আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

জাতির পতাকা খামচে ধরা সেই পুরনো শকুন!

নাজমুল হাসান  

ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া একটা আপেক্ষিক বিষয়। যিনি একটি ধর্ম পালন করেন তার অজান্তেই তার এ ধর্ম পালনের স্বাভাবিক বিষয়টিই আরেক ধর্মের অনুসারী মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়ে ফেলে। ধর্ম পালন করতে গেলে এটা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। যিনি ধর্ম পালন করেন না, তার পক্ষে অন্য ধর্মের মানুষকে এভাবে প্রতিনিয়ত আঘাত দেওয়া সম্ভব নয়। তার মানে হচ্ছে, ধর্ম পালনের বিষয়টি অনুভূতিগত এবং এটা ভিন্নমত বা বিপরীত মতকে শ্রদ্ধা করার মত একটি অনুভূতিশীল যায়গা। এটিকে মনে-প্রাণে ধারণ করেই মানুষ ধর্ম চর্চা করে।   

এক ধর্মে গান-বাজনা হারাম, অন্য ধর্মে গান বাজনা ছাড়া ধর্মীয় অনুষ্ঠানই হয় না। এক ধর্মে গরুকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করা হয়, অন্য ধর্মে সেই গরুকে ধরে-বেঁধে জবাই করে খাওয়া হয়। এক ধর্মে মূর্তি পূজাই একমাত্র আরাধনা, অন্য ধর্মে মূর্তি পূজাকে হারাম করা হয়েছে। সুতরাং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বিষয়টা খুবই আপেক্ষিক। একটি ধর্ম পালন করা মানেই অন্যের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া; এটার ব্যতিক্রম করা অসম্ভব ও অবাস্তব। কারণ ধর্মীয় আচার-আচরণগুলি পরস্পর বিরোধী। তারপরেও এগুলিকে মেনে নিয়েই পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েই চলছে ধর্মচর্চা।

বিপরীত ধর্ম চর্চাসমূহকে ধারণ করেই সমাজে বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষের সহাবস্থান। অন্যের ধর্ম বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করেই মানুষ সমাজে বসবাস করে, অশ্রদ্ধা করে নয়। সমস্ত ধর্মের নির্দেশনাও তাই। যদিও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কোন কোন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর বিরূপ আচরণের কারণে এর ভিন্নতাটাই প্রকটভাবে চোখে পড়ে।

একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, সমাজে বেশকিছু সুবিধাবাদী মানুষ আছেন তারা নিজেরা ধর্মকে যথাযথভাবে পালন করেন না, কিন্তু ধর্মকে নানাভাবে ব্যবহার করে নিজের সুবিধা নিতে সদা ব্যস্ত থাকেন। তারা খুবই সুযোগসন্ধানী মানুষ। যেমন করেই হোক, সময়-সুযোগ বুঝে তারা ধর্মের সাথে মিল রেখে সুচিন্তিতভাবেই একটা না একটা ছুতো-নাতা বের করেন এবং সেই ছুতো ধরে কোন না কোনোভাবে তাদের ধর্ম বিশ্বাসের বিশাল চেহারা জাহির করার জন্য সদা উদগ্রীব থাকেন। এদের এ স্বার্থবাজির কারণেই অন্যের ধর্মবিশ্বাস এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিজের ধর্মও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা চরমভাবে ক্ষুণ্ণ ও প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের ধর্মীয় বোধের উপরে আঘাত আসে।
   
এই যে আমাদের দেশে ইচ্ছেমত মন্দির, গির্জা ভাঙা হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতন করা হচ্ছে- এগুলি কি কোন ধর্ম চর্চা হতে পারে? অন্য ধর্মের মানুষের ধর্মাধিকার ভঙ্গ করা কী আসলেই কোন ধর্ম চর্চা? নিশ্চয়ই নয়। তাহলে কেন এগুলি করা হচ্ছে! শুধু করাই হচ্ছে না, এগুলিকে বৈধতা দেবার জন্য আবার সেই ধর্মেরই দোহাই দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে ধর্ম রক্ষার নামে, ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার নামে বরং ধর্মকে খাটোই করা হচ্ছে। কাজগুলি করছে স্বার্থবাজ কিছু ধর্মবাদী মানুষ, কোন প্রকৃত ধর্মপ্রাণ মানুষ বা কোন নাস্তিক অথবা মুক্তমনা নয়।  

