আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

Advertise

কামালপুর স্মৃতিসৌধ, যেখানে অঙ্কিত খণ্ডিত ইতিহাস!

জহিরুল হক বাপি  

জামালপুর জেলার সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন কামালপুর। পাশেই ভারতের মেঘালয় রাজ্য। গারো পাহাড়ের সারি । মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় এই কামালপুর সামরিক কারণেই ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  বাংলাদেশের বড় বড় যুদ্ধের হিসাব করলে ১১ নম্বর সেক্টরের প্রায় ১৮৪ কি.মি এলাকার অনেকগুলো যুদ্ধ আসবে। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধারা বারবার আক্রমণ করেও সুবিধা করতে পারছিল না কামালপুর। পাকিস্তানীরা দখল রাখলেও তাদের অবস্থাও খুব একটা সুবিধার ছিল না।

কামালপুরের বা ঐ কেন্দ্রিক যুদ্ধগুলোতে যেমন দু:সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা আত্মাহুতি দিয়েছেন তেমনি পাকিস্তানী জানোয়ারেরা মরেছে পতঙ্গের মতো। ঐতিহাসিক কারণেই ঐ সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো বাঙালির কাছে স্বর্ণস্থান হওয়া উচিত। আমার জানা মতে কামালপুরের যুদ্ধ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সিলেবাসে আছে।

এই কামালপুরকে ঘিরে যখন ভয়াবহ মিথ্যাচার হয়, ইতিহাস বিকৃতি হয় তখন সচেতন বাঙালির মনে লাগবেই। বর্তমানে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায়। দেশকে লজ্জামুক্ত করতে এবং প্রাপ্য পরিশোধে রাজাকারদের বিচার হচ্ছে। কিন্তু শুধু বিচারেই কি সব কালিমা, তাদের কালো ছায়া যাবে? মোটেই না!

বাতাসে-বাতাসে জীবাণু ছড়ানো। নতুন জীবাণুরও নিত্য নিত্য প্রবেশ। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে সব জায়গায় ইচ্ছাকৃত বিকৃতি করেছে, করছে ৭১-এর শকুনেরা। তারা এখনও হার মানে নি। বিচার করলাম, কাগজপত্রে স্বাধীনতা লিখলাম কিন্তু অন্তর কুলষিত করার আবর্জনার দিকে স্বাভাবিক চোখও দিলাম না, লাভ নাই। লাভ হবে না। হলেও অনেক পরে। কিন্তু এর ভিতর সুসংবদ্ধ শত্রুরা আরও জীবাণু ছড়িয়ে যাবে।

সরকার বিবিধ সমস্যার মধ্যে আছে। সমস্যা কমছে, বাড়ছে। কিন্তু তাই বলে তেমন কিছুই থামছে না। মোটামুটি দক্ষতার সাথে সবই চলছে। কিন্তু কোথাও কোথাও বাতাসে ছড়িয়ে থাকা পাকি জীবাণু সরানোর দিকে উদাসীনতা। সরকারের নিজস্ব রাজনৈতিক দল, নেতা, কর্মী এবং প্রশাসন আছে। এতকিছুর পরও সরকার যদি চোখের সামনে হাতি না দেখে তার দায় শতভাগ সরকারের উপরই বর্তায়।

কামালপুরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ আছে। কামালপুর বিজিবি ক্যাম্প বিপরীতে। স্মৃতিসৌধের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ চলছে এখন বহু বছর পর।

দেখে এলাম মুক্তিযুদ্ধের ভয়ংকর যুদ্ধক্ষেত্র, শহীদের কবর, পাকিদের, ক্যাম্প, রাজাকারের জল্লাদখানা বটগাছ। স্মৃতিসৌধের সামনে দাড়িয়েই হতভম্ব। এত বড় প্রকাশ্য মিথ্যাচার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে!!!! তাও আওয়ামী লীগের সময়ে?! পরে খবর নিয়ে জানলাম স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ হয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রথম আমলেই। জানলাম এখনকার আওয়ামী লীগের বড় নেতা ৭১-এর নাম করা রাজাকার। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদেরও হোমড়া-চোমড়া। তার দাপটে সবাই অস্থির। সেই রাজাকার নিয়ে কথা বলা এখনকার বিষয় না। বিষয় হলো আগে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল তখন অনেক কিছু অগোছালো ছিল। কিন্তু এখন লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট, এগিয়েও যাচ্ছে সেই ভাবে। কিন্তু বাড়িঘর সবই করলাম, আসবাব কিনলাম, রং করলাম কিন্তু দরজা, জানালা লাগালাম না অবস্থা হচ্ছে সেই রকম। সমন্বয় করতে না পারলে ঘরের সুফল পাওয়া যাবে না।

কামালপুর ভয়ংকর একটি যুদ্ধ ছিল ১৪ নভেম্বরের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে মেজর তাহেরের (পরবর্তী কর্নেল) পা বিচ্ছিন্ন হয়। ঐ সময়ে কিশোরগঞ্জ মহকুমা বাদে সমগ্র ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা এবং নগরবাড়ি-আরিচা থকে ফুলছড়ি-বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত যমুনা নদী, ব্রহ্মপুত্র পাড় তথা রৌমারি, কুড়িগ্রাম - মেজর আবু তাহের (আগস্ট-নভেম্বর), ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম. হামিদুল্লাহ (নভেম্বর-ডিসেম্বর)  ছিল ১১ নম্বর সেক্টরের এলাকা। কিন্তু বর্তমান স্মৃতিসৌধে ১৪ নভেম্বরের ভয়াবহ যুদ্ধকে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যেন কামালপুরে যুদ্ধগুলোর নায়ক মেজর জিয়া।

