প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
এনামুল হক এনাম | ১০ জুন, ২০১৬
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে টার্গেট কিলিং। সপ্তাহ-মাস যাবত একজনের গতিবিধি নজরে রাখা হচ্ছে, সে কোথায় যায়, কি করে, কখন সবচেয়ে বেশি একা এবং অনিরাপদ অবস্থানে থাকে এইসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে একজনকে টার্গেট করে কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। গত এক সপ্তাহের মধ্যেই ৪-এর অধিক টার্গেট কিলিং সফলভাবে সম্পন্ন করেছে স্লিপার সেলের কর্মীরা। এইসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ভিন্নমতাবলম্বী ভিন্ন ধর্মের মানুষ থেকে পুলিশ সুপারের স্ত্রীও আছেন।
লেখার শুরুটা আরো একটু আগে থেকে করতে চাই। আরো আগে বলতে আওয়ামীলীগ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্ষমতায় আসে সে সময় থেকে। আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করার পর যখন মিডিয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপার সামনে নিয়ে আসে তখন জামায়াতে ইসলামের শীর্ষস্থানীয় নেতারা দম্ভ ভরে বলেছিলেন এই দেশে কখনো যুদ্ধাপরাধ সংগঠিত হয়নি এবং এই দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। খুব কম সময়ের ভিতরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে তারা আরো তাচ্ছিল্য ভরে এও বলেন যে, এই ধরণের বিচার শুরু হলে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। আশপাশের অনেক পরিচিত জনকে মাঠ পর্যায়ে জামায়াতে ইসলামের ক্ষমতাকে সম্মান প্রদর্শন পূর্বক গৃহযুদ্ধের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বলতে দেখলাম। শুধু মাঠ পর্যায়ে ক্ষমতাই নয় তাদের অর্থের পর্যাপ্ততা এবং অফুরন্ত যোগান পুরো বিষয়টিকে পুনরায় ভাবতে বাধ্য করেছিলো, সবকিছুর পর দেশটির নাম যে বাংলাদেশ।
ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলো, প্রথমে অন্য মামলায় এবং পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধীর মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলো একাধিক জামায়াত এবং বিএনপি নেতাকে। তবে গ্রেফতার পর্যন্তই, শাস্তির প্রশ্নে জামায়াত বিএনপির অনেক বড় নেতাকেই দেখতাম পুরো বিষয়টাকে সহাস্যে উড়িয়ে দিতে। সবার মনেই তখন এক সন্দেহ দানা বেঁধেছিলও যে, সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে একটি প্রহসনের অবতারণা করে নামমাত্র শাস্তি দিয়ে মূল যুদ্ধাপরাধীদের এক ধরণের দায়মুক্তি দেবে।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে কাদের মোল্লার রায়ের পূর্বে জামায়াত শিবির কর্মীদের হাত থেকে পুলিশ সদস্যদের গোলাপ এবং রজনীগন্ধা নেয়ার দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। রায়ে কাদের মোলার যাবজ্জীবন শাস্তি প্রদানে প্রহসনের সত্যতা দেশের মানুষের নজরে চলে আসে। আর তারপর গণজাগরণ আন্দোলন ইতিহাস। গণজাগরণ আন্দোলন শুরু থেকেই ‘নাস্তিকদের সমাবেশ’ বলে প্রচারে লেগে যায় স্বার্থান্বেষী মহল। সেই সূত্রে রাজীব হায়দার হত্যা। আর সেই থেকে শুরু নাস্তিক ব্লগার আখ্যা দিয়ে হত্যাকে ‘হালাল’ করার এক ধরণের কূটকৌশল। যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে হেফাজতে ইসলাম কখন যে গুটির চাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে গেলো তা তারা হয়তো নিজেরাই টের পায়নি। সাঈদীর রায়ের পর ধ্বংসযজ্ঞ, একাধিক জেলাকে বাংলাদেশ থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা... সবই সকলের জানা এবং দেখা ইতিহাস।
একদিকে যখন নাস্তিক আখ্যা দিয়ে একের পর এক ব্লগার হত্যা হচ্ছিলো তখন পুরো বিষয়টা পক্ষে যাচ্ছে ভেবে আওয়ামীলীগকে দেখেছি তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে আর জামায়াত-বিএনপিকে দেখেছি দেশকে অস্থিতিশীল করে ক্ষমতার হাওয়ার সন্ধানে ব্যাকুল হতে, অবরোধের নামে একের পর এক বাস, ট্রাক পুড়িয়ে হত্যাযজ্ঞে মাততে!
