আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক

জহিরুল হক মজুমদার  

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক একটি  বহুল আলোচিত বিষয়। কিন্তু এই বিষয়ে পদ্ধতিগত আলোচনা এবং দায়িত্বপূর্ণ আলোচনা খুব কমই চোখে পড়ে। সমাজের শিক্ষিত ও সাধারণ নাগরিকদের একটি বড় অংশই  মনে করেন, ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনার কী আছে। অধিকাংশ লোকই মনে করেন, শিক্ষক পিতৃ কিংবা মাতৃতুল্য। সুতরাং ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক ছাত্রের দিক থেকে গভীর শ্রদ্ধার, আর শিক্ষকের দিক থেকে স্নেহের এবং যত্নের। শিক্ষকের সাথেও অভিভাবকদের সম্পর্ক পারস্পরিক শ্রদ্ধার, যদিও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অভিভাবকরা খুব কমই শিক্ষক বা কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে আসেন।
 
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অভিভাবকরা অনেকটাই অসহায়। এমনকি প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ডাকে শিক্ষকদের সামনে একজন অভিভাবককে অসহায় বোধ করতে দেখা যায়। হয়তো সন্তানের একাডেমিক ফলাফল ভাল হচ্ছেনা, অতিরিক্ত চঞ্চল কিংবা শৃঙ্খলা বিরোধী কোন কাজ করেছে সন্তান, এইসব বিষয়ে শিক্ষকদের ডাকে সাড়া দিয়ে একজন অভিভাবককে শিক্ষকদের সাথে কথা বলতে দেখা যায়। এইসব ক্ষেত্রে অনেক অভিভাবকের সাথে  রুক্ষভাবেও কথা বলতে দেখা যায় শিক্ষক কিংবা প্রধান শিক্ষককে। অনেক স্কুল বা কলেজে নিয়মিত অভিভাবক মিটিং হয়না। ক্ষেত্র বিশেষে অভিভাবকের ডাক পড়ে। সন্তানকে মানুষ করার যে আবেগ পিতামাতার মধ্যে কাজ করে তার পরিপূর্ণ সমর্থন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আছে বলে মনে করিনা। অভিভাবকরা এক ধরণের  অসহায়ত্ব নিয়েই সন্তানকে স্কুল বা কলেজের গণ্ডি পার করেন।

সন্তান বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয়ে গেলে পিতামাতা অনেকটাই স্বস্তি বোধ করেন যে, এখন থেকে আর সন্তানকে তার পৌঁছে দিতে হবেনা, কিংবা স্কুলের মত করে আর অভিভাবকের ডাক পড়বেনা। সন্তান নিজেই তার শিক্ষকদের সাথে কথা বলে তার সমস্যাগুলো সমাধান করবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে এই সম্পর্ক কিংবা দায়িত্বের রূপান্তর শুধু অভিভাবকদের সন্তান বড় হয়ে যাওয়া জনিত মনোজাগতিক রূপান্তর মাত্র। কিন্তু সন্তানের শিক্ষা শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত যেকোনো স্তরের শিক্ষার সাথে অভিভাবকদের যোগাযোগ থাকাটা বাঞ্ছনীয়, অন্তত আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে। পশ্চিমা দেশের কথা ভিন্ন। সেখানে একজন আঠার বছর  বয়সী মানুষকে স্বাধীন স্বেচ্ছাধীন নাগরিক মনে করা হয়, যার পরিপূর্ণ দায়িত্ব তার নিজের।

বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে যে শুধু শিক্ষক নিয়ন্ত্রিত তা নয়। অভিভাবকরাও শিক্ষকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারেন নির্বাচিত গভর্নিং বডির মাধ্যমে। এই গভর্নিং বডির সদস্য হন অভিভাবকদের ভিতর থেকেই।  কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোকে রাষ্ট্র এমন করে রেখেছে যে এখানে অভিভাবকদের কোন ভূমিকা নেই। সিনেট নামের যে পরিষদটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকদের পরিষদ মনে করা হয়, সেখানে ছাত্র ছাত্রীদের অভিভাবকদের  কোন প্রতিনিধিত্ব নেই। সিনেটে নির্বাচিত  শিক্ষক, মহামান্য রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি এইসব এর পর একটা বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদের- যাদেরকে রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট বলা হয়ে থাকে। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে এইসব রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েটদের অনেকেরই সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেনা।
 
উপাচার্য নিজের লোক হতে হবে, এই নোংরা সরকারী খেলার ক্রীড়নক হচ্ছেন এইসব নির্বাচিত  রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটরা। অধিকাংশ সময়েই সরকারী সমর্থনপুষ্ট সাবেক ছাত্রনেতা, কিংবা বড় ব্যবসায়ীরা টাকার জোরে এবং সরকারী সহযোগিতা নিয়ে সারাদেশ  ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্র্যাজুয়েটদের ভোট সংগ্রহ করে নির্বাচিত হয়ে যান। এইসব গ্র্যাজুয়েটরা সিনেটে ছাত্রদের অধিকার কিংবা শিক্ষা নিয়ে তেমন কোন কথাই বলেন না। এছাড়া গ্রাম থেকে আসা বিপুল ছাত্রের অভিভাবকরা অনেক দূরে থাকার কারণে সন্তানের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে কথা বলা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়না।    
 
১৯৭৩ এর রাষ্ট্রপতির আদেশসমূহ, যেগুলোকে  বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বলা হয়, সেটি প্রয়োজনীয় সংশোধন করে, সিনেটে ছাত্রদের পিতামাতা অর্থাৎ সত্যিকারের অভিভাবকদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত  করা উচিৎ বলে মনে করি। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে যে আইন জাতীয় সংসদে পাশ করা হয়েছে,  তার  প্রায় সবগুলোতেই “সিনেট” এর কোন বিধান রাখা হয়নি। অন্য কোন ভাবেও অভিভাবকদের মতামত প্রদান কিংবা অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হয়নি।  মূলত: উল্লেখিত পরিস্থিতিতে, অভিভাবকদের অনুপস্থিতিতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ব্যাপারই ছাত্র শিক্ষক দ্বিপাক্ষিক হয়ে পড়ে। আর এই কারণেই ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের বিষয়টি আলোচিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে অনেক বেশী করে।

কেমন ছিল ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে? অন্তত: শিক্ষক পেটানোর ঘটনা ষাট দশকের আগে শোনা যায়না। ষাট দশকে মোনায়েম খানের পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্ররাজনীতিতে গুণ্ডামির অনুপ্রবেশ ঘটে। তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ওসমান গণিকেও অনেকে দায়ী মনে করেন। উপাচার্যদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির শুরু সম্ভবত তাঁকে দিয়েই। সেই সময়ের সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন এন এস এফ এর পাণ্ডারা অর্থনীতি বিভাগের প্রখ্যাত অধ্যাপক আবু মাহমুদকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছিল। সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল তা জানা না গেলেও,  এটা জানা যায় যে অধ্যাপক মাহমুদের সুযোগ্য ছাত্র এবং আই বি এর অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ নিজের শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন। এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বেগবান হয়ে উঠে। এন এস এফ এর বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যায়। এন এস এফ এর সাপ গলায় পেঁচিয়ে চলা পাণ্ডারা  কেউ কেউ গণপিটুনিতে নিহত হয়। এন এস এফ এর পাণ্ডাদের অনেকেই সুস্থ রাজনৈতিক ধারায় ফিরে আসে।

তবে ষাট দশকের ত্যাগী শিক্ষকদের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামসুজ্জোহা’র নাম না বললেই নয়। ছাত্রদের নিরাপত্তার কথা ভেবে, তাদের একটি মিছিলকে অনুসরণ করতে গিয়ে অধ্যাপক জোহা  পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন। তাই আজও তিনি ছাত্র শিক্ষকদের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন।   

