আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত

ইমতিয়াজ মাহমুদ  

ঢাকা শহরে নিয়মিত বসবাস করছি প্রায় সিকি শতাব্দী হয়ে গেল। ১৯৮৯ থেকে মোটামুটি স্থায়ীভাবে ঢাকা শহরে বসবাস করছি। এখনো আমার মনে হয় আমি এই শহরে নতুন এসেছি- সায়দাবাদ বাস স্ট্যান্ড থেকে মতিঝিলে এসে চব্বিশ তলা বিল্ডিং দেখছি। সড়ক পার হতে গিয়ে এখনো আমার ভয় লাগে, মাঝ রাস্তায় গিয়ে মাথা আউলা হয়ে যায়, বুঝতে পারিনা কোন দিকে যাবো।

না, ঢাকার সাথে একটা প্রণয় আমার ঠিকই এর মধ্যে গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেই প্রণয় যেন এখনো শাদী মুবারকের অপঘাতে স্থায়িত্ব প্রাপ্ত হয়নাই। ঢাকা আমার কাছে এখনো প্রাচীন কোর্টিজান, যে আমার প্রণয় গ্রহণ করে আমাকে প্রেম তো শেখাবে ঠিকই কিন্তু কখনো আমার একার হবেনা।

ঢাকার সাথে এই প্রণয় নেহায়েত মসৃণ ছিল না। প্রথম যখন পাহাড় থেকে নেমে ঢাকা শহরে আসতাম, ধোঁয়া আর ধুলা আর বাতাসে ভেসে থাকা দুর্গন্ধে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতো। কিছুদিন পরে আবিষ্কার করলাম আমার একটা অসভ্য অভ্যাস হয় গেছে- খানিকক্ষণ পর পর নাকে আঙ্গুল ঢুকিয়ে নাক পরিষ্কারের চেষ্টা করছি। এমনকি পেশাব করার জন্যেও যদি বাথরুমে ঢুকি বেসিনের সামনে গিয়ে নাকের ভিতর পানি দিয়ে বিচ্ছিরী আওয়াজ করে নাক ঝাড়তাম।


ঢাকা এখন কি পরিবেশের দিক দিয়ে আগের তুলনায় ভাল হয়েছে? সম্ভবত হয়েছে। এখন সেইসব ধোঁয়া উদগীরণ করা বেবিট্যাক্সি নাই। গাড়ীর ইঞ্জিনেরও উন্নতি হয়েছে। আগে আমাদের এখানে যেসব জ্বলানই তেল আসতো সেগুলির মান নিয়ন্ত্রণের কিছু ছিল না। এখন ডিজেলের সালফার কন্টেন্ট অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত, তেলে শীশার মাত্রাও নাকি চেক করা হয়। আর ঢাকা শহরে এর মধ্যে অনেক গাছ লাগানো হয়েছে। গাছ কাটা কমেছে। এখন আর সেরকম দমবন্ধ করা অনুভূতি আসে না।

তবু মাঝে মাঝে ফাপর লাগে। অস্থির হয়ে যাই। প্রাণটা আনচান করে একটু মুক্ত শীতল বিশুদ্ধ বাতাসের জন্যে। মনে হয় 'মুই এত্তি না থাকিম বায়, ফাপর নাগি মরি যাইম'। চলে যেতে ইচ্ছে করে পর্বতের উপরে যেখানে দাঁড়িয়ে ইচ্ছা মত নিঃশ্বাস নিব। হিমালয়ের গাইয়ে হাজার বছরের জমে থাকা বরফে ধাক্কা খেয়ে শীতল হাওয়া আমার নাক দিয়ে ধারালো ছুড়ির মতো ঢুকে যাবে ফুসফুসে আর কতে কতে পরিষ্কার করে ফেলবে জমে থাকা সকল অবসাদ আর নাগরিকের পাপের ময়লা।


গাছ ও বনের গুরুত্ব নিয়ে আমরা আগে চেয়ে সচেতন হয়েছি। এখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও জানে যে বন রক্ষা করতে হবে। বন রক্ষা করতে হবে নিজের জীবন রক্ষা করার জন্যেই। পরিবেশের ভারসাম্য ইত্যাদি এখন আর অভিনব কোন কথা না। এখন আমরা সকলেই জানি যে পশুপাখি বা বন্য প্রাণী বা বা সাপ ব্যাঙ বা মাছ বা কাঁকড়া বা কাউঠা বা মাটিতে বা পানিতে থাকা পোকা মাকড় শামুক ঝিনুক এমনকি মাইক্রো অরগানিজম এদের সকলেরই ভূমিকা আছে আমাদের পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে টিকিয়ে রাখার জন্যে।

