প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
শিবলী নোমান | ১৫ মে, ২০১৬
বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের এক নতুন বিপদ হাজির হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে তাদের বিরুদ্ধে চলছে বিডিএস নামের এক মুভমেন্ট। এর সারকথা হলো- ‘ফিলিস্তিনের উপর অবৈধ আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলের পণ্য, বিনিয়োগ, সেবা সবকিছুর ওপর অবরোধ এবং অসহযোগিতা’।
গেলো বছর ফিনান্সিয়াল টাইমসের এক হিসেব বলছে, ওই এক বছরে বিডিএস মুভমেন্ট ইসরায়েলের বিশ্ববাণিজ্যে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি করেছে। তাদের আশঙ্কা এই ক্ষতি বাড়বে। দশ বছরে এই ক্ষতি ৪৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি দাঁড়াবে।
এই সময়ের মধ্যে গাণিতিক হিসাব নিকাশের বাইরে দৃশ্যমান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও ইসরায়েলকে কম হতে হয় নি। তাদের গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাগ্রেক্সকো ইউরোপের ১১টি দেশে বিডিএস মুভমেন্টের কারণে বিনিয়োগকারী পাচ্ছে না। আহাভা নামের এক প্রসাধন পণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানকে লন্ডন, কানাডা, জাপান ও নরওয়ে থেকে তাদের খুচরো ব্যবসা গুটাতে হয়েছে। বিশ্বজুড়ে (বিশেষত ইউরোপে) এমন অনেক ঘটনা আছে। কোথাও কোথাও চুক্তির পরেও ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে বাস্তবিক কারণেই নতুন বাজার ও বিনিয়োগ নিয়ে ইসরায়েল এখন আগের চেয়েও বেশি প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে।
ইসরায়েল ও বিডিএস নিয়ে লিখতে গিয়ে একটি কাকতালীয় বিষয় তুলে ধরার লোভ সামলানো গেলো না। তাভেল্লা চেজারেকে মনে আছে? গেলো বছর গুলশানে এই ইতালিয়ানকে খুন করা হয়েছিলো। এরপর আইএস-এর নামে দায় স্বীকারের বার্তা গণমাধ্যমে আসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘বিতর্কিত’ সাইট ইন্টেলিজেন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বরাতে। ইসরায়েলের দুঁদে স্পাইদের দুর্দান্ত সংস্থা ‘মোসাদ’কে ঘিরে আমাদের দেশের সাম্প্রতিক আলোচনাকে ধরে ইসরায়েল নিয়ে লিখতে বসে হঠাৎই চেজারের কথা মাথায় এলো।
বাংলাদেশে চেজারে কাজ করতেন নেদারল্যান্ডভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থায়। নাম তার আইসিসিও কো-অপারেশন। খুব বেশিদিন নয়, চাকরি নিয়ে তিনি ঢাকা এসেছিলেন মারা যাওয়ার বছর খানেকেরও কম সময় আগে।
যদ্দূর জানা যায়, চেজারে এর আগে কাজ করতেন তার নিজের দেশে। সংস্থাটি আমাদের অতি পরিচিত। নাম ‘অক্সফাম’। চেজারের সাবেক ও মৃত্যুর আগের দুটি কর্মস্থলের মধ্যে এক অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। আইসিসিও এবং অক্সফাম- এই দুই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই ২০১৩ সাল থেকে লাগাতার অভিযোগ তুলে এসেছে ইসরায়েল। শুরুতে তা ছিলো ফিলিস্তিনিদের পরোক্ষ সহায়তা দেয়ার। পরবর্তীতে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী বয়কটের ডাক দেয়া ক্যাম্পেইন ‘বিডিএস অ্যন্টি ইসরায়েল’কে নানাভাবে সহায়তা দেয়ার অভিযোগ।
অক্সফামের বিরুদ্ধে ইসরায়েল তাদের স্বার্থবিরোধী কাজের অভিযোগ এনেছে দু থেকে তিন দফা। আইসিসিও কো-অপারেশনের বিরুদ্ধে ইসরায়েল ডাচ সরকারের কাছে কয়েক দফা নালিশ জানিয়েছে। বিডিএস মুভমেন্টের প্রচারণা ‘ইলেক্ট্রনিক ইন্তিফাদা’র পেছনে তহবিল যোগানোর অভিযোগও তোলা হয়েছিলো ইসরায়েলের তরফে আইসিসিও’র বিরুদ্ধে। বিষয়টি ইসরায়েল-নেদারল্যান্ড কোঅপারেশন ফোরামে আলোচনার পর ডাচ পার্লামেন্টেও আলোচনা ওঠে। এতোকিছুর পরেও এই দুই সংস্থার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অভিযোগের কোনো কমতি নেই। সবশেষ অক্সফামের ব্যাপারে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই সংস্থাটি মধ্যপ্রাচ্যে ডাচ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিপুল অঙ্কের তহবিল পাচ্ছে। এর মধ্যে বড় অংশ ব্যয় করা হচ্ছে ওই অঞ্চলে। আইসিসিও এবং কার্ক ইন অ্যাক্টি বা চার্চ ইন অ্যাকশন নামের প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক চার্চভিত্তিক নেটওয়ার্ক তৈরি করছে, যেখানে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভয়াবহ ‘থিওলজিকাল’ উপাদান যুক্ত করা হচ্ছে। যদিও সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে বহুবার।