ব্লগার হত্যার পুরো বিষয়টি সরকার ফায়দার চোখে দেখতে লাগলো, এবং এখানেই হলো মূল ভুলটি। অন্যের অন্যায় কাজ যতই নিজের পক্ষে যাক, অন্যায় সব সময়ই অন্যায়। এ থেকে ফায়দা হাসিল কখনোই দীর্ঘস্থায়ী সুফল বয়ে আনে না। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া অন্যায় কাজকে উৎসাহ প্রদানের সামিল। ঘটলোও তাই, যখন একটি গোষ্ঠী যখন দেখলো সরকারকে কোনো ভাবেই বশে আনা যাচ্ছে না তখন তারা তাদের টার্গেট চেঞ্জ করলো, ভিন্ন মতাবলম্বী থেকে তা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, সংখ্যালগিষ্ট থেকে সমকামী, আর এখন পুলিশ সুপারের স্ত্রী। সবগুলো হত্যাকাণ্ডের একই উদ্দেশ্য, বিশ্ব মোড়লদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কথা বলার সুযোগ করে দেয়া, যাতে তারা সরকারকে চাপে ফেলে পদত্যাগে বাধ্য করে।
যুগে যুগে স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক ধর্মকে প্রায়ই ব্যবহার করা হয়েছে ক্ষমতায় টিকে থাকার অবলম্বন হিসেবে। এতে প্রয়োজন হলে ধর্মের নামে হত্যাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অথচ পৃথিবীতে প্রবর্তিত কোনো ধর্মই নিরপরাধ মানুষ হত্যাকে স্বীকৃতি দেয় না।
আবার ফিরে আসতে চাই পুলিশ সুপারের স্ত্রী হত্যার পরবর্তী কর্মকাণ্ডে। লক্ষ্য করুন, এতদিন যাবত এতগুলো হত্যাকাণ্ডকে কখনো নাস্তিক, কখনো বিধর্মী, ভিন্ন মতাবলম্বী, সমকামী কিংবা নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে কৃত্রিম হাসি হেসে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলেও এখন বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। হত্যাকারীদের দ্রুত সময়ের ভিতরে গ্রেফতারের চেষ্টার পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দিয়ে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তৃণমূল পর্যায়ে একশনে যাওয়া হচ্ছে।
যেনো কেউ অপেক্ষা করছিলো, একজন পুলিশ সুপারের স্ত্রী হত্যা না হওয়া পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। আমি নিরাপদ, আমি তো ব্লগার না, আমি তো হিন্দু না, আমি তো খ্রিস্টান না, আমি তো বৌদ্ধ না, আমি তো সমকামী না... এইসব চিন্তা করে নিরাপদে বসে থাকা উপর থেকে নিচ তলার সবাই হঠাৎ করে হয়ত অনুধাবন করছেন আসলে কেউই নিরাপদ নয়। একটি ব্যাপার লক্ষণীয় যে, যেদিন সরকার ঘোষণা দিয়ে জঙ্গি নিধনে নেমেছে সেদিনই সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পাবনায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজনকে হত্যা করা হয়েছে প্রকাশ্যে কুপিয়ে!
বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ, এই দেশে নাস্তিকদের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। শতকরা হিসেবে তারা একেরও নিচে, দশমিকে। তাহলে নাস্তিকদের নিয়ে এতো আলোচনা কেন? উত্তর একদমই সহজ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের ঘৃণ্য কৌশল। এদেশে নাস্তিকদের একটি ছোট অংশ অনলাইনে লেখালেখি করেন। অথচ আস্তিকদের বিরাট একটি অংশ ফেইক আইডি বানিয়ে ফেইসবুক এবং ব্লগে ব্যস্ত বাংলাদেশে নাস্তিক্যবাদ প্রমাণে এবং নাস্তিকদের হত্যাকে হালাল করার হাস্যকর প্রয়াসে। লক্ষ্য করলে দেখবেন, তারা অনেক ক্ষেত্রেই সফল। ভুয়া সব আইডি খুলে হিন্দুর নামে মুসলমানকে কিংবা মুসলমানদের নামে হিন্দু বা ভিন্ন ধর্মের মানুষকে অনলাইনে আক্রমণ করা হচ্ছে, ভুয়া ছবি ছড়ানো হচ্ছে... উদ্দেশ্য একটাই, দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে ক্ষমতার পালা বদল।
প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের পর যখন অনলাইনে কিছু লোক বিচার চাই, নিরাপত্তা চাই... চিৎকার করছে তখন কিন্তু সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকেই নিজেদের ক্ষমতার আসনকে পাকাপোক্ত ভেবেছেন। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো মাঠের বিরোধীদলকে জঙ্গিগোষ্ঠী আখ্যায়িত করে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বিদেশী পর্যবেক্ষকদের ঢেকে এনে বুঝানোও গেছে যে আওয়ামীলীগ একমাত্র দল যারা জঙ্গিদের নিধন করতে পারে। কিন্তু একই সান্ত্বনা এবং প্রতিশ্রুতি কতদিন দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকরা মানবেন, যেখানে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন প্রায় শূন্য।
ধর্ম মানুষকে সুন্দর ভাবে বাঁচার পথ দেখায়, কোনো ধর্মই হত্যা, হানাহানি কিংবা তথাকথিত টার্গেট কিলিং সমর্থন করে না। তাহলে ধর্মের নামে কেনো এই হত্যাকাণ্ড!! উত্তর ঐ আগেরটাই, চাই ক্ষমতা... তা যেকোনো উপায়েই হোক। ইসলাম ধর্মে রমজান মাসে রক্তপাত নিষিদ্ধ, অথচ আজ তৃতীয় রমজানের দিনেই একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে হত্যা করা হয়েছে, হয়ত আজ কালের মধ্যেই এই হত্যার দায় নেবে আইএস। একটু ভেবে দেখুন এইসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত যারা তারা আদৌ কতটা ধর্মীয় বিশ্বাসী।
পৃথিবীর কোনো ধর্মগ্রন্থই ধর্মের নামে নিরপরাধ মানুষদের হত্যার স্বীকৃতি দেয় না, তা সে ভিন্ন ধর্মের হোক আর ভিন্ন মতাবলম্বীই হোক। ধর্ম গ্রন্থের দোহাই দিয়ে যদি এই ধরণের হত্যাকাণ্ড চলে তবে অচিরেই পৃথিবীতে শুধু ধর্মগ্রন্থই থেকে যাবে মানুষ নয়।
টার্গেট কিলিং কে করছে, কিভাবে করছে তা জানার দায়িত্ব আমার না। এর জন্য দেশের সুনির্দিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আর এইসব কিছু তদারকি করছেন স্বয়ং সরকার প্রধান। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার আপনার নিরাপত্তার দায়ভার সম্পূর্ণই সরকারের। আমরা জানি সরকারের শক্তি এবং ক্ষমতা কতটুকু, জানি সরকারের সীমাবদ্ধতার কথা।
আমাদের চাওয়াও খুব বেশি নয়, ঘাড়ে মাথা নিয়ে বেঁচে থাকার নিরাপত্তাটুকু অন্তত দিন, আমি, আমরা বেঁচে থাকলেই তো কণ্ঠে থাকবে জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান। নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব যখন নিয়েছেন, তখন আমার মৃত্যুর দায়ভারও আপনাকেই নিতে হবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য