প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জহিরুল হক বাপি | ২৫ মার্চ, ২০১৬
অপারেশন সার্চ লাইটে ঢাকায় হত্যা করা হয় অসংখ্য মানুষ। বিদেশি পত্রিকায় এ সংখ্যা ১০,০০০ থেকে ১ লাখ পর্যন্ত। পাকিস্তানের দোসর আমেরিকানদের পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসের এপ্রিলের ১ তারিখে খবরে এ সংখ্যা ৩৫,০০০, সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের মার্চ মাসের ২৯ তারিখে প্রকাশ করে ২৫ মার্চে ঢাকায় নিহতের সংখ্যা নিম্নে ১০,০০০ থেকে ১ লক্ষ পর্যন্ত হতে পারে। ধ্বংসযজ্ঞ এতই নৃশংস এবং ভয়াবহ যে এই মুহূর্তে সঠিক পরিসংখ্যান সম্ভব নয়।
এ অপারেশন ১০ এপ্রিল পর্যন্ত চলার কথা থাকলে চলেছে নয় মাস। নাকের পানি, চোখের পানি এক করে পাকিস্তানিরা চলে গেছে। কিন্তু ২৫ মার্চ থেকে পরবর্তী নয় মাস যে বিভীষিকা এঁকে গেছে এ দেশের ভূমিতে তা ভুলতে আরও কয়েক শতাব্দী লাগবে।
আসুন জেনে নেই ২৫ মার্চের অপারেশন নিয়ে পাকিস্তানিদের সামরিক ইতিহাস।
পরিকল্পনার সিদ্ধান্ত:
২৫ মার্চের অপারেশন সার্চ লাইটের প্রস্তাব করা হয় ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের এ প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। প্রস্তাব পাশ হওয়ায় মার্চের শুরুতে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি ও ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা অপারেশনের পরিকল্পনা তৈরি করে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েতা হতে ১৬তম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এবং খরিয়ান থেকে ১৯তম ডিভিশনকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার আদেশ দেয়া হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের জি.ও.সি লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এস এম আহসান পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের উপর সামরিক হামলার প্রবল বিরোধী ছিলেন বলে অপারেশনের আগেই তাদেরকে দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান ফেরত পাঠানো হয়।
লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও একই সাথে জি.ও.সি করে পাঠানো হয়। মার্চের ১৭ তারিখ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সি.ও.এস জেনারেল হামিদ টেলিফোনে জেনারেল রাজাকে অপারেশনের মূল পরিকল্পনা করার দায়িত্ব দেয়। ঢাকা সেনানিবাসের জিওসি কার্যালয়ে বসে জেনারেল রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি অপারেশনের পরিকল্পনা তৈরি করে ১৮ মার্চ সকালে। পরিকল্পনাটি জেনারেল ফরমান হালকা নীল রঙের একটি অফিস প্যাডের ৫ পাতা জুড়ে লিড পেন্সিল দিয়ে নিজ হাতে লিখে নেয়।
জেনারেল ফরমান অপারেশনের সিদ্ধান্ত এবং সাফল্যের শর্ত ইত্যাদির পয়েন্ট আউট করে।বিভিন্ন ইউনিটের এলাকা ও দায়িত্ব বণ্টনের দায়িত্বে ছিল জেনারেল খাদিম। অপারেশনের নৃশংসতা দেখে বাঙালি সৈনিকরা বিদ্রোহ করতে পারে এ সুনির্দিষ্ট চিন্তা থেকে অপারেশন শুরুর আগে বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র এবং অপারেশন শুরুর সাথে সাথে রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার অপারেশন সফলের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হিসাবে ধরা হয়।
