আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

আঞ্চলিক সংহতির সম্ভাবনার পায়ে নীরব কুঠারাঘাত

শিবলী নোমান  

দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের দেয়া রায় বিপক্ষে যাওয়ার পর তা প্রত্যাখ্যান করেছে চীন। ভূ-রাজনীতিতে নিজের পাতে ঝোল টানতে বড় শক্তিগুলোর এমন প্রত্যাখ্যানের নজির নতুন নয়। বরং দক্ষিণ সাগর নিয়ে চীনের এই প্রত্যাখ্যান সেই ধারাবাহিকতায় আরো একটি ঘটনা যোগ করলো মাত্র। এই অঞ্চলে বড় শক্তিগুলোর স্বার্থ জনিত উত্তেজনা এতে নিঃসন্দেহে বাড়বে। আগামীতে নানা চেহারা নিয়ে এর প্রতিফলনও আমাদের সামনে হাজির হবে। সময়েই তা প্রকট হবে। তবে আঞ্চলিক সংহতির যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে ঘিরে তাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হওয়ার শঙ্কা এখনই মাথা তুলেছে। কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের ঘেরাটোপে এই অঞ্চলে যে অশান্তির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তার দায়ভার থেকে এ অঞ্চলের বড় শক্তিগুলোও মুক্তি পাবে না।

এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই ভারতের সহায়তা ছাড়া এগুতে পারবে না, তা বহু আগে থেকেই আলোচিত হচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে ভারত এখনো প্রকাশ্য কোনো অবস্থানে যায় নি। তবে সাম্প্রতিক নানা তৎপরতায় তারা যে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকেছে, তা বুঝতে বাকি থাকে না। ব্রিকস-স্বপ্নের বুননে চীনের আরেক অংশীদার রাশিয়া এখনো চুপচাপ এই ইস্যুতে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই। তারপরেও ভিয়েতনাম ও চীন- উভয়ের সঙ্গেই রাষ্ট্রটির যে কৌশলগত সম্পর্ক, সে বিবেচনায় ইস্যুটি নিয়ে খোলামেলা কোনো অবস্থান রাশিয়া নেবে বলে মনে হয় না। কাজেই পরিস্থিতির পুরো ফায়দা যুক্তরাষ্ট্র তোলার চেষ্টা করবে, এ কথা স্পষ্ট।

দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে ভারতের যে খুব একটা বেশি লাভ রয়েছে, তা মনে না করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বরং তাদের উদ্বেগটা ভারত মহাসাগর নিয়েই অনেকাংশে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, বঙ্গোপসাগর তাদের প্রধান মাথাব্যথা এখন। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের এলএসএ কার্যকর হলে, চুক্তি অনুযায়ী উভয় দেশ পরস্পরের স্থাপনা, সীমা ও সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে। ফলে দক্ষিণ চীন সাগরের উত্তাপের আঁচ ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে স্বাভাবিকভাবে লাগবে।

এই অঞ্চলটিকে এভাবে একটি সম্ভাব্য যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে নিয়ে যাওয়ার পেছনে চীন ও ভারতের নিজেদের স্বার্থ ছাড়াও আরো একটি রাষ্ট্রের নীরব অবদান রয়েছে। সেই রাষ্ট্রটির নাম পাকিস্তান। এককালে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির এক হরিহর আত্মা ছিলো যে রাষ্ট্রটি। খুব ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যায়, অতীতের মতোই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সংহতির সম্ভাবনা এবারো মাঠে মারা যেতে বসেছে সন্ত্রাস-কবলিত এই রাষ্ট্রটির নীরব অবদানেই।

