আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ব্যক্তি নয়, প্রশাসক আতিউর রহমানের জন্যে ব্যর্থকাব্যের পঙক্তি

কবির য়াহমদ  

বাংলাদেশের রিজার্ভের অর্থ লোপাটের ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিও যে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয় সেটা কাগজকলমে থেকে বাস্তবে প্রমাণ হলো। এর বাইরে দুই ডেপুটি গভর্নরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, ব্যাংক ও আর্থিক বিভাগের সচিবকেও একই পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। দৃশ্যমান এ পদক্ষেপগুলো ব্যাংকিং খাতের বিশাল এক অরাজকতার বিপরিতে সরকারের কঠোর অবস্থানকে নির্দেশ করে। তবে এসবের বাইরে মুল কথা হলো শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ লোপাট হয়ে যাওয়া টাকাগুলো ফেরত পাবে কিনা! যদি না পাওয়া যায় তবে এটা দেশের জন্যে বিশাল এক আঘাত, একই সঙ্গে আর্থিক ও আস্থা হারানোর মত এক ক্ষতি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা লোপাটের ঘটনায় দেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে গণআস্থা হারানোর পথে- এটা বললে কি অত্যুক্তি হবে? ধারণা করি, হবে না। কারণ ব্যাংকিং ব্যবস্থার অভিভাবক প্রতিষ্ঠান যখন এমন অবস্থায় নিপতিত হয় তখন মানুষ কীভাবে অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর আস্থা রাখে। এটা মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা ছিল। হ্যাঁ, হয়ত দৃশ্যমানভাবে মনে হচ্ছে সাধারণ মানুষের সঞ্চিত অর্থের লোপাট হচ্ছে না, কিন্তু দেশের অর্থ ত হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে একজন গ্রাহক যখন নিশ্চিন্তে নিজের টাকা জমা রেখে স্রেফ একটা কাগজ হাতে নিয়ে চলে যায় তখন প্রমাণ হয় ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি তাদের অগাধ আস্থা। এ আস্থা ব্যাংকগুলো অর্জন করেছে রিটার্ন ও গ্রাহকের চাহিবামাত্র প্রদানের মাধ্যমে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এ বাধ্যবাধকতা নেহায়েত ব্যবসাই নয়, এটা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক কঠোর নিয়মের কারণে। দেশের সকল ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক- এটা গ্রাহকমাত্রই জানে। বাংলাদেশ ব্যাংক আছে সকল ব্যাংকের উপরে তাই এত আস্থা আর বিশ্বাস। কিন্তু খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকই যখন দেশের টাকা নিরাপদ রাখতে পারছে না তখন সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে এ নিয়ে প্রশ্নের জন্ম নিলে সেটাকে অতি অবশ্যই স্বাভাবিক ব্যাপার বলেও মেনে নিতে হবে বৈকি! ফলে ব্যাংকিং ভাষায় 'রেপুটেশনাল লস' বিষয়টির খপ্পরে পড়ল খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকই।

ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর এমন আঘাতের পর সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপই কাঙ্ক্ষিত ছিল। এটা নেওয়া না হলে ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভাবমূর্তিজনিত ক্ষতি থেকে উত্তরণ সম্ভব হতো না। এখানে মনে রাখা উচিত, এ অর্থ কেলেঙ্কারি দেশের কোন বাণিজ্যিক ব্যাংকের ছিল না, এটা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। গত কয়েক বছরে দেশের বেশ কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সরকারি ব্যাংকে আর্থিক ক্ষেত্রে অনেক অনিয়ম ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। সে সব ঘটনায় টাকার অংকে সে পরিমাণ হয়ত বাংলাদেশ ব্যাংকের লোপাটকৃত অর্থের পরিমাণের চাইতে কয়েকগুণ বেশি। কিন্তু ব্যবধানের জায়গা ছিল আগের প্রতিষ্ঠানগুলো স্বতন্ত্র এবং সেগুলোর ইন্টারনাল কালচার ও সার্কুলার সামগ্রিক ব্যাংকিংকে প্রতিনিধিত্ব করত না। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থা ভিন্ন, কারণ এ প্রতিষ্ঠানই দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার অভিভাবক। ব্যাংকিং ব্যবস্থা কিভাবে চলবে সেটা নির্ধারণ করবে এ বাংলাদেশ ব্যাংকই। ফলে অন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে এর তুলনা চলে না।

বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক সহ অন্যান্য জায়গায় লুটপাট হয়েছে। সে অংক হাজার কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে সাধারণ মানুষের সে সব টাকাগুলো দেশের বাইরে চলে গেছে। এসব ব্যাংকগুলো স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ ও নিজস্ব নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ছিল, কিন্তু তবু সেখানে লুটপাট হয়েছে। ঋণের নামে অর্থ লোপাট হয়েছে, যে ঋণগুলো দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে সব প্রতিষ্ঠানই। ফলে প্রাথমিক দায় তাদের ওপর বর্তায়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংক সেখানেও নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার আগেই সব শেষ হয়ে গেছে। অথচ সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখলে হয়ত এতদূর এগোত না। ফলে প্রমাণ হয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব বিধি-অনুযায়ি অথবা পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে যা-ই করুক না কেন, তবু সেখানেও বাংলাদেশ ব্যাংক যে কোন সময় যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এসব লুটপাটের কারণে নির্দিষ্ট সে সব ব্যাংকগুলো আর্থিক ও ভাবমূর্তিজনিত ক্ষতির সম্মুখিন হলেও সামগ্রিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর সে প্রভাব ছিল সামান্যই।  গ্রাহকেরা তখন নিজেদের আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সতর্ক হয়েছে সে সব ব্যাংকের প্রতি যেখানে অনিয়ম-লুটপাট হয় হামেশাই।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকের মত এধরনের লুটপাটের ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সম্পাদিত হলে এর প্রভাব পড়ত তফশিলভুক্ত অর্ধ-শতাধিক ব্যাংকের ওপরই। প্রশ্ন আসতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মত গ্রাহক-ব্যাংকিং করে না। বাংলাদেশের ব্যাংকের গ্রাহক হলো অন্যান্য ব্যাংকগুলো। সে গ্রাহকদের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকের মধ্যস্থতায় 'মানি মার্কেট' নামের এক ধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু আছে যেখানে এক ব্যাংক নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্যে সুদসমেত অন্য ব্যাংকের সাথে লেনদেন সম্পন্ন করে থাকে না। এটা এমনভাবে বিধিবদ্ধ যে এখানে ঋণখেলাপের কোন সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংক আর অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাজের ধরন, প্রভাব ও এদের ভাবমূর্তি ক্ষতিজনিত প্রভাবের ব্যাপ্তি বিচার করলে একটার সঙ্গে অন্যটার তুলনা করা যায় না। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের যেকোনো জালিয়াতির ঘটনা দেশের সামগ্রিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর প্রভাবের নির্দেশক। তাই একে বেসিক ব্যাংক, কিংবা সোনালী ব্যাংকের জালিয়াতির সঙ্গে তুলনা করে সরকার এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নিয়েছে, আর কী নেয় নি সে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক মনে হতে বাধ্য। সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক কিংবা বেসিক ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এবং সেখানকার ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত হলেও সে ব্যাংকগুলোর জালিয়াতি অথবা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে এমন না, কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থা ভিন্ন। দেশের কেন্দ্রীয় এ ব্যাংকটি দেশের মুদ্রানীতি ঘোষণা থেকে শুরু করে অন্যান্য ব্যাংকগুলোকেও নিয়ন্ত্রণের অধিকার সংরক্ষণ করে বলে সেখানকার যে কোনো ধরনের অনিয়মের কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য। ফলে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে আপাতদৃষ্টিতে কঠোর মনে হলেও শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগ যৌক্তিকতার মানদণ্ডে তাই মোটেও অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।

