কতোটা আস্কারা দিবে। মৌলবাদ প্রচারের পথকে আরো সুগম করবে। আপনার মন্তব্য পড়ে অনেক মানুষ সত্যিই বিশ্বাস করবে মৌলবাদীদের হুংকার সঠিক ছিল।

আমরা যারা এমন লেখকদের পক্ষে কথা বলছি, পাশে দাঁড়িয়েছি, সাধারণ মানুষ আমাদের ভুল জানবে। আমাদের ধিক্কার দিবে, ঘৃণা করবে। এতে করে মৌলবাদীরা সহজেই আমাদের, মুক্তমনা লেখকদের হত্যা করতে পারবে। তাদের ধর্মের নামে হত্যা জায়েজ হয়ে যাবে। এতো বড় কাণ্ড করে আপনি অবশ্যই অন্যায় করেছেন।

মৌলবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে একটি প্রজন্ম যখন আপনাকে কাণ্ডারি ভেবে আপনার সাথে চলার জন্য রাস্তায় নেমেছে, তখন মৌলবাদীদের সুরে সুর মিলিয়ে আপনার এমন মন্তব্য এই প্রজন্মকে আহত করেছে। আপনার মন্তব্য তাদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে পারে। এমন হটকারিতা করে আপনি অবশ্যই অন্যায় করেছেন। হ্যাঁ স্যার, আপনি অন্যায় করেছেন।

দেবজ্যোতি দেবু, সংস্কৃতি কর্মি, অনলাইন এক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