আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ!

সঙ্গীতা ইয়াসমিন  

জুলাই এক তারিখ, শুক্রবার, পবিত্র রমজান মাসের জুম্মাতুল বিদার রাতে নামাযের আযান পড়ার সাথে সাথে যখন কোন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, সেটি যে কোনভাবেই ইসলামের উদ্দেশ্যে নয়; কোনভাবেই ধর্ম রক্ষার যুদ্ধ নয়, ইসলামী শাসন কায়েমের স্বার্থে নয় সে বিষয়ে কারও মনে কোনোরূপ সন্দেহের অবকাশ থাকার কথা নয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সত্য যে, এর মাঝেও কেউ কেউ ধর্ম রক্ষার ডঙ্কা বাজাচ্ছেন, আবার কেউ কেউ ইসলামে এ জাতীয় খুন জায়েজ রয়েছে বলে কোরানের আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। ঘর পোড়ার মধ্যেও যে আলু পুড়িয়ে খেতে অনেকে ভালোবাসেন সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। যদিও এটি আমাদের জাতিগত অভ্যাস, আমরা কোন সঙ্কটেই কস্মিনকালেও একাট্টা হয়ে তার মোকাবিলা করতে পারি না, আবার আমাদের পরমত সহিষ্ণুতাও শূন্যের কোঠায়।

গুলশানের এই হামলা ও হত্যাকাণ্ড যেমন কোনভাবেই বিচ্ছিন্ন নয়; তেমনই সুপরিকল্পিত, সুসংগঠিত, সুসজ্জিত এবং আরও অনেক বড় ধরনের হামলার শুভ সূচনা মাত্র একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই ঘটনায় আমরা আতঙ্কিত, মর্মাহত, ভীতসন্ত্রস্ত। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি বিস্মিত নই; কারণ এমন ঘটনা যে কোন সময় যে ঘটতে পারে তার পূর্ব আলামত আমরা জনসাধারণেরা অনুমান করতে পেরেছিলাম। আর সেই দুর্ভাবনা থেকেই আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম সকল চোরা গোপ্তা হামলার বিচার হোক। বিচার হোক ধর্মের নামে ব্লগার-লেখক হত্যার, বিচার হোক ইসলামের নামে নোংরা রাজনীতি চর্চার। কিন্তু,অত্যন্ত পরিতাপের সাথে বলতে হয়  রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে আমাদের সেই প্রত্যাশা কেবল অরণ্যে রোদনই ছিল।

যারই ফলশ্রুতিতে, গত দুই বছরের কোন খুনের বিচার তো দূরে থাক সন্ত্রাসীদের ধরার কোন উদ্যোগ আদতেই দৃশ্যমান হয়নি। উপরন্তু, প্রতিটি ঘটনার পরেই সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা, দেশে জঙ্গি নেই এবং আমরা অনেক নিরাপদ আছি এ জাতীয় মন্তব্যের মধ্য দিয়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে একপ্রকার স্বাগত জানানো হয়েছে। এমনকি নাস্তিকের মৃত্যুতে রাষ্ট্রের কোন দায় নেই এ জাতীয় বক্তব্যও উচ্চারিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী তনয়ের কণ্ঠে।সরকার ও প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের এহেন আচরণ স্বাভাবিকভাবেই জঙ্গি দমনে সরকারের ঔদাসীন্যের সাথে সাথে জঙ্গি উৎপাদন তথা বিকাশে সরকারী পরোক্ষ মদদ সুস্পষ্ট বলেই সন্দেহ হয়।

একথা বলা বাহুল্য হবে না যে, ৭৫ পরবর্তী সময়ের সকল সরকারই রাজনৈতিক হীন স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে জামাত ইসলামের মত স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি তথা মৌলবাদী ইসলামী জঙ্গিদলকে এদেশে শেকড় গেঁড়ে বসার সকল পথ সুগম করে দিয়েছে।যার খেসারত দিতে হচ্ছে রাষ্ট্রব্যবস্থার অনেক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে এবং নিরীহ সাধারণ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি এখনও বিশ্বাস করি না গুলশানের এই ঘটনায় আইএস কিংবা আন্তর্জাতিক কোন মহল জড়িত আছে; আর থাকলেও এ বিষয়ে এখন দৃষ্টি ফেরানোর আর কাদা ছোঁড়াছুড়ির কোন অবকাশ নেই।এখন সময় হল জরুরি ভিত্তিতে ঘুরে দাঁড়ানোর। দল-মত, রাজনীতিক, সাধারণ মানুষ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক সহ সকল বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে জঙ্গি নির্মূলে সরকারের একটি সর্বাত্মক জরুরি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ দরকার।এক্ষেত্রে সরকারকে কিছু জরুরি পন্থা, কিছু স্বল্প মেয়াদী আর দীর্ঘ মেয়াদী পন্থা অবশ্যই গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ যত দীর্ঘ সময় ধরে ইসলামের এই বিষবৃক্ষকে ধর্মের নামে অধর্ম করতে দিয়েছি এ মাটিতে এবং যার ফলে, আজ সেটি মহীরুহ হয়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। সুতরাং, সেই জঞ্জাল সাফ করতে হলে বুলডোজার দিয়ে রাতারাতি কোন পন্থায় যেমন দ্রুত সম্ভব নয়; তেমনই খুব দৃঢ়-কঠিন, সুস্পষ্ট ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছাড়া জঙ্গি দমন খুব সহজ কাজ বলেও মনে হয় না।