গেলো কয়েক বছরে নানা উপলক্ষে ভারত ও চীন পরস্পরের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করেছে। নিজেদের কৌশলগত স্বার্থের ব্যাপারে স্বভাবসুলভ কঠোরতা দেখালেও আঞ্চলিক সংহতির প্রশ্নে তারা একে অন্যের দিকে অনেকটাই এগিয়ে এসেছিলো। রাশিয়াও সেই পথে দিব্যি এগিয়ে যায়। কিন্তু গোলমাল বাধে অন্য জায়গায়। যুক্তরাষ্ট্র নানা কারণে তার দক্ষিণ এশিয়ার নীতি ঝালাই করতে গিয়ে দেখে, দশকের পর দশক ধরে পাকিস্তানি বন্ধুতায় তাদের লাভের চেয়ে লোকসানের পাল্লা ভারি। মার্কিন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ব্রুস রাইডেল তো প্রকাশ্যে লিখতে ও বলতেও ছাড়েন নি যে, এই রাষ্ট্রটির পেছনে মার্কিন অর্থ ঢালার ফল উল্টোই হয়েছে। কাজেই ভূরাজনীতির সমীকরণে লাভের খাতা খুলতে এ অঞ্চলে মার্কিন পরিকল্পনায় ফোকাস হয় ভারত, ডিফোকাস হতে থাকে পাকিস্তান। জন্ম থেকেই পাকিস্তান একেকটি শক্তিকে একচেটিয়াভাবে এ অঞ্চলে নাক গলানোর সুযোগ করে দিয়েছে। এই সম্পর্কগুলোকে নিষ্কণ্টক করতে তারা সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়েছে এখানে ওখানে, নিজের ঘরে সন্ত্রাসীদের লালন করেছে এবং স্বভাবতই এর বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে নিজেরাও নিজেদের তৈরি সন্ত্রাসীদের হাতে আক্রান্ত হয়েছে। কাজেই এবারো যখন যুক্তরাষ্ট্র-বন্ধন যাই যাই করছে, তখন পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতার নতুন এজেন্ডা তৈরি করলো পুরনো মিত্র চীনের সঙ্গে। আমার বিবেচনায়, অতি সম্প্রতি আঞ্চলিক সংহতির সব প্রচেষ্টার মূলে কুঠারাঘাতের সেটাই সূচনা।    

এমনিতেই একটি যুদ্ধ লড়ার পরেও ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত জটিলতা এখনো বিদ্যমান। সীমান্ত সংকট রয়েছে পাকিস্তানের সঙ্গেও। তার ওপর দীর্ঘ সময়ের বৈরিতার ইতিহাস মানসিকভাবেই এই রাষ্ট্রগুলোকে একে অন্যের প্রশ্নে সতর্ক করে তোলে। তা ছাপিয়ে যখন চীন-ভারতের কাছে আঞ্চলিক নিরাপত্তা মুখ্য হয়ে উঠছিলো, তখনই পরমাণু সরবরাহকারী রাষ্ট্রগুলোর জোট এনএসজিতে ভারতের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সবচেয়ে বড় সংকটি তৈরি হয়। ভারতের পক্ষে বড় সমর্থন থাকলেও চীন ও তুরস্কসহ কয়েকটি রাষ্ট্র এর বিরোধিতা করে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে চীন দাবি করেছে, তারা সুনির্দিষ্ট করে ভারতের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করে নি। বরং নন-এনপিটি রাষ্ট্রগুলোকে এনএসজির সদস্যপদ দেয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়মাবলীর কথা বলেছে। এছাড়া সবশেষে বৈঠকে এ সংক্রান্ত কোনো এজেন্ডাও ছিলো না বলে চীন দাবি করে।

যদিও ঘটনাক্রমে পর্যালোচনা করলে স্পষ্টতই বোঝা যায়, চীন শুধু একা ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় না। যদি করতেই হয়, তারা পাকিস্তানকেও নিতে চায়। শেষ সময়ে এসে তাই পাকিস্তান আবেদন করে। খুব স্বাভাবিকভাবেই চীনের এই অবস্থান ভূরাজনীতির সমীকরণে ভারতকে তাদের ওপর ভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগে উৎসাহী করে তোলে। আর সেটারই ফলাফল যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সঙ্গে ভারতের যৌথ মিশন মালাবার।