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও মাঝেমধ্যে যে দুর্ধর্ষ সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তারসাথেও কোন নাস্তিক বা মুক্তমনা বা প্রকৃত ধর্মপ্রাণ মানুষের কোন যোগসূত্র নেই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে জন্ম নিয়ে সারা পৃথিবীতে ধর্মাচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে থাকা কয়েকটি গোষ্ঠী যেমন- ইসলামিক স্টেট, আল-কায়েদা, আনসার আল-ইসলাম ইত্যাদি গ্রুপগুলিও ধর্মভিত্তিক গ্রুপ। এখানেও কোন নাস্তিক বা মুক্তমনা নেই। এ গ্রুপগুলিও ধর্মের কথা বলে। ধর্ম প্রতিষ্ঠার নামে এরা স্ব-ধর্ম, বিধর্মসহ নির্বিশেষে সকল মানুষকে নির্যাতন করছে, মেরে ফেলছে- এর সাথেও কোন নাস্তিক বা মুক্তমনার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। বর্তমান দুনিয়ার কোথাও এমন নজির নেই যে, কোন নাস্তিক বা মুক্তমনা অন্যের উপাসনালয় ভাঙার কাজ করেছে বা মানুষ মেরে ফেলছে। এমনটা কখনও ছিলও না।

বিষয়গুলিকে একটু উল্টোভাবে দেখি- যদি এমন হতো যে, নাস্তিক বা মুক্তমনার চর্চাকারী ব্যক্তিগণ সম্মানিত নারীদেরকে স্বল্প সময়ের জন্য জোর করে বিয়ে করছে এবং যে নারীরা সে বিয়েতে রাজি হচ্ছে না তাদেরকে মেরে ফেলছে। তাহলে বিষয়টা ধর্মবাদীরা কী চোখে দেখতেন বা তাদের দ্বারা এর প্রচারটা কীভাবে হতো? আবার এমন যদি হতো যে, নাস্তিক বা মুক্তমনারা অর্থ সংগ্রহের জন্য নারীদেরকে ধরে নিয়ে বিক্রির জন্য নারীর হাট বসাচ্ছে এবং ক্রেতা আকর্ষণের জন্য তার প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে! এমন হাটের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সারা দুনিয়ার নাস্তিক বা মুক্তমনারা ক্রেতা হিসেবে সেখানে ভিড় জমাচ্ছে এবং কোরবানির হাটে গরু-ছাগল দেখার মত করে পুরুষ ক্রেতারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নারীদেরকে দেখছে এবং দাম-দর করে কিনছে। নারীদেরকে জোর করে ধরে-বেধে পিটিয়ে, নির্যাতন করে এভাবে হাটে আনা হচ্ছে এবং খুবই কম দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এমনই নারীর হাট যেখানে মাত্র পাঁচ ডলারেও নারী কিনতে পাওয়া যায় এবং সারা জীবনের জন্য তাকে ইচ্ছেমত ভোগ করা যায়! সত্যিই যদি নাস্তিক বা মুক্তমনারা এমন কাজগুলি করতো তবে ধর্মবাদীদের মধ্যে তার কী প্রতিক্রিয়া হতো? অথচ ধর্মের নামে এ কাজগুলি করা হচ্ছে! তাহলে ধর্মের প্রতি মানুষের কী ধারণা তৈরি হচ্ছে সেটা সহজেই অনুমান করা যায়?

মুখে ধর্মের বড় বড় কথা বলাটাই যথেষ্ট নয়, এর চর্চাটাই আসল, সেটাই মানুষ দেখে-শেখে এবং অনুসরণ করে। ধর্মবাদীদের মধ্য থেকে যখন ধর্মের নামে সংগঠিত কোন অগ্রহণযোগ্য বিষয়ের তীব্র প্রতিবাদ হয় না, তখন এটাকে ধর্মের চর্চা বলেই অন্যরা মনে করতে পারে। আমরা দেখছি যে, ব্লগারসহ মুক্তচিন্তার মানুষদের ছোটখাটো ব্যাপার নিয়েও কঠিন প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, তাদের হত্যা করা হয়, হরতাল ডাকা হয়; সেখানে এই বড় বড় জঘন্য বিষয় নিয়ে এমন কোন প্রতিবাদই হয় না। এর কারণ কী?
একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে, যারা দেশের মধ্যে এ কাজগুলি করছে তারা তাদের একটা খারাপ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার উদ্দেশেই কাজগুলি করছে যা কোনোভাবেই ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। এর শেকড় অন্যখানে যার সাথে সুস্পষ্টভাবে রাজনৈতিক যোগ আছে। যারা এ কাজগুলি করছে তারাও প্রকৃত ধর্মপ্রবণ মানুষ নয় বরং তারা ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকারী। যে রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠার জন্য তারা কাজগুলি করছে সেটাও দেশের জন্য মঙ্গলজনক কোন রাজনীতি নয়।    