সঙ্গত কারণেই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ক্ষমতাসীন সরকারের যুদ্ধাপরাধীর বিচার কার্য সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভাবার কিংবা তাদের প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় না নেওয়ার ক্ষেত্রে দূরদর্শিতার অভাব ছিল বলেই প্রতীয়মান হয়। আমার কিছুতেই বোধগম্য হয় না যে, জামাতের মত এত জঘন্য ও ভয়ঙ্কর একটি সংগঠন তাদের বিরুদ্ধে বিচারকে মুখ বুজে নীরবে মেনে নেবে কোনোরকম পাল্টা আঘাত ছাড়াই এমন ধারনা সরকারি উচ্চমহল কীভাবে পোষণ করলেন; আর যদি তাঁরা এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতেন তবে প্রতিটি রায় কার্যকর করার পরে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া,আন্তর্জাতিক মহলের সাথে যোগাযোগ তথা তাদের অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় আচরণ পর্যবেক্ষণ করে আমাদের সরকারের কিছু প্রস্তুতি এবং কর্মকৌশল নিশ্চয়ই আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারতাম। এই বিচারকার্যের সমসাময়িক ২০১৩ থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ডগুলির সাথে কোনভাবেই জামাতের সংশ্লিষ্টতা নেই প্রশাসন এমন ধারনায় উপনীত হবার মত যথেষ্ট কোন কারণ আছে কিনা সেটিও সুস্পষ্ট নয়।এমনকি জামাতের রাজনীতি বন্ধের ব্যাপারেও সরকারী কোন কঠোর সিদ্ধান্ত তথা উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। এ প্রসঙ্গে এযাবতকালে যা দেখেছি তা কেবল হতাশারই নামান্তর। সুতরাং এখন সময় এসেছে সরকারকে তার কর্মকৌশলের ফোকাস নির্দিষ্ট করার।

একথা স্বীকার্য যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব হিসেবে পুলিশি তৎপরতা নিঃসন্দেহে প্রয়োজন; পাশাপাশি, আমাদের মত বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি দেশে এত অল্পসংখ্যক পুলিশের যোগ্যতা-দক্ষতা আর সীমাবদ্ধতার বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।অতীতের বিভিন্ন ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মতৎপরতা নিয়ে অনেকে বিক্ষুব্ধ হলেও গুলশানের এই ঘটনায় নিহত দুজন পুলিশ অফিসারের দায়িত্বপরায়ণতার কথা আজীবন কৃতজ্ঞতার সাথেই স্মরণ রাখবে জাতি বলেই বিশ্বাস করি।তথাপিও, জঙ্গি দমনে কেবল পুলিশি নির্ভরতাই একমাত্র পন্থা কতটা বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল সেটাও ভাবনার সময় এসেছে।আবার একথাও চরম সত্য যে, অন্যান্য পন্থার সাথে জঙ্গিদমন কর্মকৌশলের অংশ হিসেবে পুলিশবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে অচিরেই যে পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা দরকার তা হল-

১। পুলিশের মাথাপিছু সংখ্যা বৃদ্ধি;
২। পুলিশের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য লজিস্টিক সাপোর্টের যোগান;
৩। পুলিশের পেশাগত উন্নয়নে উন্নত ও আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ;
৪। পুলিশের ভেতরে এবং আলাদাভাবে উন্নত মানসম্পন্ন গোয়েন্দা বিভাগ/সংস্থার সৃষ্টি;

পরিশেষে বলব, জঙ্গি নির্মূলে সামরিক-বেসামরিক, সামাজিক ও রাজনীতিক একটি সম্মিলিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা আজ সময়ের দাবি। আর এ জন্য প্রয়োজন সরকারি সদিচ্ছা আর সুষ্ঠু কর্ম পরিকল্পনা। আমরা ধর্মের নামে আর নিরীহ জনতার রক্তের হোলি দেখতে চাই না। চাই না দেশি-বিদেশি, বিধর্মী-ধর্মগুরু,পুলিশ-জনতা কারও নির্মম হত্যা। আর একটি হত্যাও না ঘটুক বিচার বহির্ভূত এমন একটি সোনার দেশের স্বপ্ন দেখি আমরা। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেটি সম্ভব এবং ক্ষমতাসীন সরকারই পারবেন সেটা করতে।

যতদূরেই থাকি পাশে আছি বাংলাদেশ। ভাল থেকো বাংলাদেশ!

সঙ্গীতা ইয়াসমিন, কানাডা প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