১৯২১  থেকে ৬০ দশক পর্যন্ত শিক্ষা এবং সমাজ নির্মাণ প্রচেষ্টায় ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন খারাপ ঘটনার কথা শোনা যায়না। সমাজে সাম্প্রদায়িক আবহ বিরাজ করলেও বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত, শুধু নাজির আহমেদ নামে একজন ছাত্রের সাম্প্রদায়িক কারণে মৃত্যুবরণ করা ছাড়া। জগন্নাথ হলে ব্রাহ্মণ ছাত্রদের অসন ভোজনের আলাদা ব্যবস্থা থাকলেও, ক্যাম্পাস আলো করে ছিলেন সত্যেন বসুর মত ছাত্রঅন্তপ্রাণ শিক্ষক কিংবা হরিদাস ভট্টাচার্য এর মত অসাধারণ দর্শনের শিক্ষক। সরদার ফজলুল করিমের লেখায় পাওয়া যায় যে হরিদাস ভট্টাচার্য হেঁটে হেঁটেও ক্লাস নিতেন। ছাত্ররা তাঁর পেছনে পেছনে হাঁটছে আর তিনি আলোচনা করছেন। এতটাই উদার বন্ধুসুলভ ছিলেন তিনি।

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের কথাও এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। প্রথাগত শ্রেণীকক্ষে পাঠদান তাঁর অভ্যাস না হলেও বিবিধভাবে জ্ঞানালোচনাকে অব্যাহত রাখা, উৎসাহ প্রদান করা এবং বাসার নাস্তার টেবিলেও ছাত্রদের উপস্থিতি সাগ্রহে অনুমোদন করা, আমরা আহমদ ছফা এর লেখায় পাই। ছাত্র নির্মলেন্দু গুণ এর মধুর ক্যান্টিনের বাকীর টাকা শোধ দিয়েছিলেন গুণ এর  শিক্ষক অধ্যাপক আহমদ শরিফ।

স্বাধীনতা উত্তরকালে কয়েকজন শিক্ষক প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা বিরোধিতার কারণে মুক্তিযোদ্ধা ছাত্রদের দ্বারা আক্রান্ত হলেও সেটা সংখ্যায় নগণ্য এবং সময়ের আবহের কারণেই মূল্যবোধের উপর বড় আঘাত হিসেবে বিবেচিত হয়নি। সেই সমস্ত শিক্ষকদের মুক্তিযুদ্ধে ন্যক্কারজনক ভূমিকার কথা সবার জানা থাকার কারণে, এটাকে সবাই স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে। এই স্বল্প সংখ্যক শিক্ষকরা আলবদর বাহিনীকে  ১৪ ই ডিসেম্বর এর শহীদ শিক্ষকদের বাসা চিনিয়ে দিয়েছিলেন।

ছাত্রনেতা আ স ম রব তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি প্রথম ভাত খান তার হাউজ টিউটর অধ্যাপক ইয়াজ উদ্দিন  এর বাসায়, জহুরুল হক হলে। স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক ছাত্রদের বাড়ি থেকে আসা টাকাও  কোনকোন শিক্ষক জমা রাখতেন।

মহসিন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামালের কাছে তাঁরই পুত্রের বন্ধু বিশেষ বিবেচনায়  একটি সিট চাইলে তিনি অস্বীকৃতি জানান।  কিন্তু পুত্রের বন্ধুকে তাঁর পুত্রের সাথে প্রভোস্ট এর বাসায় থাকার আমন্ত্রণ জানান। এমনই ছিল সত্তর দশকে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক।