‘অপারেশনের সব কিছুই নির্ধারিত হল’ - হাতে লিখিত পরিকল্পনাটি ২০ মার্চে আবার জেনারেল হামিদ এবং লে. জেনারেল টিক্কা খান আলোচনায় বসে। জেনারেল হামিদ তাৎক্ষণিকভাবে বাঙালি সেনা ইউনিটগুলোকে নিরস্ত্র করার সিদ্ধান্ত নিলেও বিভিন্ন বিবেচনায় তখন ই.পি.আর, আর্মড পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীকে নিরস্ত্র করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইয়াহিয়া খান তার সাথে অপারেশন নিয়ে বৈঠকের সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতারের পরিকল্পনা আপাত বাদ দেয়। পুনঃনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয় এবং বিভিন্ন এলাকার কমান্ডারদের কাছে বিতরণ করে দেয়া হয়।
অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর সময় নির্ধারিত হয় জিরো আওয়ার বা রাত বারটা। ফোনের মাধ্যমে সব ইউনিটকে সময়ের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়।
ঢাকার সৈন্যদের কমান্ডে ছিল রাও ফরমান আলি এবং অন্যান্য সব স্থানের সৈন্যদের কমান্ডে ছিল জেনারেল খাদেম। জেনারেল টিক্কা এবং তার কর্মকর্তারা ৩১তম কমান্ড সেন্টারের সব কিছু তদারক করা এবং ১৪তম ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সহযোগী হিসাবে ছিল।
সাফল্যের জন্য অবশ্যই করণীয়:
১) শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগ ও বাঙালির মনে ভুল ধারণা দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া খান আলোচনার অভিনয় চালিয়ে যাবে। যে কোন ছল-চাতুরী করে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আলোচনায় বাঙালিকে ব্যস্ত রাখতে হবে। সামরিক কারণেই সময় দরকার। সময়ের হের ফের হওয়া যাবে না। আওয়ামী লীগের মনে ভুল ধারণা সৃষ্টি করে তাদের ব্যস্ত রাখার জন্য ইয়াহিয়া খান আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার অভিনয় করবেন। এমনকি ভুট্টো যদি আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে রাজি হয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, তবুও ইয়াহিয়া আলোচনা চালিয়ে যাবেন।
২) পূর্ব পাকিস্তানের নির্ধারিত জেলা/থানা/শহরগুলোতে একই সাথে আক্রমণ, নিধন শুরু করতে হবে। সময়ের হের ফের হতে পারবে না। একই সাথে আক্রান্ত হওয়ার ফলে কেউ কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না।
৩) রাজনৈতিক ও ছাত্র নেতা, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের গণহারে গ্রেফতার।
৪) ঢাকায় অপারেশন ১০০% সফল হওয়া বাধ্যতামূলক। ঢাকা অপারেশন সফল করার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ, দখল ও তল্লাশি।
৫) সেনানিবাসকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনে উন্মুক্ত ও সর্বোচ্চ অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়।
৬) রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ সহ সকল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে।
৭) পূর্বপাকিস্তানি বাঙালি সকল সৈন্যকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে হবে।