দেশের রিজার্ভের অর্থ লোপাটের ঘটনায় অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে তাঁর পদ ছাড়তে হয়েছে। এটা ঠিক যে, গভর্নর নিজে এ অর্থচুরির ঘটনায় জড়িত নয়, কিন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে জড়িত থাকার প্রেক্ষাপটে এর দায় তাঁকে শোধ করতে হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, অপরাধীর শাস্তি হয় কিনা। গভর্নরের পদত্যাগের পর অনেকেই তাঁর ব্যক্তিগত সততা, অর্জিত সাফল্যকে মুখ্য আলোচনার বিষয়বস্তু করে নিয়ে এর সমালোচনা করছেন। ড. আতিউর রহমান গভর্নর থাকাকালীন সময়ে তাঁর সততা ও সাফল্য দিয়ে অনেককেই মুগ্ধ করেছেন, এজন্যে তিনি বিভিন্ন সময়ে প্রশংসাবৃষ্টিতেও স্নাত হয়েছেন। সেটা তাঁর দায়িত্ব ছিল। তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন সে সব ক্ষেত্রে। কিন্তু তাঁর দায়িত্বের মধ্যেও ছিল দেশের টাকা অক্ষত রাখা, যা তিনি পারেন নি। তিনি হয়ত নিজ হাতে সেগুলো সরান নি, বা কাউকে উদ্ধুব্ধ করেন নি। কিন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠানের কারও মাধ্যমে এ কাজ সম্পাদিত হয়েছে বলে এর দায় তিনি এড়াতে পারেন না।

পদত্যাগের পর আবেগাপ্লুত হয়ে আতিউর রহমান অনেক কথাই বলেছেন। কিছু মিডিয়া তাঁর সে ভাষণকে 'বিদায় ভাষণ' হিসেবে আবেগের জলে আরেকটু আবেগ মিশিয়েছে। সাবেক গভর্নর তখন সে ভাষণে অর্থলোপাটের ঘটনার পর তাঁদের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের বর্ণনা দিয়ে জানান, "আমাকে যখন বলা হল, আমি এতোটাই পাজলড ছিলাম…. কয়েকদিন আগে এটিএম আক্রমণ হয়েছে, এখন আবার রিজার্ভের উপর আক্রমণ। আমাদের সমস্ত অর্থনীতিকে যেন ভেঙে না ফেলে সেই ভয়ে আমি তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছি, তাদেরকে বিদেশ থেকে এনেছি। তাদের এনে আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুরো সিকিউরিটি নিশ্চিত করেছি, যাতে ভবিষ্যতে আর ক্ষতি না হয়। পাশাপাশি কোথা থেকে কেমন করে এই ঘটনার উৎপত্তি ঘটল খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। এক্ষেত্রে আমি দেশের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটগুলোকে সঙ্গে নিয়েছি। প্রথম দিনই আমি এফআইইউয়ে (ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) এফআইআর করেছি এবং তাদের পরামর্শমতো কাজ শুরু করেছি। বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়েছি। ফিলিপিন্সের গভর্নরের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেছি। যেহেতু ইন্টেলিজেন্সের বিষয়- এগুলো গোপনীয়তার সাথে করতে হয়।"

ড. আতিউর রহমান 'অর্থনীতি ভেঙে পড়বে' এমন আশঙ্কায় তাৎক্ষণিকভাবে অর্থ মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে অন্যান্যদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, উদ্যোগ নিয়েছেন টাকাগুলো যাতে ফিরিয়ে আনা যায় সে সবের উল্লেখ করেছেন তাঁর সে 'বিদায় ভাষণে'। তিনি 'পাজলড' ছিলেন উল্লেখ করে আরও বলেন, "... গোটা ব্যাপারটা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছি, পরে চিঠি লিখে মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে জানিয়েছি। একটু সময় লেগেছে আমি অস্বীকার করি না। কিন্তু এই সময়টা আমি নিয়েছি দেশের স্বার্থে।"