ঢাকার বাইরে প্রথিতযশা শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক আখলাকুর রহমানের নাম স্মরণীয়। তিনি দু’ জন ছাত্রের আবাসন সমস্যা সমাধানের জন্য নিজ বাসায় থাকতে জায়গা দিয়েছিলেন, তাঁর কন্যাদের আপত্তি স্বত্বেও। এইসব বিখ্যাত লোকদের বাইরেও অনেক সাধারণ শিক্ষক সবসময়েই ছিলেন এবং আছেন যারা ছাত্রদের কল্যাণে কাজ করছেন।

আশির দশকে সামরিক শাসনের সময়  সামরিক শাসকদের কাছে সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার ছিল ছাত্র শিক্ষক ঐক্য। এই ছাত্র শিক্ষক ঐক্য এর ফলশ্রুতিতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন বেগবান হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং গণ আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। হালের ১/১১ এর সরকারের পতনের পিছনেও ছিল ছাত্র শিক্ষক ঐক্য।

এইসব মধুর মতাদর্শিক, জ্ঞানগত এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের পরও ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের খামতির জায়গাগুলো কী? শিক্ষকদের সম্পর্কে সাধারণ ছাত্রদের অভিযোগের জায়গাগুলো কী?   

কোন কোন  শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রদের অভিযোগগুলো সাধারণ। কোন  শিক্ষক হয়তো স্বভাবে বদমেজাজি, কেউ হয়তো সব সময়ই নম্বর কম দেন, ক্লাস কম নেন।  আরেকটু বাড়িয়ে বলে কোন কোন ছাত্র অভিযোগ করে বলে যে শিক্ষকের ছাত্রীদের প্রতি দুর্বলতা রয়েছে এবং তিনি ছাত্রীদেরকে বেশী নম্বর দিয়ে থাকেন। কোন কোন বন্ধুর ফার্স্টক্লাস পাওয়া নিয়েও অন্যরা প্রতীকী  অভিযোগ করতো যে, স্যার এর বাজার করে দিয়ে সে প্রথম শ্রেণী পেয়েছে। এইসমস্ত অভিযোগ জনকথন আকারে ছাত্র পরিসরে চালু ছিল। কিন্তু বৃহৎ ছাত্রসমাজ শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে এসেছে এবং সন্তানদের  শিক্ষকের প্রতি সদাচরণ নিয়ে বৃহৎ সমাজও সন্তুষ্ট ছিল।

ষাট দশকে অধ্যাপক আবু মাহমুদের এন এস এফ পাণ্ডাদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার  অনেকদিন পর নব্বই এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের একজন অধ্যাপকের  শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ককে সমাজের সামনে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। আক্রমণকারী ছাত্র আনসার আলী এর শাস্তির জন্য  সাধারণ ছাত্ররাই আন্দোলন গড়ে তোলে এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আনসার আলীকে চিরতরে বহিষ্কার করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার প্রধান জায়গাটি হচ্ছে আবাসিক হল। একজন বিভাগীয় শিক্ষককে ছাত্ররা যতটা সমীহ করে, হলের আবাসিক শিক্ষক,  যিনি ভিন্ন বিভাগের শিক্ষক,  তাঁকে ততটা করেনা। আবাসিক হলগুলোর প্রশাসন, সিটের বণ্টন এমনকি বিবিধ অনুষ্ঠান এর আয়োজন পরিপূর্ণভাবে হলের প্রভোস্ট কিংবা হাউজ টিউটর এর  নিয়ন্ত্রণে থাকেনা। অনেক সময় রাজনৈতিক গুণ্ডাদের দ্বারা ছাত্র লাঞ্ছিত হওয়ার মত ঘটনাও ঘটে থাকে। এইসব কারণ জমা হতে হতে অনেক সময় খারাপ কিছু ঘটে যায়, যদিও আপাত কারণ  অনেক সময় খুব সামান্য মনে হয়। খারাপ পরিস্থিতিতে  প্রভোস্ট কিংবা হাউজ টিউটর ঘেরাও হন। সমাজের চোখে শিক্ষক ছাত্র সম্পর্কের অবনত অবস্থা ভেসে উঠে।
 
