আজ মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ভাষার মুনাফা, প্রজন্মের আগ্রহ

ফকির ইলিয়াস  

ভাষা নিয়ে গর্ব করার মতো অনেক কিছুই আছে। বিশেষ করে সেই ভাষা যদি মানুষের যাপিত জীবনের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। সে ভূমিকাটি কী রকম? তা হচ্ছে এরকম- একজন ইংরেজি ভাষাভাষী আমেরিকান, তার ব্যবসার প্রয়োজনে চীনে গিয়ে চাইনিজ ভাষাটি শিখে নিচ্ছেন। বাংলা ভাষায় কবিতা লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। বাংলা ভাষায় গান লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ সেই কবিতা, সেই গান অন্য ভাষায় অনূদিত হচ্ছে। পাশ্চাত্যের কোনো প্রকাশনী তা প্রকাশ করে লুটে নিতে চাইছে মুনাফা। সবই হচ্ছে বাণিজ্যের কারণে। ভাষা যদি মুনাফা লাভের সিঁড়ি হয়ে ওঠে, তাহলে তা যে কোনো মহলে আদৃত হবে না কেন ?

বাংলাদেশই বাংলা ভাষার চারণভূমি হিসেবে টিকে থাকবে। কথাগুলো বলছেন বাংলা ভাষাভাষী অনেক প্রাজ্ঞজন। অথচ এ বাংলাদেশেই এখন অনেক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। অভিভাবকরা জানেন ও বোঝেন তাদের সন্তানদের বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গড়ে তুলতে হবে।

ভাষাবিদ্যায় পারদর্শী হওয়ার কথা ভাবলে আমরা যে চিত্রটি প্রথমেই দেখি, তা হচ্ছে একটি অগ্রসরমান প্রজন্মর ভবিষ্যৎ। তা নির্মাণে প্রয়োজন নিরলস অধ্যবসায়। একটি প্রজন্ম শক্তিশালী হয়ে দাঁড়াতে দুটি বিষয়ের প্রয়োজন পড়ে খুব বেশি। প্রথমটি হচ্ছে সৎভাবে সমাজের অবকাঠামো নির্মাণ। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সমকালের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কর্মপরিধির ব্যাপ্তি ঘটানো। কাজ করতে হলে একটি যোগ্য কর্মীবাহিনীর প্রয়োজন পড়ে, যারা তাদের মেধা ও মনন দিয়ে কাজ করবে নিরন্তর।

জ্ঞানার্জনে ভাষা একটি ফ্যাক্টর তো বটেই। কারণ মানুষ না জানলে, সেই তথ্য-তত্ত্ব এবং সূত্রগুলোকে নিজের জীবনে, সমাজজীবনে প্রয়োগ করতে পারে না। সেজন্য প্রয়োজন পড়াশোনা। পড়াশোনা করতে হলে শিক্ষার প্রয়োজন। প্রয়োজন সেই ভাষাটিও রপ্ত করা। বাংলাদেশের নিরক্ষর মানুষ প্রয়োজনীয় অক্ষরজ্ঞান পেলে নিজেদের জীবনমান যেমন বদলাতে পারবেন, তেমনি পারবেন সমাজের চিত্রও বদলে দিতে। একজন শিক্ষিত মা-ই পারেন একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিতে। আমরা সে কথাটি সবাই জানি এবং মানি।

ভাষার যত রকম প্রয়োজনীয়তার সংজ্ঞা আমরা তুলি না কেন, প্রধান কথাটি হচ্ছে একটি জাতিকে শিক্ষিত করে তোলার গুরুত্ব। মানুষ সুশিক্ষিত হলেই তার জ্ঞান খুলবে, সে উদার হবে, সৎ কাজগুলো করবে। এটাই নিয়ম। পাশ্চাত্যে আমরা উচ্চশিক্ষিতের যে হার দেখি, ওই জনশক্তিই রাষ্ট্র গঠন, পরিচালনায় একটি বিশেষ ভূমিকা রাখছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

