আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

একজন কর্নেল তাহের এবং তাঁর পৃথিবীর সমান বয়সী স্বপ্ন

আরিফ রহমান  

সর্ববৃহৎ সেক্টর ১১ নাম্বার সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রিফিং চলছে, একজন শীর্ণদেহ মেজর, কিছুদিন হয় পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছেন। এখন ১১ নাম্বার সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বললেন;

"কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে তার খাসী আর মুরগী খেয়ে গেরিলা যুদ্ধ হয় না। যদি কোন কৃষকের গোয়ালে রাত কাটাও,সকালে গোবরটা পরিষ্কার কোরো। যে দিন অপারেশন না থাকে তোমার আশ্রয়দাতাকে একটা Deep Trench Latreen তৈরি করে দিও। তাদের সঙ্গে ধান কাটো, ক্ষেত নিড়াও।"

দুই.
ডিসেম্বরের শেষ দিকে. বিজয়ের আর মাত্র অল্প কয়টা দিন সেই সেক্টর কমান্ডারের বাঁ পায়ে গুলি লেগেছে, রক্ত ঝরছে বিরামহীন; চেষ্টা করেও থামানো যাচ্ছে না।  তাঁকে উদ্ধার করতে মিত্র বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত হেলিকপ্টার নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌছলো। উদ্ধারকারী মিত্র বাহিনীর অফিসারকে সেই সেক্টর কমান্ডার হা হা করে হাসতে হাসতে বললেন:

'এরা কী যুদ্ধ করবে,এরা আমার মাথায়ই গুলি লাগাতে পারেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই, এরা আটকাতে পারবে না, এদের এই ক্ষমতাই নাই'।


তিন.
কর্নেল তাহেরকে জানানো হয়, আজ তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হবে। তিনি সে সংবাদ গ্রহণ করেন এবং সংবাদবাহকদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তারপর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় তিনি তাঁর খাবার শেষ করেন। পরে একজন মৌলভি তাঁকে তাঁর পাপের জন্য ক্ষমা চাইতে বলেন।
তাহের বললেন,

...'তোমাদের সমাজের পাপাচার আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। আমি কখনো কোনো পাপকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। আমি নিষ্পাপ। তুমি এখন যেতে পারো, আমি ঘুমাবো।' তিনি একেবারে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেলেন। রাত ৩টার দিকে তাঁকে জাগানো হলো। সময় জেনে নিয়ে তিনি দাঁত মাজলেন। তারপর শেভ করে গোসল করলেন। উপস্থিত সবাই তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এলে তিনি বললেন, 'আমি আমার পবিত্র শরীরে তোমাদের হাত লাগাতে চাই না।' তিনি নিজেই তাঁর কৃত্রিম পা খানি লাগিয়ে প্যান্ট-জুতা পরে নিলেন। চমৎকার একটা শার্ট পরলেন। ঘড়িটি হাতে দিয়ে মাথার চুল আঁচড়ে নিলেন। তারপর উপস্থিত সবার সামনে আম খেলেন, চা খেলেন এবং সিগারেট টানলেন। সবাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন-
 
'তোমরা এমন মনমরা হয়ে পড়েছো কেন?
মৃত্যুর চেহারায় আমি হাসি ফোটাতে চেয়েছিলাম।
মৃত্যু আমাকে পরাভূত করতে পারে না।'

তাঁর কোনো ইচ্ছা আছে কি না জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন-

'আমার মৃত্যুর বদলে আমি সাধারণ মানুষের শান্তি কামনা করছি।'

এরপর ফাঁসির মঞ্চে আবৃত্তি করেন সেই কবিতা-

‘জন্মেছি, সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে কাঁপিয়ে দিলাম।
জন্মেছি, তোদের শোষণের হাত দুটো ভাঙ্গব বলে ভেঙ্গে দিলাম।
জন্মেছি, মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে করেই গেলাম।
জন্ম আর মৃত্যুর দুটি বিশাল পাথর রেখে গেলাম।
পাথরের নিচে, শোষক আর শাসকের কবর দিলাম।
পৃথিবী অবশেষে এবারের মতো বিদায় নিলাম...’

এরপর,
একজন কর্নেল তাহের; পৃথিবীর সমান বয়সী স্বপ্ন নিয়ে আলিঙ্গন করেন ফাঁসির রজ্জু...


চার.
একবার জল্লাদ সিরাজউদ্দিনের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিলো মিনার মাহমুদের বিচিন্তা পত্রিকায়। সেই সাক্ষাৎকারের কিছু চুম্বক অংশ পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরলাম:

প্রশ্ন: ফাঁসির মঞ্চের কোনও ব্যক্তির আচরণ কি আপনার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে?  
যদি যায়, তবে সেই ব্যক্তিটি কে?

জল্লাদ সিরাজউদ্দিন: কর্নেল তাহের।

ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াইয়া তিনি সহজভাবে কথা বলেছেন।
একটা বিপ্লবী কবিতা পইড়া শোনাইছেন।

আশ্চর্য! তিনি নিজের হাতে যমটুপি পরছেন। নিজেই ফাঁসির দড়ি নিজের গলায় লাগাইছেন। আমার মনে হয় ফাঁসির মঞ্চে এমন সাহস- দুনিয়ার আর কেউ দেখাইতে পারে নাই...

পাঁচ.
মানুষকে অনেকের অনেক কথাই নাড়া দেয়।
 তেমনি আমার চিন্তার জগতকে ওলটপালট করে দেয় কর্নেল তাহেরের একটা উক্তি:

"নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর কোনো বড় সম্পদ নেই।
আমি তার অধিকারী। আমি আমার জাতিকে তা অর্জন করতে ডাক দিয়ে যাই।"

আসলেই, নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে বড় সম্পদ আর একটাও নাই।
এখনো সেই সম্পদ অর্জনের চেষ্টা করে যাই অবিরত...

তাহের মরেনি তাহেররা কখনো মরে না। আমার সাথে তাহেরের দেখা হয় কানসাটে -ফুলবাড়িতে- ভবদহে- নারায়ণগঞ্জে-সাভারে-শাহবাগে-পরিবাগে কিংবা অন্য কোথাও।

আজ তাহেরের ফাঁসি দিবস, শ্রদ্ধা আর সম্মানের সাথে স্মরণ করছি তাঁকে।

আরিফ রহমান, লেখক, অনলাইন এক্টিভিষ্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