এখানেই সমূহ বিপত্তি। তাঁর উচিত ছিল ঘটনার অব্যবহিত পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো। তাঁর চেষ্টা নিয়ে প্রশ্ন হয়ত ছিল না, প্রশ্নও নেই ব্যক্তিগত সততা নিয়ে। কিন্তু পেশাদারিত্বের এ যুগে আবেগের যোগ কতখানি যখন তিনি অর্থনীতি ভেঙে পড়ার আশঙ্কাপ্রকাশ করেন। এখানে তাঁর পেশাদারিত্বের যোগ হওয়া উচিত ছিল। অথচ এখানে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন আগাগোড়া। অফিস সংস্কৃতিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে কিছু করতে গেলে এবং সেখান থেকে ব্যর্থ হলে এর দায়শোধ অবধারিত। তাছাড়া তাঁর যে উৎকণ্ঠা ফুটে ওঠেছিল পদত্যাগের পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় নি পদত্যাগের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। তখন তাঁকে অনেকটাই নির্লিপ্ত মনে হয়েছিল। যার সবিশেষ প্রমাণ আইএমএফের সম্মেলনে যোগ দিতে দিল্লি গমন,এবং নির্ধারিত সময়ের ৪দিন পর দেশে ফেরা। সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের এ সফর এমন এক সময়ে হচ্ছিল যখন বাংলাদেশের রিজার্ভের অর্থলোপাটের ঘটনা নিয়ে কেবল দেশই নয়, সারাবিশ্বে তোলপাড় চলছে।

ব্যক্তি জীবনে ড. আতিউর রহমানের সততা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থার আধুনিকীকরণেও তিনি অনেক কাজ করেছেন। ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে তারা গৃহিত অনেক উদ্যোগের প্রশংসা করবে সকলেই। আজ এক ব্যাংকের চেক অন্য ব্যাংকে বসে পেমেন্টের যে সুযোগ আসছে সামনে তাও এ গভর্নরের পদক্ষেপ। ক্লিয়ারিং হাউজকে যেভাবে ডিজিটালাইজড করেছেন তিনি সেটা ইতিহাস মনে রাখবে। স্কুল ব্যাংকিং, কৃষকদের ১০টাকায় ব্যাংক একাউন্ট খোলা সহ অনেক পদক্ষেপ তিনি নিয়েছেন। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং ব্যবস্থা মানুষের কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছে। একটা সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর ছড়ি ঘোরাবার একটা প্রতিষ্ঠান ছিল, আতিউর রহমানের আমলে তার পরিবর্তন হয়েছে। সেটা 'ছড়ি' থেকে সেবায় রূপান্তর ঘটেছিল এসব নির্দ্বিধায় স্বীকার করবেন দায়িত্বশীলরা, এটা বিশ্বাস করি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশ ও ব্যাংক কর্তৃপক্ষের গোপন করার মারাত্মক ঘটনার বাইরে সদ্য সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান একজন সফল প্রশাসক সন্দেহ নেই। তাঁর পদত্যাগের পর অনেকেই আবার এ পদত্যাগকে মেনে নিতে না পেরে প্রশ্ন করছেন এর মাধ্যমে কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? অনেকেই আবার সব দোষ চাপাতে চান অর্থমন্ত্রীর ঘাড়ে। কেন? অর্থমন্ত্রীর কাজ কি ডিলিং রুম কিংবা ব্যাক-অফিসে গিয়ে সুইফট স্টেটমেন্ট চেক করা? তাঁর মন্ত্রণালয়ের কাজ কি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ একাউন্ট রিকনসিলেশন? এটা একই প্রতিষ্ঠানের অন্য ডিপার্টমেন্টেরও কাজ না। তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিদিন এসব স্টেটমেন্ট যায়, এবং তারা সেগুলো দেখে থাকেন। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যারা সম্পর্কিত তারা জানেন জেনারেল লেজার, একাউন্টস-ফাইনান্স আর ট্রেজারি অপারেশন যে কোন প্রতিষ্ঠানের প্রাণ। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি পুরো ঘটনা গোপন করে তাহলে অর্থ মন্ত্রণালয় কীভাবে সেটা জানবে, আর না জানলে তারা কীভাবে এ কেলেঙ্কারির দায় নেবে?