তাভেল্লা চেজারে যে দেশের নাগরিক ছিলেন, সেই ইতালির বিরুদ্ধেও কমবেশি অভিযোগ আছে ইসরায়েলের। বিশেষ করে একুশ শতকে নব্য ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’ ওই দেশের সমাজে তৈরি হচ্ছে বলে মনে করে ইসরায়েল। একারণে চার্চগুলোর তৎপরতা নিয়ে ইসরায়েলের মাথাব্যথা কম নয়। বোঝাই যাচ্ছে, আইসিসিও কিংবা অক্সফামসহ অন্তত ১৭টি সংস্থার ওপর বিডিএস নিয়ে ইসরায়েল যে খড়গহস্ত, তার অন্যতম কারণ অর্থনৈতিক।
পরিস্থিতি যখন এমন, তখন ইসরায়েল তাদের নতুন কৌশল নিয়ে মাঠে আসবে, এটাই স্বাভাবিক। সে এসেছেও। তাদের অর্থনীতির একটি বড় অংশ আসে কৃষি, কৃষিজাত ও কৃষিযোগ্য পণ্য থেকে। দীর্ঘ সময় ইউরোপই তাদের এই খাতের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিলো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা তাদের এশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা টের পাই। এক্ষেত্রে সব থেকে বেশি তারা ভারতের পেছনে সময় দিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তারা নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েছে।
২০১৩ সালে জেরুসালেম পোস্টে ইসরায়েলি সরকারের এক ভাষ্য ছাপা হয়। সেখানে বলা হয়, “আমরা (ইসরায়েল) সংলাপ চাই। বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আমরা দুদেশের মানুষের মধ্যে সুসম্পর্ক চাই। আমরা চাই বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ জেরুসালেমের পবিত্র ভূমিতে আসার সুযোগ পাবে।” কিন্তু ফিলিস্তিন প্রশ্নে বাংলাদেশের অনড় অবস্থান বারবারই ইসরায়েলের সেই আহ্বানকে দেয়ালে ঠোকর খাইয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে। জেরুসালেম পোস্টেই উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফিলিস্তিন প্রশ্নে কোনোমতেই ছাড় দেবেন না। এমন অবস্থায় ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের স্বপ্ন সুদূর পরাহত।
ইসরায়েলের জন্য প্রেক্ষাপট যখন এমন, তখন বিএনপির এক যুগ্ম মহাসচিবের সঙ্গে মোসাদের বৈঠকের খবর এসেছে। দিল্লিতে ইসরায়েলের লিকুদ পার্টির নেতা মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর ছবিও গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। ঢাকায় ফিলিস্তিনের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার বলেছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে এই সম্পর্ক হবে আত্মঘাতী। যদিও বিএনপি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা বলছে, এটি একটি ফাঁদ। সে যদি সত্য বলেও ধরে নেয়া হয়, তারপরেও প্রশ্ন ওঠে, একটি রাজনৈতিক দলের দেউলিয়াত্ব কতোটা প্রকট হলে এভাবে ফাঁদ পাতা যায় এবং তাতে ধরাও পরে!
তবে বিএনপির এই দাবির আগেই এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন মেন্দি এন সাফাদি স্বয়ং। জেরুসালেম অনলাইন ডটকমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘শিগগিরই সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দরজা ইসরায়েলিদের জন্য খুলে দেওয়া হবে। আর এটা অসম্ভব কোনো আকাঙ্ক্ষা নয়। নির্যাতিত এবং মানুষের স্বাধীনতার জন্য কাজ করা একটি নৈতিক দায়িত্ব। সেজন্য আমি এসব লোকের সহায়তার জন্য রয়েছি। বাংলাদেশে নির্যাতিত কাহিনীগুলো সত্যিকারের। প্যালেস্টাইনের মতো বানানো নয়। এখানে মানুষ নিপীড়িত হচ্ছে, কারণ তারা ভিন্নমতের। এক্ষেত্রে আমি ইসরায়েলি হিসেবে গর্বিত। আমি আরও গর্বিত যে, অনেক বাংলাদেশি ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতিশীল। যদিও বাংলাদেশের নাগরিকদের পাসপোর্টেও লেখা থাকে, ইসরায়েল ছাড়া সারা বিশ্বে তারা ভ্রমণ করতে পারবে। সেটাও আমি শিগগিরই পরিবর্তন করতে যাচ্ছি।’ ঠিক কার ভরসায় তিনি এমন দৃঢ় আশায় বুক বেঁধেছিলেন, তা অবশ্য স্পষ্ট করেন নি। তবে হালে বিএনপি নেতার সঙ্গে ফাঁস হওয়া বৈঠকের খবর আর ছবি তার কিছুটা ইঙ্গিত দিতে পারে।
ঘটনার পরম্পরা আবারো সামনে তুলে আনছে, বাংলাদেশের প্রতিটি ঘটনায় আইএস-এর দায় স্বীকারের খবর দেয়া সেই সাইট ইন্টেলিজেন্সের রিটা কার্ৎজের বিরুদ্ধে মোসাদ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ। একথাও সত্যি যে, আইএস উত্থানের পর থেকেই নানা পর্যায়ে এর পেছনের শক্তি হিসেবে যেসব এসপিওনাজ এজেন্সির কথা আলোচিত হয়েছে মোসাদ তাদের অন্যতম।
কাজেই ইসরায়েল ও বিএনপিকে ঘিরে সাম্প্রতিক যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তাকে স্রেফ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ছকে বোঝার চেষ্টা বোকামি হতে পারে। বরং পুরো বিষয়টিকে ভূরাজনীতির আলোকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে দেখা এবং নিজেদের তৈরি হওয়ার প্রয়োজনীয়তাই এখন সবচেয়ে বেশি।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য