হলের উপর প্রভোস্ট এবং হাউজ টিউটরদের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ না থাকার প্রধান কারণ,  তাদের নিয়োগ দল করার ভিত্তিতে, যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সিনিয়র শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষককে বাদ দিয়ে,  উপাচার্যের ধামাধরা, অনেক কম অভিজ্ঞ, শ্রদ্ধা আকৃষ্ট করতে অক্ষম শিক্ষককে প্রভোস্ট নিয়োগ করা হয়। হাউজ টিউটর নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ছাত্র রাজনীতির নেতারা অনেক সময় এইসব হাউজ টিউটর কিংবা প্রভোস্টকে সুবিধাভোগী মনে করে।
 
ছাত্র রাজনীতির হল পর্যায়ের একজন নেতাও নিজেকে দলের জন্য অনেক ত্যাগী মনে করে, কারণ আগের সরকারের সময় হয়তো সে হলেই থাকতে পারেনি। অপরদিকে হলের প্রভোস্ট এবং আবাসিক শিক্ষকরা এই শঙ্কায় ভোগেন যে, কখন কোন সিদ্ধান্ত নিলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতারা ক্ষিপ্ত হয়ে কী পরিস্থিতি তৈরি করে। উপাচার্য নিজেও রাজনীতির লোক। তিনি কি শিক্ষকদের  সিদ্ধান্ত সমর্থন করবেন, না কী বাড়াবাড়ির অভিযোগ আনবেন। এইসব কারণে প্রভোস্ট এবং আবাসিক শিক্ষকরা শিক্ষার পরিবেশের পক্ষে এবং সাধারণ  ছাত্রদের স্বার্থের পক্ষে সঠিক অবস্থান নিতে পারেন না। সেই কারণে জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়ে, তাঁরা অনেক সময় রাজনৈতিক ছাত্র কিংবা পরিস্থিতি অনেক খারাপ হলে অরাজনৈতিক সাধারণ ছাত্র দ্বারা ঘেরাও কিংবা লাঞ্ছনার শিকার হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের সাবেক প্রভোস্ট অধ্যাপক আজিজুর রহমান,  কিছু ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়া সরকার দলীয় ছাত্র রাজনীতির কর্মীকে হল ত্যাগ করার জন্য বলায়, তারা যেভাবে তাঁকে অসম্মানিত করেছে তা নজিরবিহীন। হলের হাউজ টিউটররা তাঁকে ঘিরে অন্য একটি কক্ষে আবদ্ধ করে না রাখলে কি হত কে জানে? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওই সমস্ত অসদাচরণকারী, আক্রমণকারী এবং আইনগত মানদণ্ডে বহিরাগতদের বিরুদ্ধে যে ধরণের পুলিশি এবং  ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া সঙ্গত ছিল তা নেয়নি। শিক্ষক রাজনীতি এখানে ছাত্ররাজনীতির উগ্রতার  কাছে হেরে গেছে। শিক্ষকরা রাজনীতির না হয়ে যদি নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতেন তাহলে কি ছাত্রদের উপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ একটু ভাল হতোনা? আরেকটু বেশী নৈতিক ভিত্তি পেত না?

সিলেট শাহজালাল  বিজ্ঞান ও  প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ঘটনা ঘটেছে তা সমকালে নজিরবিহীন। উপাচার্যের পথ রোধ তাঁর সহকর্মীরা করতেই পারেন, যেকোনো কোন দাবিদাওয়ার প্রেক্ষিতে। তাই বলে রাজনৈতিক ছাত্ররা শিক্ষকদের ব্যানার ধরে টানাটানি করবে, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করবে, এটা গোটা সমাজকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। এইসব ঘটনা কি ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশে নিজেদের লোককে সমর্থনের ইগো থেকে করা হয়েছে , না কি স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির মেরুকরণের জায়গা থেকে করা হয়েছে, তা ভেবে দেখতে হবে।তবে সমাজ পিছিয়ে গেল অনেক খানি। মূল্যবোধের অর্জনের জায়গায় অনেক খানি ক্ষয় হল। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের জায়গায় স্থায়ী দাগ তৈরি হল।