গভর্নরের পদত্যাগ পরবর্তী সময়ে অনেকেই আবার বলছে, হলমার্ক, শেয়ার বাজার, সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের লুটপাটের সময়ে অর্থমন্ত্রীকে এমন তৎপর কেন দেখা যায় নি, কেন পদত্যাগ করেন নি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর- এমনতর অগণন প্রশ্ন। হ্যাঁ, প্রশ্ন বটে! আগে যদি দায়দায়িত্ব মাথায় নিয়ে এমন কর্তাব্যক্তিদের পদ ছাড়তে হতো তাহলে অন্তত একটা সতর্কবার্তা ঝুলত সবার মাথার ওপরে। আগে হয় নি বলে কখনই হওয়া দরকার না- এমন যারা ভাবেন তারা আদতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তির অপেক্ষায় থাকেন। তাছাড়া এটাই মনে রাখা উচিত, অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যকার পার্থক্যের বিষয়টি। অন্যান্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জালিয়াতির কারণে, কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের যেকোনো ধরনের ক্ষতি মানে ব্যাংকিং সেক্টরেরই ক্ষতি।

বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় গভর্নরের এ পদত্যাগ ও অর্থমন্ত্রীর কঠোর অবস্থান যৌক্তিক মনে হয়েছে, কারণ দায়িত্বে অবহেলার দায়ভার কাউকে না কাউকে নিতেই হবে। অফিসিয়াল চেইন অব কমান্ড অনুযায়ী সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের নিম্নপদস্থ কাউকে বলবে না পদত্যাগের কথা। সরকারের কাছে জবাবদিহি করবেন গভর্নর। সরকারের কাছে যিনি জবাবদিহি করবেন তাঁর পদত্যাগ ও দায়ভার নেওয়াই বাঞ্ছনীয়। একই সঙ্গে এ ঘটনার জন্যে যারা দায়ি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। গভর্নরের পদত্যাগের মাধ্যমে প্রমাণ হলো সরকারের অবস্থান। এবং দায়িদের কাউকেই ছাড় না দেওয়ার ইতিবাচক মানসিকতা।

গভর্নরের পদত্যাগের মাধ্যমে অনেকেই বলছেন এর মাধ্যমে সমাধান হবে না, অথচ এরাও আবার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কোন ঘটনা ঘটলে দায়িত্বশীলদের দায়ভার নিয়ে পদত্যাগের উদাহরণ টানেন। অবাক করা ব্যাপার হলো, নিজ দেশে এমন ঘটনার জন্যে তারা উলটো যুক্তি দেখান। এমন মানসিকতা অবাককল্পনা নয়, এটা যে অবাকবাস্তবতা। এ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার বলে মনে করছি। কারণ, যেকোনো ঘটনায় সরকারের দায়িত্বশীলতার সাথে সাথে কঠোর সিদ্ধান্ত ভবিষ্যৎ যেকোনো নেতিবাচক ঘটনার পথকে রুদ্ধ করতে পারে।

আমাদের দেশে দায়িত্বে অবহেলার কারণে, কোনো প্রতিষ্ঠানের কেলেঙ্কারির পর সেসব প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদত্যাগ, অপসারণ কিংবা পদচ্যুতির ঘটনা বিরল। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগের কারণে এর হোক শুরু। হ্যাঁ, তিনি স্ব-ইচ্ছায় এটা করেন নি, পারিপার্শ্বিকতা ও সরকারের অপ্রত্যক্ষ চাপ তাঁকে বাধ্য করেছে পদত্যাগে। এবার বিভিন্ন পর্যায়ের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার রহস্য উদঘাটন করা দরকার। এপর্বে এ পদত্যাগ বিশাল কাজ করবে, কারণ সরকারের নিয়োগকৃত লোককে যদি সরকার বাধ্য করে পদত্যাগে তাহলে অপরাধীরা রেহাই পাবে না- এ বার্তা পৌঁছেছে নিশ্চয়ই। তবে পদত্যাগ চূড়ান্ত সমাধান নয় এ জনভাবনার সাথে আংশিক একমত হয়ে বলি, পদত্যাগ সমাধান না এটা চূড়ান্ত সত্য নয়। গভর্নরের এ পদত্যাগ সমাধানের যাত্রাশুরুর নির্দেশক, একই সঙ্গে সতর্কবার্তা। আমাদের উচিত একে স্বাগত জানানো!

