আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

গণআতঙ্ক ছড়ানো নয় প্রয়োজন গণসচেতনতা সৃষ্টি

মো. মাহমুদুর রহমান  

যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সামাজিক-রাজনৈতিক নৈরাজ্যের কারণে অনেক সময় গণআতঙ্ক দেখা দেয়। একজন ব্যক্তি নানাবিধ কারণে আতঙ্কিত হতে পারেন। জীবনের বিভিন্ন বাঁকে কোনদিন আতঙ্কিত হননি এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। যদিও আতঙ্ক সমস্যাকে জটিল করা ছাড়া কোনো সমাধানের রাস্তা তৈরি করতে খুব একটা সাহায্য করে না। দুর্যোগের সময় আতঙ্কিত না হয়ে যারা ঠাণ্ডা মাথায় প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট এ সমস্যা মোকাবেলা করতে সক্ষম হন তারাই কম ক্ষতিগ্রস্ত হন। কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ মানুষই এরকম সময়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারেন না।

সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের সময় এর বাস্তব নমুনা দেখা গেছে। আতঙ্কিত মানুষের দৌড়ঝাঁপ চোখে না দেখলে বাস্তবতা অনুমান করা কঠিন। মানুষকে এ অসহায় অবস্থা থেকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন ছিল রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতি ও গণসচেতনতা তৈরি করা যাতে ভবিষ্যতে ভূমিকম্পজনিত কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা সৃষ্টি হয়। তা না করে সামাজিক মাধ্যম ও কিছু কিছু গণমাধ্যমে কখন, কতগুণ বেশি ভূমিকম্প হবে তা প্রচার শুরু হলো। সাথে সাথে কোন কোন অঞ্চল তলিয়ে যাবে বা সব ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যাবে তাও বলা শুরু হলো। এ নিয়ে কয়েকদিন মানুষের মধ্যে একধরণের অস্থিরতা বিরাজমান ছিল।

যদিও প্রকৃত সত্য হচ্ছে কোন অঞ্চলে কখন ভূমিকম্প হবে তার পূর্বাভাস দেয়া যায় না। বিজ্ঞানীরা বড়জোর বলতে পারেন কোন কোন অঞ্চলে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে এবং এই সম্ভাবনা হয়তো বাস্তব হতে পারে পরবর্তী ৫০ বছরের মধ্যে যেকোনো দিন। এখন আতঙ্কিত হয়ে কারো পক্ষে ঘরবাড়ি ছেড়ে পঞ্চাশ বছর নির্ঘুম কাটানো সম্ভব নয়। তাই প্রয়োজন ভূমিকম্প মোকাবেলায় সবাইকে সচেতন করা। ভূমিকম্প হলে খোলা মাঠ বা খালি জায়গায় আশ্রয় নেয়ার কথা বলা হয়ে থাকে। শহুরে বাসিন্দা কেউ চোখ বন্ধ করে চিন্তা করুন তো এরকম খোলা মাঠ বা খালি জায়গা আপনার আশেপাশে আছে কি-না। খুব কম ভাগ্যবান মানুষ ইতিবাচক উত্তর পাবেন। গত ১৩ এপ্রিল রাতের ভূমিকম্পের সময় যারা শহরের রাস্তায় ছিলেন তারা ঘরের চেয়ে নিজেদের বেশি অনিরাপদ ভেবেছেন। মাথার উপর ঝুলন্ত বিদ্যুতের তার ও খুঁটির নড়াচড়া দেখে নিরাপদে মাথা রাখার জায়গা কেউই খুঁজে পাননি। তবে আশার কথা হচ্ছে অতিসম্প্রতি বিজ্ঞানীরা বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতার তারতম্য পরিমাপের মাধ্যমে ৭২ ঘণ্টা আগে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়া যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তা কতটুকু কার্যকর হবে তা কেবল ভবিষ্যতই বলে দেবে।