ধর্মের নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে এমন ঘৃণিত কাজের মাত্র দুটো উদাহরণ দিলাম যা দেশের বাইরের। ধর্মকে উপরে তোলার জন্য এরকম হাজারো, লক্ষ অগ্রহণযোগ্য কাজ ধর্মের নামে প্রায় সকল মুসলিমপ্রধান দেশেই করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এমন কাজ করা হচ্ছে ধর্মপ্রবণ প্রায় সকল দেশেই। ধর্মানুভূতিতে আঘাত পাবার ভঙ ধরে যারা আমাদের দেশের মধ্যে নানান পর্যায়ের মানুষকে হত্যা করছে- তারা কী কখনওই এই জঘন্য কাজগুলির প্রতিবাদ করেছে? অথচ ধর্মকে নিয়ে খুব সত্য একটা হাদিস, যেটিকে কেউ কালোত্তীর্ণ মনে না করার কারণে রেফারেন্সসহ ফেসবুকের মত যায়গায় একটা স্ট্যাটাস দিলেও ধর্মবাদীরা হৈ হৈ রৈ রৈ করে ওঠেন। কিন্তু এ হৈ চৈ করা মানুষগুলির কেউ-ই ঐ ধরনের জঘন্য কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ কখনও করেন না। তার মানে কী ধর্ম ঐ খারাপ কাজগুলিকে সমর্থন করে!? যে গোষ্ঠীগুলি দেশের বাইরে ঐ ধরনের খারাপ ঘটনাগুলি ঘটাচ্ছে সেগুলি যদি ধর্ম সমর্থিত না হয়, তবে সোচ্চারভাবে তার প্রতিবাদ না করে কেন দেশের ভিতরে সংগঠিত ছোট-খাটো বিষয়গুলিকে নিয়ে এতো তোলপাড় করা হয়! তার মানে ঐ সমস্ত গোষ্ঠীর মন-মানসিকতা ও চাওয়া-পাওয়া আর এদের মন-মানসিকতা ও চাওয়া-পাওয়া একই। ওদের মন যুগিয়ে চলার জন্যই এরা দেশের ভিতরের এ কাজগুলি করছে। সুতরাং এটা ধর্ম রক্ষা নয়, আত্মস্বার্থ রক্ষা যা রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবার সাথে সংশ্লিষ্ট রাজনীতি।      

দেশের বাইরের কথা বাদ দিলাম- আমাদের দেশের মধ্যে মসজিদের ভিতরে মানুষ মারা, কোরান পোড়ানোর মত ভয়াবহ ঘটনায়ও এই ধর্মানুভূতি সম্পন্ন মানুষদেরকে রা পর্যন্ত করতে দেখা যায় না, বরং তাদের মধ্যেই ঐ সুবিধাবাদী গোষ্ঠী এই কাজগুলি করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। সুতরাং এমন প্রশ্ন সর্বসাধারণের মধ্যে উদয় হওয়া অবাঞ্ছিত নয় যে, তাহলে কোথায় এবং কীসে ধর্ম রক্ষা হয়? যারা এগুলি করছে তাদের আসল উদ্দেশ্য কী? এই কোরানটা যদি অনিচ্ছাসত্ত্বেও, দুর্ঘটনাবশত একজন মুক্তমনা বা ভিন্নধর্মীর হাতে পুড়ত তাহলে কী হতো? অথচ এখানে ইচ্ছাকৃতভাবে পোড়ানো হয়েছে।   