২৫ মার্চ আক্রমণের এলাকাগুলো ছিল- ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, যশোর, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুর। এসব স্থানে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য বেশি পাঠানো হয়। পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য স্থানে অবস্থিত সৈন্য এবং প্যারা মিলিটারি বাহিনী নিজ নিজ এলাকা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে থেকে যাবে এবং প্রয়োজন হলে অন্যান্য স্থানে প্রাথমিক অপারেশনের সময় যোগ দেবে। ঢাকা সম্পূর্ণ দখলে এলে ৯,১৬ ডিভিশন আকাশ পথে ঢাকা আসবে। চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর, রংপুর, কুমিল্লা, সৈয়দপুর যেসব শহরে বিমানঘাঁটি বা বিমানবন্দর আছে সেসব শহরে সরাসরি ঢাকা থেকে C130 বিমান অথবা হেলিকপ্টারে সৈন্য পাঠানোর ব্যবস্থা রাখা হয়।
৮) হত্যাকাণ্ডের খবর যাতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে না পৌঁছায় সে লক্ষ্যে ২৫ মার্চের আগেই বিদেশী সাংবাদিককে ঢাকা ত্যাগ।
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি দমনের অপারেশন সার্চ লাইট শেষ করার নির্দিষ্ট সময় ছিল না। তবে বলা ছিল যত দ্রুত সম্ভব।
রসদপত্র ব্যবস্থাপনা :
রসদ, গোলাবারুদ বণ্টনের জন্য মেজর জেনারেল আলি মির্জা এবং ব্রিগেডিয়ার হ্যারিসন বাংলাদেশে আসে মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। তখন অসহযোগ আন্দোলনের কারণে সেনানিবাসগুলোতে খাদ্য সরবরাহ বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছিল। অস্ত্রের মূল ভাণ্ডার ছিল ঢাকার পাশের রাজেন্দ্রপুরে (গাজীপুর)।
চট্টগ্রামে এম.ভি সোয়াত জাহাজে ৯০০০ টন অস্ত্র ও গোলাবারুদ খালাসের অপেক্ষায় ছিল। জাহাজ থেকে রসদপত্র খুব দ্রুত খালাসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এ অস্ত্র খালাসের জন্য মেজর জিয়াউর রহমান দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়। কিন্তু জনসাধারণের বাধায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিবেদিত অফিসার জিয়া ফিরে আসতে বাধ্য হয়। এর ভিতর ১৩-এফ.এফ এবং ২২-বেলুচ রেজিমেন্ট ঢাকায় চলে আসে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ফ্লাইটে সেনাবাহিনী ও অন্যান্য সামরিক বাহিনীর সদস্যারা অতি গোপনে ঢাকা পৌঁছাতে থাকে। সফলতা নিশ্চিত করতে ২৫ মার্চের আগেই পশ্চিম থেকে পুরো একটি ব্রিগেড পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। পূর্বে আসা নতুন সৈনিকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অনেক নতুন নতুন ব্যবস্থা করতে হয়। ব্রিগেডিয়ার হ্যারিসন রসদপত্র ব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকায় ছিল, পশ্চিমে কার্যক্রম সামাল দিতে জেনারেল মির্জা আবার পাকিস্তান ফিরে যায়।
অপারেশনের আগের বিভিন্ন পদক্ষেপ :
অপারেশন শুরু আগে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব শত ভাগ বুঝিয়ে দেওয়া অপারেশনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল।এই কাজটি করা হয় সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রেখে। অস্ত্রশস্ত্রের যোগান, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের একত্রিত করা, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অতিরিক্ত সৈনিক বাংলাদেশে আনা, আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের কার্যক্রমের নির্দেশনা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পরিমাণ গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়।
