প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
বিপ্লব কর্মকার | ১৫ মে, ২০১৬
এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে দেখা যায় অস্বাভাবিক পাশের হার। আমাদের সময় পাশের হার ৩০-৪০% এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। এই পাশের হার নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। গত কয়েকবছর থেকেই এমনটা হয়ে আসছে। শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করছে এটা যেমন সত্য তেমনি সরকারের কিছু অলিখিত নীতিমালার বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে পাশের হার বাড়ছে এটাও সত্য।
তবে এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় বরিশাল বোর্ডে একটি স্কুলের হিন্দুধর্মের শিক্ষার্থীদের গণহারে ফেল। যদিও একই শিক্ষার্থী অন্যান্য সব বিষয়ে ভাল ফল করেছে কিন্তু হিন্দুধর্মে ফেল করার কারণে পুরো পরীক্ষাতেই ফেল। এই ফেল করা ছাত্রদের একজন স্কুলভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। আমার উদ্বেগ এবং মনঃক্ষুণ্ণের কারণ এখানেই।
২
হিন্দুধর্মে ফেল করা ছাত্রদের বলব- এই ফেলের কারণে অসম্মানের কিছুই হয়নি। ভারতে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ধর্ম বিষয়টা নেই। গণিত ও বিজ্ঞানে এ-প্লাস (A+) পাওয়া ছাত্র যদি হিন্দুধর্মে ফেল করে থাকে আমি তো মনে করি এটা তার জন্য গর্বের বিষয়। উচ্চতর শিক্ষায় ধর্মের কোন স্থান নেই। স্রষ্টার স্বরূপ বর্ণনা কর-এ ধরনের প্রশ্নে যদি কেউ বিজ্ঞানের আলোকে লিখতে যায় সে তো শূন্য পাবেই।
আবার বর্তমানে প্রচলিত বইতে যা লেখা আছে তা লিখতে গেলে হবে আত্মপ্রতারণা। তাহলে যারা ফেল করেছ তারা যে খুব একটা অসম্মানিত হয়েছ তা বলা যাবে না। এটা একবিংশ শতাব্দীর একজন নাগরিকের জন্য গর্বের।
৩
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ মেট্রিকুলেশন পাশ করেনি, নজরুলও করেনি। কিন্তু আজ তাদের নিয়ে পিএইচডি করা হয়। গুরুদেব বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে এক অর্থে পড়াশুনার চাপ সইতে না পেরে ফেরত এসেছেন।
যে এলাকায় এ ঘটনা সেই বরিশালের মুক্তমনা মানুষ আরজ আলী মাতুব্বর প্রাথমিকের গণ্ডিও পেরুতে পারেননি। কিন্তু তার লেখা বইগুলো আজ বহু শিক্ষিত মানুষের চিন্তার খোরাক। আমরা বহু শিক্ষিত মানুষরাও তার মত করে চিন্তা করতে পারব না বা পারছি না। তারা সকল সার্টিফিকেট ডিগ্রির ঊর্ধ্বে।
“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে" বিখ্যাত এই কবিতার লেখিকা বরিশালের কুসুমকুমারী দাশ কি এসএসসি পাশ করেছিলেন?
৪
গত তিন বছর ধরে দেশের শিক্ষাসংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে নিজে নিজে একা একা কাজ করছি এবং দুয়েকটি দুর্নীতি উদঘাটনও করেছি। এ বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, শিক্ষক মনোযোগ দিয়ে খাতা মূল্যায়ন করে না, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে নেই এমন প্রশ্নের জবাবে নম্বর প্রদান করা হয়, উত্তর সঠিকভাবে না পড়ার কারণে সঠিক উত্তরে খাতায় শূন্য দেয়া হয়, ভিতরের প্রাপ্ত নম্বর ঠিকভাবে যোগ করে খাতার উপরে বসানো হয় না।
পরীক্ষকের ভুলগুলো নিরীক্ষকের হাতে ধরা পড়ে না। ফলে যা হবার তাই হয়, পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলের উপর যার পুরস্কার পাওয়ার কথা সে পায় না, যার পাওয়ার কথা নয় সে পায়। Foul is fair, fair is Foul.