প্রশাসনিকভাবেই ১১ নম্বর সেক্টর থেকে জিয়া ভিন্ন হয় ১১ নম্বর সেক্টর হওয়ার পর। ১৪ নভেম্বর যুদ্ধের নায়ক যেমন মেজর তাহের, ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা তেমনি পুরো এলাকাও ১১ নম্বর সেক্টরের নিয়ন্ত্রণাধীন। স্মৃতিসৌধে লেখা ১৪ নভেম্বর মেজর জিয়া পুরো এলাকা ঘিরে রাখে। পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে, ভালো কথা কিন্তু যুদ্ধ করলো কারা? তাছাড়া জিয়াতো এ এলাকারই ছিলেন না তখন তাহলে কিভাবে এই এলাকা ঘিরে রাখলেন? তার সেক্টরের অবস্থাই বা কি ছিল? এগুলো আসলে স্থূল প্রশ্ন, স্থূল মাথাওয়ালাদের জন্য। এছাড়াও ১৪ নভেম্বর যুদ্ধের তেমন কোন উল্লেখও নেই এ স্মৃতিসৌধে। এ যুদ্ধ চলে ডিসেম্বরের ৪ তারিখ পর্যন্ত।

সেক্টর ভাগ হওয়ার আগে জিয়া জুলাইয়ে কামালপুর আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। রণ-কৌশলগত কারণে কামালপুর ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পাকি বাহিনীও তাই এখানে ছিল শক্তপোক্ত অবস্থায়। বেলুচ রেজিমেন্টে এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল।  কামালপুর দখলে থাকলে প্রায় ১৮৫ কিমি এলাকায় আক্রমণের আওতায় আনা যাবে। মেজর জিয়া তার সঙ্গী মেজর মঈনুলকে কামালপুর পাকিস্তানী ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা জানালে মেজর মঈনুল নিষেধ করেন নিজেদের সামরিক অবস্থান বিচার করে। মেজর মঈনুলের প্রস্তাব এবং পরিকল্পনা ছিল গেরিলা পদ্ধতিতে ছোট  ছোট আক্রমণ করে পাকিদের শক্তিক্ষয় করে আনা। কিন্তু জিয়া অনঢ় থাকেন।

এর ধারাবাহিকতায় জুলাইয়ে কামালপুরে দ্বিতীয় সরাসরি আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা। প্রথম আক্রমণ চালান নায়েক সুবেদার সিরাজ ১২ জুন ১৯৭১ সালে।  ১৪৮ জন মুক্তিযোদ্ধার এ আক্রমণ পাকিস্তানী ড্রাকুলারা প্রতিহত করে। জিয়ার অনঢ় অবস্থানের কারণে ৩১ জুলাই মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের নেতৃত্বে কামালপুর আক্রমণ করেন। তখন মেজর জিয়া যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে ওয়ারলেসের মাধ্যমে যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে প্রমাণিত হয় মেজর মঈনুলের প্রস্তাব ও পরিকল্পনা সব দিক দিয়ে অনেক উন্নত ছিল। সে সময় ওয়ারল্যাসে যোগাযোগও ছিল খুবই অপর্যাপ্ত। তারপরও অসীম ও অদ্বিতীয় সাহসী যোদ্ধা ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ এগিয়ে যান। যুদ্ধের এক পর্যায়ে খুবই সাধারণ অস্ত্র সজ্জিত সালাউদ্দিন তার বাহিনী নিয়ে পাকি ক্যাম্প, বাংকারে ঢুকে পড়ে। শুরু হয়ে শর্ট রেঞ্জ, বেয়নেট, হাতাহাতি যুদ্ধ। যুদ্ধের একপর্যায়ে অকুতোভয়, বীর যোদ্ধা ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ শহীদ হন। পাকিদের বাংকারগুলো ছিল ৩ স্তরে নির্মিত; প্রথমত মাটি, দ্বিতীয়  টিন, তারপর রেইল বিম এবং শেষে সিমেন্টের কংক্রিট।  উচ্চতা ছিল প্রায় ১০/১২ ফিট।
 
সে রাতে তুমুল বর্ষণ ছিল। সালাউদ্দিনের রক্ত মিশে যায়, মিশে আছে বাংলাদেশ ও ভারতের জমিনে। আহ, সালাউদ্দিন মমতাজ!

দুই পক্ষেরই প্রচুর হতাহত হয়। এ যুদ্ধে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন বলে জানতে পেরেছি। কামালপুরের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কথা অনুযায়ী পাকিস্তানী বাহিনী পূর্ণ সামরিক ও ধর্মীয় মর্যাদায় সালাউদ্দিন মমতাজের দাফন করেন। কামালপুর স্মৃতিসৌধে তেমন করে উল্লেখ নেই সালাউদ্দিন মমতাজের বীরত্বগাঁথা কর্নেল আবু তাহেরের মতই। সেখানে জ্বলজ্বল করছে মেজর জিয়ার ছবি।

আহ কামালপুর, আহ সালাউদ্দিন মমতাজ, আহ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা, আহ জিয়ার ভুল বা হটকারি সিদ্ধান্তের কারণে ৩৫ শহীদ!
 
এখানে আরও এক প্রশ্ন আসে সামরিক যুদ্ধের ইতিহাস পড়ালে ঐ এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজিবি কর্মকর্তাদেরও পরিষ্কার এই ইতিহাস জানার কথা। তাদেরও নজরে পড়লো না?

জহিরুল হক বাপি, লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