মার্চের ২৪ ও ২৫ তারিখ দিনে পাকিস্তানি উচ্চ পর্যায়ের জেনারেলদের একটি দল হেলিকপ্টারে বিভিন্ন এলাকায় সেনা বাহিনীর প্রস্তুতি দেখতে যায় এবং প্রয়োজন মতো নির্দেশ দেয়।
দলের সাথে ছিল জেনারেল হামিদ, জেনারেল মিঠঠা, কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল, প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার কর্নেল সাদউল্লাহ। জেনারেল ফরমানকে যশোরে পাঠানো হয়, জেনারেল খাদিম কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের গ্যারিসন কমান্ডারদের ব্রিফ করে এবং ব্রিগেডিয়ার ইদ্রিস ও কর্নেল সাদুল্লাহ রংপুর সফরে যায়। [না জানালেই নয় এমন কিছু ক্ষেত্রে কয়েকজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ছাড়া বিস্তারিত জানতো কয়েকজন উচ্চ পদস্থ ও উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সেনা কর্মকর্তা।]
সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য বদলী:
সামরিক বাহিনী বাঙালি কর্মকর্তাদের স্পর্শকাতর স্থানগুলো থেকে বদলী শুরু হয় সূক্ষ্ম কৌশলে। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত দুটি সেনা ইউনিট ২৫ পাঞ্জাব ও ২০তম বেলুচের পাকিস্তান ফিরে যাওয়ার সময় ছিল তখন। কিন্তু তাদের না পাঠিয়ে বাংলাদেশেই রেখে দেওয়া হয়। ২৫ মার্চের আগে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় উড়ে আসে ২২-বেলুচ রেজিমেন্টও ১৩-ফ্রন্টিয়ার ফোর্স। গোপনীয়তার স্বার্থে ২৫ মার্চের আগে পূর্ব পাকিস্তানের অন্য কোন গ্যারিসনে বাড়তি সৈন্য পাঠানো হয় নাই।
বাঙালি ব্রিগেডিয়ার এম.আর মজুমদার চট্টগ্রামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গুলি বর্ষণে অস্বীকৃতি জানিয়ে এমভি সোয়াত এর মালামাল খালাসের কাজে বাঁধা সৃষ্টি করেন। তাকে ২৪ মার্চ তাকে ঐ স্থান থেকে অব্যাহতি দিয়ে জয়দেবপুরে গিয়ে ২-ই.বি.আর এ রিপোর্ট করার নির্দেশ দেয় জেনারেল খাদিম। বিগ্রে. মজুমদারে বদলে ব্রিগেডিয়ার এম. এইচ. আনসারীকে চট্টগ্রাম এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২২ মার্চ ঢাকায় অবস্থানরত ৫৭-ব্রিগেড এর বাঙালি অফিসার মেজর খালেদ মোশাররফকে বদলি করে কুমিল্লায় ৪-ইবিআর এর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পাঠানো হয়। ২৩ মার্চ ২-ইবিআর এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মাসুদুল হাসানকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ২৫ মার্চ তার জায়গায় দায়িত্ব গ্রহণ করে লে. কর্নেল রকিবউদ্দিন। পাকিস্তানিরা গণহারে বাঙালি কর্মকর্তাদের বদলি করে নাই গোপনীয়তার স্বার্থে। তারা খুব সচেতন ছিল যেন বাঙালি অফিসার বা সৈন্যদের মনে বদলী নিয়ে কোন সন্দেহ না ঘটে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সব ছুটির দরখাস্ত বাতিল করে দেয়ার পরও মার্চে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ আবার বাঙালি অফিসারদেরকে ছুটি নিতে উদ্বুদ্ধ করে, অন্যদিকে পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল এবং নতুন ছুটি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয় । পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তা ও সৈন্যদের পরিবারের সদস্যদেরকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়।