সরকার এর নির্বাহী কর্তৃত্বও এখানে কম দায়ী নন। তাঁরা  উপাচার্য নির্বাচনের সুপারিশ মহামান্য চ্যান্সেলরের পাঠানই দলীয় ভিত্তিতে।পরে এইসব উপাচার্যের বিভিন্ন অনিয়মের সমর্থনের যোগানও আসে ওই নির্বাহী কর্তৃত্বের কাছ থেকে, কখনও প্রশাসনিকভাবে আবার কখনো রাজনৈতিকভাবে।সিলেটের উপাচার্যও তাঁর ভাষ্যমতে সরকারের নির্দেশেই “একাডেমিক কাউন্সিল” এর মিটিং করতে এসেছিলেন।

শিক্ষকদের উপর ছাত্রদের হামলার সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটেছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, বি এন পি এর নব্বই উত্তর খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের সময়। সিনেট কর্তৃক নির্বাচিত  উপাচার্য অধ্যাপক আলমগির মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিনকে দিনের পর দিন বাড়ি ঘেরাও করে, খাবার সরবরাহ বন্ধ করে, এক অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি করে পদত্যাগে বাধ্য করতে চেয়েছিল, সেখানকার জামাত শিবির চক্র এবং তাদের ক্যাডাররা, কোন গুরুতর অভিযোগ ছাড়াই। এই ঘটনার প্রতিবাদে সাধারণ শিক্ষকরা  র‍্যালি বের করলে, শিবির ক্যাডাররা শিক্ষকদের উপর ভয়াবহ হামলা করে। শিবির ক্যাডাররা সবচেয়ে বেশী লাঞ্ছিত করে নারী শিক্ষকদের। ইংরেজি বিভাগের একজন শিক্ষিকার লাঞ্ছনার ঘটনা , তাঁর  সহকর্মীদের ঘটনার একযুগ পরেও বেদনার সাথে বলতে শুনেছি। কি দুর্ভাগ্য আর বেদনার কথা, সেই  হামলাকারী শিবির ক্যাডারদের একজন পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়।

ছাত্র শিক্ষক সুসম্পর্ক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে খুবই জরুরী। জ্ঞান চর্চার প্রথম ধাপই হচ্ছে গুরুর প্রতি সম্মানবোধ। ছাত্র এবং শিক্ষক রাজনীতি উঠিয়ে দেওয়ার মত চরম সমাধানের দিকে না গিয়েও, এই রাজনীতির বাস্তবতার মধ্যেও তার সমাধান সম্ভব, যদি  শিক্ষক রাজনীতি সুবিধাবাদের না হয়ে একেবারেই মতাদর্শ কেন্দ্রিক হয় এবং কোনভাবেই শিক্ষকতার মর্যাদা এবং জ্ঞান প্রবাহের বিঘ্নমূলক না হয়। একজন শিক্ষককে জ্ঞান ও ক্ষমতার মধ্যে বাছাই করতে বললে, তাঁর জ্ঞানের পক্ষেই অবস্থান নেওয়া উচিত। আর ছাত্রের উচিত তাঁর রাজনীতি এমনভাবে করা যাতে তার নিজের আত্মসম্মান এবং তার শিক্ষকের সম্মানের হানি না ঘটে।

বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তির, দাসত্বের নয়। যে রাজনীতি মুক্তি নয়, দাসত্ব আরোপ করে, সেই রাজনীতিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করা ছাত্র এবং শিক্ষক উভয়েরই কর্তব্য।

আরও পড়ুন : আবারও শিক্ষক হত্যা!

জহিরুল হক মজুমদার, সহযোগী অধ্যাপক, ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