আমার এক বন্ধু নিউইয়র্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। পোলিশ এ বন্ধুটির সঙ্গে আমার নানা বিষয়ে কথা হয়। সমাজবিদ্যার এ শিক্ষক আমাকে বারবার বলেন, শক্তিশালী ভাষাই বিশ্বে পুঁজির আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করছে। তার কথাটি মোটেই মিথ্যা নয়। নিউইয়র্ক তথা গোটা উত্তর আমেরিকার একটি বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা নরটন অ্যান্ড কোম্পানির বেশ কয়েকজন কর্ণধারের সঙ্গে ‘ভাষা ও সাহিত্য’ বিষয়ে আড্ডা দেয়ার সুযোগ হয়েছে। তারা একবাক্যে বলতে চান, মুনাফার লোভেই তারা মহাকবি ওমর খৈয়াম, জালালুদ্দিন রুমী থেকে নাজিম হিকমত, রবীন্দ্রনাথ কিংবা মাহমুদ দারবিশের রচনাবলিকে ইংরেজিতে অনুবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, নিজস্ব আঙ্গিকে। তারা তা ইংরেজিতে ছাপিয়েছেন। বাজারজাত করেছেন। এতে বিশ্বসাহিত্যে এসব মহৎ লেখক যেমন আদৃত হচ্ছেন কিংবা হয়েছেন, তেমনি তাদের বই বিক্রি করে আয় হয়েছে লাখ লাখ ডলারও।

বাংলা ভাষার সন্তান বাঙালি জাতি। জাতিসত্তা থেকে এ চেতনা আমরা কোনো মতেই সরাতে পারব না। পারার কথাও নয়। কিন্তু এই বলে আমরা অন্যভাষা রপ্ত করব না বা করার আগ্রহ দেখাব না; তা তো হতে পারে না।

এখানেও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তির বিষয়টি আগে আসে খুব সঙ্গত কারণে। ভারতের কেরালা ও তামিলনাড়ু নামে দুটি অঙ্গরাজ্যের কথা আমরা জানি। কেরালা অঙ্গরাজ্যের মানুষ দুটি ভাষা জানেন বিশেষভাবে। একটি কেরালাদের নিজস্ব ভাষা মালেআলাম আর অন্যটি ইংরেজি। সেখানে হিন্দির তেমন দাপট নেই। একই অবস্থা তামিলনাড়ুতেও। তারা তামিল এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষ। বিদেশে চাকরি নিয়ে কেরালা-তামিল থেকে যারা আসেন, দেখলে মনে হয় ইংরেজি যেন তাদের মাতৃভাষাই। তাদের লক্ষ্যটি হচ্ছে, ভাষার আলো গ্রহণ করে একজন দক্ষ আইন প্রফেশনাল কিংবা টেকনোলজিস্ট হওয়া। আর সেজন্য তারা ইংরেজিকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেন স্কুলজীবন থেকেই।

স্যাটেলাইট টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে বাংলাদেশের বইমেলার ওপর অনুষ্ঠানগুলো প্রতিদিনই দেখি। মনে পড়ছে একবার একটি অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম, একজন লেখক তার বইয়ের প্রচার করছেন একটি লাইভ অনুষ্ঠানে। তার গ্রন্থের বিষয় কীভাবে আলুর অধিক ফলন করা যায়। বিষয়টি চমকপ্রদ। বর্তমান বিশ্বে আলু চাষের প্রতিযোগিতা চলছে। খাদ্য হিসেবে পাশ্চাত্যে বিভিন্ন আইটেমের আলুখাদ্য জনপ্রিয় হলেও প্রাচ্যে তা জনপ্রিয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমি মনে করি একজন শিক্ষিত কৃষক ক্ষুদ্র আকারে তার নিজের অধিক ফলন অভিজ্ঞতা বিষয়টি হাতে লিখে, কম্পোজ করিয়ে অন্যদের মাঝে বিতরণ করতে পারেন। বিষয়টি ক্ষুদ্র হলেও প্রধান দিকটি হচ্ছে একজন শিক্ষিত কৃষকই তা পারবেন। আর সেজন্যই শিক্ষার বিষয়টি আগে আসছে। শিক্ষিত হলেই মনের প্রখরতা বাড়ে। আর শিক্ষাগ্রহণ করা যায় জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত।

প্রতি বছর বাংলাদেশে ভ্রমণবিষয়ক অনেক বই বের হয়। ট্যুরিজম আজকের প্রজন্মের একটি শখের বিষয়। সিলেট কিংবা রাঙ্গামাটিতে কী দেখা যাবে- তা জানতে পারছে তারা ওই বই পড়েই। কয়েক বছর আগে আমরা ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের কয়েকটি কৃষিফার্ম সফর করতে গিয়েছিলাম। ফ্লোরিডায় বেশকিছু ফার্ম আছে, যেগুলোর সব কর্মীই স্প্যানিশ ভাষাভাষী। এরা ইংরেজি একটি অক্ষরও জানেন না। সেখানে কৃষিবিষয়ক সরকারি পুস্তিকাগুলো স্প্যানিশ ভাষায়ই বিতরণ করা হয় সরকারি উদ্যোগে।