২৫ মার্চের আগে বাঙালি ইউনিট:
ট্যাকনিক্যাল কারণে অভিজ্ঞ জেনারেল খাদিম বাঙালি ইউনিটগুলোকে এক সাথে নিরস্ত্র করে নাই। এতে বিপদের আশঙ্কা বাড়তো। সময়ের আগেই অপারেশন শুরু করতে হতে পারতো। এর বিপরীতে খাদিম ২৫ মার্চের দিন এবং এর আগে সুযোগ সুবিধা মতো বাঙালি ইউনিটগুলোকে ছোট ছোট ভাগ করে বিভিন্ন উছিলায় সেনানিবাসের বাইরে পাঠায় এমন ভাবে যাতে একাংশের সাথে আরেকাংশের যোগাযোগ, দেখা কোন ভাবেই না হয়। সবগুলো অংশকেই রেডিও, ওয়ারল্যাস যোগাযোগের গ্রিড থেকে যত সর্বোচ্চ দূরে রাখা হয়।
অন্যান্য সময়ের তুলনায় ১-ইবিআর এর শক্তি ছিল অর্ধেক। ইবিআরকে শীতকালীন প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্তবর্তী চৌগাছায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ২-ইবিআর এর কোম্পানিগুলোকে ঢাকার আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাঠানো হয় এবং তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকেজো রাখা হয়। ৩-ইবিআর এর কোম্পানিগুলোকে ছড়িয়ে দেয়া হয় সৈয়দপুর সেনানিবাসের বাইরে গোড়াঘাট ও পার্বতীপুর । ৪-ইবিআর ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও শমসেরনগর এর মাঝামাঝি এলাকায়। একমাত্র চট্টগ্রামেই নিয়মিত বাঙালি ইউনিটগুলোকে সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয় নাই ।
পশ্চিম পাকিস্তানের ইপিআর বাহিনীর কোম্পানিগুলোকে শহরের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হয়। বাঙালি ইপিআর বাহিনীকে সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকাগুলোতে পাঠানো হয় বিশেষ প্রয়োজন দেখিয়ে। ২৪/২৫ মার্চ রাতে ই.পি.আর এর রেডিও যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়।
ঢাকা আক্রমণের পরিকল্পনা :
১. ৩২-পাঞ্জাব রেজিমেন্ট রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ।
২. ৩১তম ফিল্ড রেজিমেন্ট মোহাম্মদপুর এবং মিরপুর আক্রমণ।
৩. ২২-বালুচ রেজিমেন্ট ইপিআর বাহিনীকে নিরস্ত্র এবং ইপিআর সদর দফতরের ওয়্যারলেস ব্যবস্থা দখলে।
৪. ১৩-সীমান্তবর্তী ইউনিট ক্যান্টনমেন্টে রিজার্ভ ফোর্স হিসাবে থাকবে এবং নিরাপত্তা।
৫. ১৮-পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ছিল পুরান ঢাকা এবং নবাবপুরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
৬. ৪৩-হালকা বিমানবিধ্বংসী বাহিনী তেজগাঁও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা।
৭. 3-SSG এর একটি প্লাটুন শেখ মুজিবকে গ্রেফতার।
৮. ২২-বেলুচ, ৩২-পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
৯. ২২-বেলুচ রেজিমেন্ট পিলখানার শক্তি বৃদ্ধি করবে।
চট্টগ্রামে আক্রমণের পরিকল্পনা:
১) ই.বি.আর সি ইউনিট, ৮-ই.বি.আর, ই.পি.আর এবং পুলিশ বাহিনীকে নিরস্ত্র করা।
২) পুলিশের অস্ত্রশস্ত্র, রেডিও স্টেশন এবং টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখল অপারেশনের শুরুতেই।
৩) পাকিস্তানি নৌবাহিনীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করা।
৪) লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী সহ আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতার বা হত্যা করা।