ধর্মকে সত্যিকারে ধারণ করলে সে ধর্মের প্রতি যে সহানুভূতি ও শ্রদ্ধার যায়গা তৈরি হয় সেখানে কোনোপ্রকার হিংসাত্মক মানসিকতা জন্মাবার সুযোগ থাকার কথা নয়। সেইরকম একটা প্রকৃত অনুভূতিকে একধরণের রাজনৈতিক প্রলেপ দিয়ে ‘ধর্মানুভূতি’ নামক ট্যাগ দিয়ে কিছু মানুষ খুবই সুকৌশলে তাদের কৃত্রিম ধর্মানুভূতিকে জাগ্রত করে মানুষকে উদ্দীপ্ত করছে। উদ্দীপ্ত মানুষের সেই ধর্মানুভূতিকে তারা সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে সারাদেশব্যপী মহাসমারোহে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের ‘ধর্মানুভূতি’ বাণিজ্য। সাধারণ মানুষ বুঝতেও পারছে না যে, তাদেরকে এরা কীভাবে ব্যবহার করছে। বরং মানুষ বিষয়টিতে নিজের ধর্মের প্রতি নিজে শ্রদ্ধা প্রকাশ করছে তেমন একটা সান্ত্বনা নিজেরাই খুঁজে পাচ্ছে। অথচ পুরো বিষয়টাই একটা রাজনৈতিক কৌশল যেখানে নিজের অজান্তে ব্যবহৃত হচ্ছে অগুনতি সাধারণ মানুষ।
   
যারা লেখালেখি করেন, সংস্কৃতি চর্চা করেন, গবেষণা করেন তারা তাদের এ চর্চাটা নতুন করে করছেন না। ব্লগ বা অনলাইনে লেখালেখি করার বিষয়টিও হঠাৎ করে আসেনি। সেটাও চলছে বহুদিন ধরে। ১৯৯৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর জোম বার্গার সর্বপ্রথম ‘ওয়েবলগ’ চালু করেন এবং সে শব্দটিরই ছোট্ট সংস্করণ ‘ব্লগ’ চালু করেন পিটার মেরহোলজ ১৯৯৯ সালে। বাংলাদেশে ২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ব্লগে লেখালেখি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সুতরাং ব্লগে লেখালেখির বিষয়টি স্বাভাবিক নিয়মেই চলে আসছিল। কিন্তু সে স্বাভাবিক লেখালেখির চর্চাকে কেন হঠাৎ করেই জোরাজুরি করে ‘ধর্মানুভূতি’র সংজ্ঞার মধ্যে টেনে এনে এরসাথে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলিকে হত্যা করা হচ্ছে সে বিষয়টি বিবেচনায় রাখার দরকার আছে। এখানেই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের সমকালীন প্রেক্ষাপট, উস্কানি ও সেগুলিকে কাজে লাগিয়ে খুনোখুনির রাজনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয়সমূহ নিহিত।

যতদিন যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা-বিরোধীরা এ দেশে জামাই আদরে ছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষকে নিধন কার্যে নিয়োজিত ছিল ততদিন দেশে ধর্মের কোন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু যখনই তারা জীবন-মরণের ‘মাইনকে চিপায়’ পড়েছে তখনই দেশে ধর্ম যাওয়া শুরু হয়েছে। এই গোষ্ঠীর মতে, একাত্তর সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সমসাময়িক সময়েও এভাবে এদেশের ধর্ম প্রায় চলেই যাচ্ছিল। তাদের মতে এখনও সেরকমভাবেই দেশের ধর্ম যেতে বসেছে। তারা রাজনৈতিক চাপে পড়লেই ধর্মের দোহাই তোলে, দেশের ধর্ম চলে যাবার বাহানাকে সামনে নিয়ে আসে- কেন? বিষয়টিকে একটু তলিয়ে দেখে বুঝতে হবে।

ধর্মাশ্রয়ী এই অপব্যাখ্যাকারী, যুদ্ধাপরাধীদেরকে টুটি চেপে ধরার জন্য জনগণের মধ্যে একটা জাগরণ তৈরি করতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল ব্লগার ও অনলাইন একটিভিস্টগণ। ওদের বিরুদ্ধে জনমত প্রতিষ্ঠার এ ভূমিকার জন্যই ওরা এদেরকে নাস্তিক ট্যাগ দিয়ে হত্যার নীল নকশা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এটাই আসল কারণ। সুতরাং  ধর্মানুভূতিকে কৃত্রিমভাবে জাগ্রত করে সেটিকে কাজে লাগিয়ে যারা একাত্তরের সমসাময়িককালে মুক্তিযুদ্ধকে বিরোধিতা করেছে সেই অপশক্তি এবং বর্তমানকালের এই অপশক্তি একই অপশক্তি। এদের দ্বারা তখনও কিছু মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে এখনও কিছু মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। এ ব্যাপারে মানুষের আরও বিশ্লেষণী ও সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে।
      
