আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বঙ্গবন্ধুর ‘মাজার’ ও হারিয়ে যাওয়া ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি

মাহমুদুল হক মুন্সী  

মাজার একটি আরবি শব্দ, যা এখন শুধু বাংলাতেই ব্যবহৃত হয়। শব্দটি ফারসি দরগাহ শব্দের প্রতিশব্দ। এর ধাতুগত অর্থ ‘যিয়ারতের স্থান’। মাজার বলতে সাধারণত আউলিয়া-দরবেশগণের সমাধিস্থলকে বোঝায়। মাজারকে রওযা বা কবরও বলা হয়। এর নিকটবর্তী স্থানে মসজিদ, মাদ্রাসা, মকতব ইত্যাদি গড়ে ওঠে।
 
বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থলকে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের দ্বারা “মাজার” হিসেবে অভিহিত করতে দেখি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলিতে।
 
শামসুল হকের প্রতিষ্ঠিত “পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ”  কে ভাসানীর প্রচেষ্টায় “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ”  করার প্রক্রিয়ায় দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের যে ভূমিকা, তার পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে বাংলা দেশ স্বাধীন হবার পর যে সংবিধান রচিত হয়, তার মূল ভিত্তিগুলির মধ্য দিয়ে। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ছিলো সে সংবিধানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মূল চেতনার লিখিত রূপ।
 
মধ্যযুগীয় চিন্তা চেতনার ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ও অর্থনৈতিক শোষণ নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে পুঞ্জিভূত গণক্রোধ যে অবিস্মরণীয় নেতার হাত ধরে মুক্তির পথ দেখেছিলো সে পর্বতসম ব্যক্তিত্বের নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
 
একটি মুসলিম প্রধান জনগোষ্ঠীকে সেক্যুলারিজমের পথ দেখিয়েছিলেন যে নেতা, তিনি বলেছিলেন, ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। যে পাকিস্তানি ভাবধারার বিষবৃক্ষ বাংলাদেশের মাটিতে পোঁতা ছিলো, তার শেকড় বহুদূর বিস্তৃত। তারা স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবকে নাস্তিক ও পবিত্র ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ভাঙ্গার দোষে দোষী সাব্যাস্ত করে থাকতো। বোধকরি সে ষড়যন্ত্রের গুজব থেকে বাঁচতেই তাঁর এই উক্তি।
 
তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে উপড়ে ফেলা সেই বিষবৃক্ষের রয়ে যাওয়া শেকড় থেকে আবার গজায় মধ্যযুগীয় ধর্মের ডালপালা। পরবর্তী শাসকদের কেউ সেই গাছের গোড়ায় পানি ঢেলে, কেউ পরিচর্যা দিয়ে সুপুষ্ট করে তোলে বাংলার বুকে।
 
পঁচাত্তর থেকে ছিয়ানব্বই, এই সময়ে গড়ে ওঠা সমাজ, সংস্কৃতি রক্ষা করে যায় সে বিষবৃক্ষকে। সামাজিক-অর্থনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা সে বিষবৃক্ষের ডালগুলিও হয়ে ওঠে একেকটি মহিরূহের সমান শক্তিশালী। বুঝে ওঠার আগেই খেই হারাতে হয় শেখ মুজিবের দলকে। পরবর্তীতে আবার যখন ক্ষমতায় আসেন, ততদিনে বেশ পরিপক্ব বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি।
 
তারা সেই বিষবৃক্ষের ডাল পালা ছাঁটেন, তবে মনে এটাও জানেন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে যাওয়া শেকড়ের এই বৃক্ষের বিশ-বাইশটি ডাল ছাঁটলেই হবে না। সে বঙ্গবন্ধুও নেই, সে বাংলাদেশও নেই। বুদ্ধিবৃত্তিক সেক্যুলার জনগোষ্ঠী মাদ্রাসাভিত্তিক অন্ধকারের পাল নয় যে বর্বর আরবের ধর্মীয় নেতার নামে তাঁদের মুহূর্তের মধ্যে রাস্তায় নামানো যাবে।
 
এদিকে ক্ষমতার হাল ছাড়লেও তাঁরা যাবেন নিশ্চিহ্ন হয়ে। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলেন অভিযোজনের। যে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে তারা আওয়ামীলীগ হয়েছিলেন, ফিরে যেতে চাইছেন আবার সেই জন্মের দোরগোড়ায়। নিজের সমর্থকদের উপর, নিজের শক্তির উপর তাদের আর ভরসা নাই। কারণ নষ্ট রাজনীতিতে টিকে থাকতে তারা দলে ঠাঁই দিয়েছেন ব্যবসায়ী-হাইব্রিড-আদর্শহীন মুনাফালোভীদের।
 
এর মাঝে ঢুকে পড়েছে ভেড়ার ছাল পরা নেকড়ের দল। এরা সুযোগ পেলেই এখন থাবা চালাচ্ছে দলের ভেতর রয়ে যাওয়া বিরল সেক্যুলার ধ্যান ধারনার রাজনৈতিকদের উপর। মূল শক্তি এখন ইসলামী ব্যাংকের ফিতা কাটে, হাসিমুখে জামাত নেতা দলে ঢোকায় আর সেক্যুলার নীতির কথা বলাদের লাথি মেরে দল থেকে দূরে পাঠানোর চেষ্টায় রত।
 
আওয়ামীলীগের বুদ্ধিজীবীদের একজন হিসেবে পরিচিত এক ভদ্রলোকের সাথে একটি টকশোতে কথা বলছিলাম। টক শোর মাঝে তিনি হুট করে বলে বসলেন, উদার মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমি তার কথার প্রতিবাদ করেছিলাম বটে, চিন্তার স্থানে বড় একটি ধাক্কাও খেয়েছিলাম। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র পাল গুটিয়ে তাহলে এখন “উদার মুসলিম” রাষ্ট্রের হাল ধরেছে আমার আদর্শগতভাবে প্রিয় আওয়ামীলীগ?
 
ছাত্রলীগের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নেতা এসে যখন খুন করে ফেলার হুমকি দেয় আমার নাস্তিকতার জন্য, তখন আমি আসলে খুব অবাক হই না। সে তার কেন্দ্রীয় ছাত্র নেতা ও মূল দলের নেতাদের দেখে বঙ্গবন্ধুর ‘মাজার’ যিয়ারত করতে, ধূপ ধুনো জ্বালাতে ঢাকা থেকে হাসিমুখে সেলফি সমেত পিকনিক যাত্রা।
 
সেক্যুলার শেখ মুজিবের সমাধিস্থল তাই আজ ‘মাজার’। হয়তো ঘিরে দু একটি মসজিদ-মাদ্রাসাও গড়ে উঠবে। টেন্ডার বা এলাকায় প্রভাব প্রতিপত্তির লোভে ছাত্র সংগঠনে যোগ দেয়া সেই ছেলেটি জানবে না কোন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জন্য জীবন দিয়ে গেছেন জাতির পিতা।

ক্রমশ: বিবর্তিত আওয়ামীলীগের দরবেশ বা আউলিয়া হিসেবেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জানবে সেই ছেলেটি। ধর্ম নিরপেক্ষ গাছটির গোঁড়ায় যখন পচন ধরেছে, ফুল কেন ফোটেনা তার জন্য ছেলেটিকে দোষ দেই কি করে?

মাহমুদুল হক মুন্সী, ব্লগার, অনলাইন এক্টিভিস্ট ও সংগঠক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