হ্যাঁ, ভাষার আলো ছড়িয়ে দিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা উদ্যোগের প্রয়োজন খুবই জরুরি। বাংলাদেশের ভেতরে আদিবাসী ভাষার অনেক কবি, সাহিত্যিক, মনীষী, চিন্তাবিদ, দীক্ষক আছেন যাদের নামটি পর্যন্তও হয়তো আমরা জানি না। তাদের চিন্তাচেতনা যদি বাংলায় রূপান্তরিত হতো তবে বাংলা ভাষাভাষীরা হয়তো তা জেনে উপকৃত হতে পারতেন। একই দেশের ভেতরেই আছে অনেক ভাষা। আর এক বিশ্বে কত ভাষা আছে তা জানার সুযোগ হয়তো সব মানুষের পুরো জীবনেও আসবে না।

আমি সব সময়ই রূপান্তরে বিশ্বাস করি। রূপান্তরই হচ্ছে ফিরে আসা, অনূদিত হওয়া কিংবা বিবর্তিত হওয়া। বিবর্তন না হলে নতুনের উন্মেষ ঘটে না। তুলনামূলক আলোচনা ছাড়া জানা যায় না বিশ্বের ভাষার নান্দনিক বিবর্তন কীভাবে ঘটছে। লক্ষ করেছি, চলতি সময়ে বইমেলায় বেশকিছু দুর্লভ প্রাচীন ভাষা ও সাহিত্য যেমন চর্যাপদ, সিলেটি নগরী, আদিবাসী শ্লোক নিয়ে বেশ কাজ হয়েছে। আজকের লেখকরা বাংলা ভাষায়ই লিখছেন ক্যারিয়ার গড়াবিষয়ক বই। ওপরে কীভাবে উঠবেন। চাকরির সিঁড়ি কীভাবে নির্মাণ করবেন। ভাষা প্রয়োজনেই শেখে মানুষ।

নিউইয়র্কের একজন নতুন প্রজন্মের বাঙালি-মার্কিন আইনজীবীকে জানি যিনি তার পেশাগত কারণেই শিখে নিয়েছেন বাংলা ভাষা, বাংলা অভিধান তালাশ করে।

এগুলো আশার বিষয়। আমি মনে করি এসব উৎস সন্ধানই প্রজন্মকে স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি সাধনের পাশাপাশি ভাষা ও সাহিত্য অঙ্গনেও এগিয়ে যাবে স্বপ্নের বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে এখন বইমেলা চলছে। বই প্রকাশিত হতে শুরু করেছে লন্ডন, নিউইয়র্ক থেকেও স্থানীয় বাংলা প্রকাশনীর মাধ্যমে। কারণ বাংলা কম্পোজ এখন খুবই সহজ।

বিভিন্ন ভাষার বেশ কিছু অনুবাদগ্রন্থ এরই মধ্যে বেরিয়েছে। বাংলাদেশের প্রকাশকরা অনুবাদ গ্রন্থের প্রতি যত মনোযোগী হবেন, ততই লাভ বাংলা ভাষার। বাংলা সাহিত্যের। মূল কথা হল, সাহিত্যের রস আস্বাদন করা। তা যদি ইংরেজিতেও হয় ক্ষতি কী?

ভাষার আলো গ্রহণের একটা প্রতিযোগিতা চলছে আজকের বিশ্বে, নিজেকে টিকিয়ে রাখার কারণেই। বাঙালি প্রজন্ম তা থেকে পিছিয়ে থাকবে কেন? মনে রাখতে হবে, ‘ভাষার অর্থনীতি’ নামে একটি শক্তি এখন প্রজন্মের দরজায় কড়া নাড়ছে। যত জ্ঞান-তত অর্থ, এমন একটা নীতি চালাতে চাইছে পশ্চিমা বিশ্ব। ফলে প্রযুক্তির শক্তির পাশাপাশি ভাষার শক্তিও দিনে দিনে প্রখর হচ্ছে। যে আলো ধারণ করা প্রয়োজন প্রতিটি অগ্রসরমান মানুষেরই।

ফকির ইলিয়াস, কবি ও কলাম লেখক। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