প্রসঙ্গক্রমে ভূমিকম্প এলেও আজকের লেখা ভূমিকম্প আতঙ্ক নিয়ে নয়। সাম্প্রতিক দুটো মনুষ্যসৃষ্ট গণআতঙ্কের ঘটনা ভাবনায় ফেলেছে। সাধারণত গুজবে মানুষ আতঙ্কিত হলে গুজব সৃষ্টিকারীকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এ দুটো ঘটনার সূত্রপাত প্রশাসনের লোকজনের সরবরাহকৃত তথ্য থেকে।

প্রথমটি সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জে বন্যার পূর্বাভাস নিয়ে। স্থানীয় একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে খবর এল জকিগঞ্জে বন্যা হবে। নদী তীরবর্তী মানুষকে সরে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। জনপ্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকার মানুষকে বিষয়টি জানালেন, কোনো কোনো এলাকায় মাইকিং করেও জানানো হলো। নিউজে খবরের সূত্র হিসেবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করায় মানুষের কাছে খবরটি বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছিল। অনেক মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে গেলেন। যাদের যাওয়ার সুযোগ নেই তাদের সাথে আত্মীয়-স্বজনরা ঘন ঘন যোগাযোগ রাখলেন। সবাই সবার জন্য দোয়া করতে থাকলেন। যেসব পরিবারের সদস্যরা বিদেশে থাকেন তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল আরও বেশি।

স্মরণকালে জকিগঞ্জে এরকম কোনো ঘোষণা অতীতে দেয়া হয়নি। তাই আতঙ্কিত মানুষের মনে দুটো প্রশ্ন আসে। প্রথমত বন্যার পূর্বাভাস আবহাওয়া অফিস থেকে না এসে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস থেকে কেন এল? দ্বিতীয়ত নদীর পানি স্বাভাবিক অবস্থায় নিরাপদ সীমার মধ্যে থাকা সত্ত্বেও কেন দিন তারিখ ঠিক করে বন্যার কথা বলা হচ্ছে? এই দুটো প্রশ্নের সদুত্তর কারো কাছ থেকে না পেয়ে মানুষ নিজ বিবেচনায় ধরে নিলো ভারত উজানের পানি টিপাইমুখ থেকে ছেড়ে দেবে আর জকিগঞ্জ তলিয়ে যাবে পানিতে। উল্লেখ্য জকিগঞ্জ সীমান্ত থেকে প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধের অবস্থান প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে। এভাবে মানুষ ৪/৫ দিন আতঙ্কের মধ্যে পার করলো। উপজেলা বা জেলা প্রশাসনের কেউ সঠিক তথ্য জানানোর প্রয়োজন বা মানুষকে আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য প্রচারণা চালানোর প্রয়োজনবোধ করল না।

সর্বশেষ ঘটনা ঘটে সিলেট শহরে ৪ মে দিবাগত রাতে। হঠাৎ রাত দুটোর দিকে শহর এবং শহরতলীর বিভিন্ন মসজিদের মাইক থেকে শহরে ডাকাতি প্রতিরোধে সবাইকে প্রস্তুত হওয়ার জন্য বলা হয়। পার্শ্ববর্তী এলাকায় ডাকাত এসেছে তাই সবাই সতর্ক থাকার আহবান। সব মসজিদের মাইকের ঘোষণা প্রায় একইরকম ছিল। ঘোষণাটি বার বার দেয়া হচ্ছিল। তাই অনিচ্ছায়ও কেউ এ ঘোষণা এড়িয়ে নির্ভাবনায় ঘুমানোর সুযোগ ছিল না। পাড়ার যুবকরা লাঠিসোটা নিয়ে পাহারায় বের হয়। পাড়ার নালা, খাল এগুলোতে লুকানো ডাকাত খোঁজা শুরু করে। এদের চিৎকারে পরিবেশ আরও ভীতিকর হয়ে ওঠে। সিলেট শহরে অনেকদিন থেকে ডাকাতি নিয়মিত ঘটনা হয়ে পড়ায় মানুষ এমনিতেই ভয়ে ছিল। তার উপর মাইকিং ও সম্মিলিত পাহারা!