২৬ মার্চে কুমিল্লা থেকে আগত ৫৩-ব্রিগেড চট্টগ্রাম গ্যারিসনের শক্তি বৃদ্ধি করে। চট্টগ্রামের মতোই অন্যান্য জায়গাগুলোতে পাকিস্তানি বাহিনীর পরিকল্পনা ছিল একই।
সামরিক বাহিনী :
সেনা
*১৪-ডিভিশন এবং ৫৭- ব্রিগেডও ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। নিয়মিত সেনা ইউনিট: ৫৭তম ব্রিগেড সাথে ১৮ এবং ৩২-পাঞ্জাব, সি.ও- লে.কর্নেল তাজ *১৩-সীমান্তবর্তী রেজিমেন্ট *২২-বেলুচ রেজিমেন্ট * ৬০৪-ইন্টেলিজেন্স ইউনিট * ৩১-গোলন্দাজ বাহিনী ।
*** ১৪-ডিভিশন সদর দফতরের সাথে নিম্নলিখিত ইউনিট গুলো যুক্ত ছিল। *৪৩-হালকা বিমানবিধ্বংসী রেজিমেন্ট,সি.ও লে.কর্নেল সাফফাত আলি *৩-কমান্ডো ব্যটেলিয়ন,সি.ও- লে.কর্নেল জেড.এ খান, ১৯-সিগন্যাল কোর, সি.ও- লে.কর্নেল ইফতেখার হুসাইন *১৪৯-পদাতিক বাহিনী।
*পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর সর্বচ্চ শক্তি তেজগাঁও বিমানবন্দরে প্রস্তুত রাখা হয় ।
* ২৯তম অশ্বারোহী রেজিমেন্ট থেকে এক স্কোয়াড্রন M24 শ্যাফি ট্যাঙ্ক ঢাকায় আন হয়।
সকল ইউনিটের সংযুক্তি হিসাবে ৫৭তম ব্রিগেড, ১৪তম ডিভিশন এবং পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সদর দফতর থেকে সাহায্যকারী ইঞ্জিনিয়ারিং, সরবরাহকারী ও চিকিৎসা ইউনিট ঢাকায় অবস্থান নেয়।
*৫৭-ব্রিগেডে ঢাকায়। দায়িত্বে ছিল ব্রিগেডিয়ার জাহানবাজ
* ৫৩-পদাতিক, কুমিল্লা। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির অধীনে।
* ২৩-ব্রিগেড রংপুর ।সি.ও ব্রিগেডিয়ার আবদুল্লাহ খান মালিক ।* ১০৭-ব্রিগেড, যশোর। ।সি.ও ব্রিগেডিয়ার এ.আর দুররানির ।
বিমান
ঢাকা বিমান ঘাঁটিতে বিমান বাহিনীর ৩টি টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমান ছিল ও ২০টি এফ-৮৬ সাবের জেট ছিল। সশস্ত্র বাহিনীর এক স্কোয়াড্রন এমআই-৮ এবং এ স্কোয়াড্রেন এলট। হেলিকপ্টার পূর্ব পাকিস্তানে আনা হয় অপরেশন সার্চ লাইটের কারণে। সি-১৩০ হারকিউলিস ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেটের, যশোরে, রংপুর, লালমনিরহাটে, ঠাকুরগাঁয়ে বিমানঘাঁটি তৈরি করা হয়।
নৌ ঘাটি
পূর্ব পাকিস্তানে নৌবাহিনীর চারটি গানবোট, একটি পেট্রোল বোট ও পিএনএস জাহাঙ্গির নামে একটি ডেস্ট্রয়ার ছিল। এগুলো রাজশাহী, যশোর , কুমিল্লা এবং সিলেটের নৌ ঘাটিতে ছিল। পাকিস্তানি নৌবাহিনীর পি.এন.এস বাবুর অপারেশন শুরুর পর পূর্ব পাকিস্তানে আসে। বেশির ভাগ নৌঘাঁটিই ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম ও মংলায়।
বিশেষ প্রয়োজনে সাবমেরিন পি.এন.এস গাজি প্রস্তুত রাখা হয়।যা পরবর্তীতে যোগ দেয়।
কতটা নৃশংস ছিল পাকিস্তানিদের পরিকল্পনা তা নতুন করে খোজার কিছুই নেই। সহজেই আজ বলা যায় পাকিস্তানে আসলে কোন সেনাবাহিনী নাই। আছে লোভী, অহংকারি, চুড়ান্ত বর্বর, স্রষ্টার শত্রু কিছু খুনী। নাহলে ঠান্ডা মাথায় ঘুমন্ত নিরীহ মানুষের উপর এমন সামরিক আক্রমনের পরিকল্পনা কি ভাবে সম্ভব।
এ দেশের অনিয়ম দেখলে এখনও অনেকে বলে উঠে পাকিস্তান আমল ভালো ছিল। পাকিস্তান থাকলে ভালো হতো। জনাব একটু অনিয়ম সহ্য করতে পারেন না? পাকিস্তানিদের ঐ রাতের নৃশংসতা কিভাবে সহ্য করে পক্ষ নেন? পশ্চাদপদেশ আর মূখ এক নয়।
“আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা- কারো দামে পাওয়া নয়”
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য