একজন সৎ, সজ্জন, নির্লোভ অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান- এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই। কিন্তু সরকার, প্রতিষ্ঠান চাইবে দক্ষ প্রশাসক। তাঁর দক্ষতা উল্লেখযোগ্য কিন্তু প্রশ্নাতীত নয় বলেই দেশের ইতিহাসে এমন বড় ঘটনা ঘটেছে। যাকে প্রাথমিকভাবে 'হ্যাকিং' বলে দায় চাপিয়ে নিতে চেয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ অর্থলোপাটের ঘটনা হ্যাকিং নয়, চুরি। ওয়েবের মাধ্যমে সম্পাদিত হলে এটাকে হ্যাকিং বলা যেতো, কিন্তু এ অর্থলোপাট হয়েছে বিভিন্ন দেশে সুইফট বার্তার মাধ্যমে সম্পাদিত লেনদেনে, যেখানে একজন বা দুইজন ব্যক্তি দ্বারা সম্ভব নয়। একটা সংঘবদ্ধ চক্র এ কাজটা করেছে। দিনকার চেকিংয়ের মাধ্যমে পরের কর্মদিবসে যা টের পাওয়া সম্ভব ছিল, অথচ সেটাও করা হয় নি। ফলে এর দায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিদের ওপরই বর্তায়।

পেশাগত দক্ষতার এ যুগে আবেগের মূল্য নেই। অর্থনীতি ভেঙে পড়বে বলে কাউকে জানাই নি এমন অজুহাত দেখানোরও সুযোগ নেই। তাই ড. আতিউর রহমানের 'বিদায় ভাষণ' স্রেফ ব্যর্থতা ডাকার এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা হিসেবেই পরিগণিত হয়। আমার বিশ্বাস, তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে বিভিন্ন সভা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে তিনি নিজেও পেশাগত দক্ষতা অর্জনের জন্যে অনেককেই পরামর্শ দিয়েছেন (ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিম্নপদস্থদের এমনটাই দিয়ে থাকেন), কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে খুব কঠিন এক সময়ে খানিকটা অলক্ষ্যে হয়ত পেশাদারিত্বের চাইতে আবেগকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। যার খেসারত দিলো পুরো দেশ, একই সঙ্গে দেশের সামগ্রিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাও।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হোক, আর অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক হোক সেখানকার কেলেঙ্কারি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কেলেঙ্কারির মধ্যকার অনেক পার্থক্য। অন্যান্য ব্যাংকগুলো দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের একেকটা অংশ হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক হচ্ছে মেরুদণ্ড। বাংলাদেশ ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংকগুলোর অভিভাবক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখানকার কেলেঙ্কারির বিপরিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে ভুল বার্তা যেত সকলের কাছে।

ড. আতিউর রহমান ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায় যেভাবেই পদত্যাগ করুন না কেন তিনি অবশ্যই তাঁর ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে পদত্যাগ করেছেন। অফিস সংস্কৃতিতে সাফল্যের জন্যে যেমন অভিনন্দিত হওয়ার সুযোগ থাকে, তেমনি ব্যর্থতার জন্যেও থাকে বিপরিত কিছু। তাঁর এ পদত্যাগে ব্যক্তি আতিউর রহমানের জন্যে দুঃখগাথা লেখা হলেও, প্রশাসক আতিউর রহমানের জন্যে থাকবে হয়ত ব্যর্থকাব্যের কতিপয় পঙক্তি।

কবির য়াহমদ, প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর; ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