পরে জানা যায় সিলেট মেট্রোপলিটন এলাকার শাহপরান থানায় খবর ছিল সিলেটের বাইরে থেকে ওই রাতে শহরে ডাকাত দল এসেছে ডাকাতি করতে। থানা থেকে পুলিশের সোর্স ও জনপ্রতিনিধিদের ডাকাত ধরতে সহযোগিতার কথা বলা হয় এবং সবাইকে সচেতন থাকতে বলা হয়। জনগণ অতিসচেতন হয়ে মাইকিংয়ের মাধ্যমে গণআতঙ্ক সৃষ্টি করেন। রাত দুটো থেকে ভোর পর্যন্ত এই আতঙ্ক বিরাজমান ছিল। পুলিশের পক্ষ থেকে পাল্টা কোনো মাইকিংয়ের ঘোষণা শোনা যায়নি। পুলিশ মাঠে আছে, ভয়ের কোনো কারণ নেই বলে পাল্টা ঘোষণা আসা উচিত ছিল বলে সচেতন মহল মনে করেন। অথচ পরে জানা যায় পুলিশ কমিশনার সহ সবাই সারারাত মাঠে ছিলেন। তাহলে কেন এমন ঘোষণা এল না? পুলিশও কি ডাকাতি প্রতিরোধে তাদের সামর্থ্যরে বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিল না? নাকি এই গণআতঙ্কের মাত্রা সম্পর্কে রাতে পুলিশ অফিসাররা ধারণা করতে পারেননি। পুলিশ বিভাগ ভাবতে পারেনি অসুস্থ ও বয়স্ক মানুষের নির্ঘুম রাতের কথা। শিশুদের ভয়ার্ত চেহারাও ভাসেনি তাদের মনে। কিংবা যে নবদম্পতি ভালোবাসার রঙে রঙ্গিন সময়ের পরিবর্তে ডাকাত আতঙ্কে বিবর্ণ সময় কাটিয়েছে তাদের কথা।

অপরাধ দমনে পুলিশের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হলে সিলেট শহরে দীর্ঘদিন থেকে নির্বিঘ্নে ডাকাতরা বাইরে থেকে এসে ডাকাতি করে নিরাপদে ফিরে যেতে পারত না। সিলেট শহরে ইদানিং ডাকাতি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নিয়মিতভাবে ডাকাতি হচ্ছে। তারপরও কোনো ডাকাত গ্রেফতার হচ্ছে না। উল্টো আতঙ্ক ছড়িয়ে মানুষকে কষ্ট দেয়া হচ্ছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ডাকাতরা স্থানীয় নয়। খুব প্রশিক্ষিত ডাকাত দল খুলনা, বরিশাল, ঢাকা এসব অঞ্চল থেকে এসে ডাকাতি করে চলে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের বাইরে থেকে তো আসে না? তাহলে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের মাধ্যমে সমন্বিতভাবে এদেরকে কেন পুলিশি জালে বন্দি করা যাচ্ছে না? জননিরাপত্তায় অসাধারণ ভূমিকা পালনকারী পুলিশ বিভাগ সামান্য ডাকাতদের কৌশলের কাছে হার মানবে তা হতে পারে না। নিশ্চয়ই এ সমস্যারও সমাধান হবে। তবে যত তাড়াতাড়ি ততই মঙ্গল।

প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং আতঙ্ক সৃষ্টির পার্থক্য মাথায় রাখতে হবে। অনেক বিষয়েই একা পুলিশ বা প্রশাসনের পক্ষে কাজ করা কঠিন। সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তাদের সহযোগিতায় যেমন অপরাধ দমন সহজ তেমনি প্রাকৃতিক দুর্যোগও মোকাবেলা করা সহজ। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে কোনোভাবেই যাতে সচেতনতা তৈরির কোনো উদ্যোগ যেন গণআতঙ্ক সৃষ্টি না করে। এরকম হিতে বিপরীত হলে সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের গণআতঙ্ক নিরসনে পাল্টা উদ্যোগ নিতে হবে। ভবিষ্যতে যেন দেশের কোন শহরবাসীদের কিংবা গ্রামবাসীদের নির্ঘুম আতঙ্কের রাত পাড়ি দিতে না হয় এ ব্যাপারে সবাইকে এখনই সচেতন হতে হবে।

মো. মাহমুদুর রহমান, ব্যাংকার। ইমেইল : [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