যেকোনো ধরনের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় জয়ী বা পরাজিত প্রার্থীর আক্রোশের শিকার হয় হিন্দুসম্প্রদায়।
জমি দখল, কিশোরী কন্যা লাভের হাতছানি ইত্যাদি নানা কারণে আজ হিন্দু শিক্ষিতরা দেশান্তরি। যে কারণে বহু স্কুলেই হিন্দুধর্মীয় শিক্ষক নেই। এই ঘটনার ক্ষেত্রেও অনেকেই মনে করেন, হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষকের হাতে খাতা মূল্যায়ন-পুনঃনিরীক্ষণ হয়নি।
৫
একজন শিক্ষার্থীর জন্য এসএসসি পরীক্ষা জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় এসএসএসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত জিপিএর শতকরা হারের কিছু অংশ যোগ করা হয়। এ কারণে এই দুটি পরীক্ষায় প্রাপ্ত জিপিএ একজন শিক্ষার্থীর জীবনে আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। এই দুই পরীক্ষায় প্রাপ্ত জিপিএর গুরুত্ব যদি শিক্ষাবোর্ড না বুঝে তাহলে তা খুবই দুঃখজনক।
একটি পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস যাতে না হয় সেই ব্যবস্থা করার দায়িত্ব শিক্ষাবোর্ডের। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছেই। সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন-নিরীক্ষণ-পুনঃনিরীক্ষণের দায়িত্বও শিক্ষাবোর্ডের। এখানেও তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
৬
একজন এসএসসি পরীক্ষার্থীর বয়স কতই বা, ১৪-১৮ এর মাঝে। এই বয়সের একজন বালকের মন অতি আবেগপ্রবণ। ভালো পরীক্ষা দিয়েছে, সমবয়সী বন্ধুবান্ধব সবাই পাশ করেছে, নিজের পিছিয়ে পড়াটা মেনে নিতে পারেনি।নিজের কাছে নিজেকে প্রচণ্ড অসম্মানিত মনে হয়েছে। নিজের প্রতি নিজের রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ফলে যা হবার তাই হল, পরীক্ষার ফল শোনামাত্র স্কুলের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে।
পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগের দিনগুলোতে অভিভাবক ও আশেপাশের সহপাঠীদেরও অবশ্য পালনীয় কিছু কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য আছে। প্রতিযোগী মনোভাব ভালো, কিন্তু এজন্য অন্যের সাথে তুলনা করে নিজের সন্তানকে গাল-মন্দ করা, বন্ধুবান্ধবদের কটূক্তি এসব সর্বাংশে পরিহার করতে হবে। এ আচরণগুলি একজন টিনেজ বয়সের শিক্ষার্থীর মনে চাপ বাড়িয়ে দেয়। যখন সে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভে ব্যর্থ হবে তখন আশেপাশের পারিপার্শ্বিক অনাকাঙ্ক্ষিত চাপ তার মনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে, যেকোনো উপায়ে আত্মহননের পথ বেছে নিবে।
৭
ফেল করলে আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়। পুন:নিরীক্ষণের সুযোগ আছে। এরপর ও কাজ না হলে তথ্য অধিকার আইনে খাতা দেখার সুযোগ আছে। কিন্তু আত্মহত্যা কোনভাবেই কাম্য নয়। কারো যদি আত্মবিশ্বাস থাকে যে, পাশ করব কিন্তু কোন সমস্যার কারণে ফেল রেজাল্ট এসেছে তাহলে প্রবেশপত্র ফটোকপি করে আমার কাছে পাঠান, আমি আপনার হয়ে লড়ব।
আবার ও বলছি আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়। এতে পিতামাতার অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য