নিজের ঈমানকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিজের এবং নিজেকেই তা রক্ষা করতে হয়। নিজের ঈমান রক্ষার জন্য দলবেঁধে খুঁজে খুঁজে নির্দিষ্ট শ্রেণি-পেশার মানুষগুলিকে মেরে আরেকটি সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীর রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার ভূমিকায় নিজেকে রত রাখা নিশ্চয়ই ঈমান রক্ষা নয়। সুতরাং ধর্মকে অবমাননা করার মত কোন বিষয় দেখলেই তাতে উত্তেজিত না হয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষের আরেকটু ভেবে-চিন্তে পদক্ষেপ গ্রহণ করাটা প্রত্যাশিত। মানুষজনকে খুন করা হচ্ছে, অন্যের ধর্মালয় ভেঙে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজেদের ধর্মালয়কেও অসম্মান করার বিষয়গুলি কতোটা যৌক্তিক, কতোটা ধর্মানুভূতির সাথে যায়- সেটা ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখার দরকার আছে। হুজুগে মাতাল হওয়া কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। কিছু কিছু মানুষের জন্য এটা একটা বাণিজ্য। এই বাণিজ্যের মহাজনদের হাতে নিজে বিক্রি না হওয়াই ধর্মের প্রতি প্রকৃত সম্মান দেখানো। মনে রাখতে হবে “ধর্মানুভূতি’কে নিয়ে যারা বাণিজ্য করছে তারা সুদের মহাজনদের থেকেও খারাপ। এটা ধর্মানুভূতি নয়, ধর্ম-বাণিজ্য।

আপনার ধর্ম আপনার কাছে, আপনিই তার পবিত্রতা রক্ষা করুন এবং ধর্ম রক্ষার জন্য সেটিই যথেষ্ট। আপনার ধর্ম এই ধর্ম ব্যবসায়ীদের কাছে লিজ দেবার প্রয়োজন নেই। আপনাকে উদ্দীপ্ত করে এরা এদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে মাঠে নামছে। এরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে কেউ রক্ষা পাবে না। আপনিও নয়।
 
একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলেই দেখতে পাবেন, যারা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পাবার বিষয়টিকে সামনে টেনে নিয়ে আসছে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্মীয় ধান্দাবাজ। এরা সারাদিন অধর্মের কাজ করে এবং আরেকজনের পাছায় বিষ্ঠার গন্ধ খুঁজে নিজেকে সাধ্বী সাজানোর চেষ্টা করে। তারা মোটেও সৎ ও ভাল মানুষ নন।

সাদামাটা একটা হিসাব করুন, এই দেশে যে কয়জন মানুষ মসজিদে নামাজ পড়তে যান শুধুমাত্র সেই কয়জন মানুষই যদি ভাল হয়ে বাকী সবাই খারাপও হয়, তাহলে এই ভাল মানুষগুলির চাপে দেশটা ভালই থাকবার কথা। তা কিন্তু হচ্ছে না, সুতরাং মুখে ধর্মের বুলি আর কর্মে অধর্ম এ ধরনের দ্বৈত চর্চাকারী মানুষের কিন্তু অভাব নেই বরং সেই সংখ্যাটাই বেশি।

একজন ধর্মচর্চাকারীর জীবনাচরণ দেখে তাকে অনুসরণ করার প্রেরণা পাবে অন্যান্যরা, সেটাই ধর্মের মূল আদর্শ ও চর্চা, সেটাই প্রত্যাশিত। বাংলাদেশের একটা আঞ্চলিক প্রবাদ আছে, “হেগে ছোচে না, মুতে গলা পানিতে যায়”। ধর্ম চর্চার ক্ষেত্রে সেটি প্রত্যাশিত নয়। ধর্ম চর্চা মানে আংশিক কোন চর্চা নয়, পূর্ণ চর্চা। আংশিক চর্চা করে অন্যকে সমালোচনা করার আগে নিজেকে পূর্ণ চর্চায় ব্রতি করাটা বেশি কাঙ্ক্ষিত। আর সেটি হলেই এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলি আমাদেরকে দেখতে হবে না। তেমন একটি সময়ের প্রত্যাশাই আমাদের স্বপ্ন।

নাজমুল হাসান, লেখক, গবেষক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