ইতিহাস বলে, ১৯৭৪ সালে ভারতের পরমাণু পরীক্ষার ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আজকের এনএসজির পথচলা শুরু হয়। এরপর রাষ্ট্রটির পথ পরিক্রমা দেখলে তাকে নিঃসন্দেহে এনএসজির জন্য যোগ্য হিসেবে পরমাণু-বিশ্ব বিবেচনা করতেই পারে। সেই তুলনায় পাকিস্তানের অবস্থান বরং অনেক পেছনে। এর বাইরে পাকিস্তান সন্ত্রাস কবলিত রাষ্ট্র হওয়ায় পরমাণু-শক্তিধরদের সর্বোচ্চ ফোরামের সদস্যপদ প্রাপ্তি ভবিষ্যতে নতুন নতুন সংকট তৈরি করতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র-হারা হয়ে পাকিস্তান যখন চীন-যাত্রা করলো, তখন আবারো চীন কেন এই রাষ্ট্রটিকেই বিশ্বস্ত মনে করলো, তার জবাব হয়তো সময় দেবে। তবে আপাতত তা এই অঞ্চলে আন্তঃসম্পর্কের নতুন জটিলতা তৈরির পথ করে দিলো। এখন প্রশ্ন হলো, মোটামুটি একাকী একটা পরিস্থিতি তৈরি হবে জেনেও চীন কেন এই ঝুঁকি নিলো?

এই অঞ্চলে প্রভাবশালী সবগুলো রাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গত এক দশক ধরে গড়ে তোলার দাবি বাংলাদেশ করতেই পারে। বিশেষ করে আঞ্চলিক সংহতির প্রশ্নে বাংলাদেশ এ অঞ্চলের তিন শক্তি রাশিয়া-চীন ও ভারতকে সম্যক সহায়তাও করেছে। বড় শক্তিগুলোর আন্তঃসম্পর্ক তৈরিতে দূতিয়ালিও কিছু কম হয় নি। তারপরেও বাংলাদেশে একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচার নিয়ে নির্লজ্জ মিথ্যাচারকারী পাকিস্তানকে যদি কোনো রাষ্ট্র আরো বেশি উগ্র হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়তা করে, তাহলে তা বন্ধুত্ব প্রিয় বাংলাদেশের জন্যও কষ্টদায়ক হয়। সন্ত্রাসবাদের যে অভিন্ন বিপদ এ অঞ্চলের সামনে অপেক্ষা করছে, সেখানে যৌথ লড়াইটিও তখন হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। আস্তিনে সাপ পেলেপুষে সাপ তাড়ানো যায় কি?

উনিশ শতকে ব্রিটেনের সাম্রাজ্য যখন নিভু নিভু, তখন দুটো সমান্তরাল শক্তির উত্থান ঘটতে থাকে। একটি জার্মানি, অন্যটি যুক্তরাষ্ট্র। নানা বিবেচনায় ব্রিটেন দুই শক্তির একটিকে কিছুটা ছাড় দিয়ে মিত্রতার কৌশল নেয়। সেক্ষেত্রে তারা বেছে নেয় যুক্তরাষ্ট্রকে। ঠিক এখন যেমন যুক্তরাষ্ট্র বেছে নিয়েছে ভারতকে। জার্মানি তখন টগবগ করে ফুটছে। এরপরের সেই বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস সবারই জানা। সেদিন জার্মানি ভুল সময়ে ভুল মিত্র চিহ্নিত করেছিলো। তার খেসারত দিতে হয়েছিলো অনেকটা একা হয়ে। আরো পরে বিশ্বযুদ্ধে পর্যুদস্ত হয়ে। ইতিহাসের এই শিক্ষা এখন এ অঞ্চলের শক্তিগুলোর কাজে লাগলেও লাগতে পারে।

শিবলী নোমান, সাংবাদিক। ইমেইল : [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