সচেতনতা বেড়েছে ব্যক্তির মধ্যে এবং রাষ্ট্রের মধ্যেও। আমাদের রাষ্ট্র আইন কানুন বানিয়েছে পরিবেশ রক্ষার জন্যে। আমাদের আদালত মাঝে মাঝেই পরিবেশ ধ্বংসকারী 'উন্নয়নের' বিরুদ্ধে সাহসী রায় দেয় আর মানুষও তাকে স্বাগত জানায়। সরকারের মধ্যেও এখন পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রণালয় হয়েছে, অধিদপ্তর হয়েছে। কতো কিছু। সরকার পরিবেশের গুরুত্ব বোঝে।


তাইলে সরকার কি বুঝে না যে রামপালে বিদ্যুতকেন্দ্রটা করলে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে? সরকার কি বুঝে না যে সুন্দরবন ধ্বংস করা কেবল পর্যটন ব্যবসার ক্ষতি বা সৌন্দর্য বিনষ্ট করা নয়? সরকার কি বুঝে না যে সুন্দরবন ধ্বংস করলে আমাদের বেঁচে থাকা আরেকটু কঠিন হয়ে যাবে? সরকার তো সবই বুঝে। কেন বুঝবে না। সরকারে সকলেই তো বেকুব না।

আসলে সরকারের মন্ত্রী এবং বড় বড় আমলা এরা কেউই বেকুব না। এরা সকলেই সব কিছু বুঝেন এবং সব কিছু জানেন। তারপরেও তাইলে এরা কেন গোঁয়ারের মত রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করবোই এরকম গোঁ ধরে বসে আছেন?

আমি জানিনা। আপনারা উন্নয়ন দেখাতে চান, দেখান। বিদ্যুৎ জরুরী জিনিস। কিন্তু বিদ্যুতের জন্য পরিবেশ ধ্বংস করবেন কেন? সুন্দরবন ধ্বংস না করেও তো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। যুক্তিটা কি? কোন যুক্তি নাই।


সরকারের এমপি ও বিদ্যুৎ বিভাগের যেসব লোকের সাথে আমার কথা হয়েছে ওরা বলে কিনা, কেন, আমেরিকাতে তো লোকালয়ের মধ্যেও কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। আমরা করলে অসুবিধা কি? হ্যাঁ, ওরা একসময় সেরকম বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঠিকই বানিয়েছিল। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরেও কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে ওদের। কিন্তু এখন তো ওরা এগুলি আর বানাচ্ছে না। অনেক জায়গায় বন্ধ করে দিচ্ছে। আর যেগুলি চলছে সেগুলিও কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রিত। আর আপনারা যেখানে করছেন সেখানে তো ভাই সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে।

তবে কি সরকারের কোন অসৎ উদ্দেশ্য আছে? সুন্দরবন ধ্বংস করে ওদের কি লাভ? ওদের কি অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে? কাউকে ব্যবসা দেওয়ার মতলব হলে অন্যখানে দেন, সুন্দরবনের পাশে কেন? আপনাদের ঘুষ ইত্যাদি তো সুন্দরবন ধ্বংস না করেও খেতে পারেন।


কিন্তু সরকার কথা শুনবে না। কেন শুনবে না? দেশে কি গণতন্ত্র আছে যে কথা শুনবে? আর গণতন্ত্রের নামে যে ফরমাল জিনিসটা আছে সেখানেও তো ওরা একটা কায়দা করে বসে আছে। দেশের সকল বুদ্ধিমান মানুষের একটা বড় অংশ সরকারের তাবেদার সেজে বসে আছে। ওরা শেখ হাসিনার কথার মধ্যে কোন অবস্থাতেই কোন ত্রুটি খুঁজে পায়না। যাদেরকে আপনি প্রত্যাশা করেন মানুষের পাশে থাকবে, ওরা তো ঈমান বিক্রি করে বসে আছে।

আর আমাদের জমায়েতও তো সেরকম হচ্ছে না।

কথা তো তাইলে সেখানেই এসে ঠেকছে। যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি যারা আছেন তারা সকলেই যদি আওয়ামী লীগের ধামা ধরে বসে থাকেন তাইলে আওয়ামী লীগ একটা স্বৈরাচারী শক্তিতে পরিণত হবে। আর স্বৈরাচারের বৈশিষ্ট্য কি? স্বৈরাচারের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে মানুষকে উন্নয়নের বড়ি খাইয়ে ঘুম পারানোর চেষ্টা। আইয়ুব খান, জিয়াউর রহমান, এরশাদ এরা সকলেই কি এইরকম উন্নয়নের বড়ি বিক্রি করেনাই?


রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ওরা কি পাল্টাবে না? পাল্টাবে, যদি ওদের তক্তা উল্টে দেওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেন। এর আগে এরা আমাদের কথা শুনবে না।

ইমতিয়াজ মাহমুদ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